একদিনও যে রাজাকার ছিল সে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না
একাত্তরে ওরা দম্ভ নিয়ে বাড়িঘর পোড়াইছে, এখন বুক ফুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তুলছে। আমাদের কাছে এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে!
“ট্রেনিংয়ে যখন যাই তখন অনেকেই সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। তাদের বয়স ছিল কম। ফলে রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। নবম শ্রেণিতে পড়ত আব্দুস সালাম ও বাবুল। ওদের বাড়ি পিপড়াছিটে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাদের। যাওয়ার সময় বুঝিয়ে বলেছিলাম, ‘ফিরে এসেই তোদের ট্রেনিং দিমু’। গ্রামে থেকেও ওরা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করেছে।
পিস কমিটির লোকেরা ওইসময় গ্রামে গ্রামে হানা দিত। পরে পাকিস্তানের অনুসারী অনেকেই মিলে কালিয়াকৈরে রাজাকার বাহিনীও গড়ে তোলে। অতঃপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যুবক ও তরুণদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলে। রাজাকারে যারা যায়নি তাদের ওরা তুলে দিত পাকিস্তানি আর্মির হাতে। মেরেও ফেলছে অনেককে। ধনী বা গরীব দেখে নাই। যুবক পেলেই রাজাকারে যেতে বাধ্য করা হতো। কেউ কেউ গিয়েছে নিজ থেকেই। গরীব পরিবারের অনেকেই যায় বেতন আর রেশনের লোভে।
রাজাকার বাহিনীতে না যাওয়ায় সালাম ও বাবুলের ওপরও চড়াও হয় পিস কমিটির লোকেরা। চলাচলের জন্য তখন আর্মি ক্যাম্প থেকে কার্ড দেওয়া হতো। ওই কার্ড করতে একদিন তারা যায় কালিয়াকৈরে। ওখানে তাদের পেয়ে রাজাকারেরা তুলে নেয়। পরে নির্মমভাবে হত্যা করে। সালাম ও বাবুলের কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। আমাদের সঙ্গে নিয়ে গেলে হয়তো তারা লাশ হতো না। এমন অপরাধবোধ আজও জাগে মনে। একাত্তরে এমন শত শত ঘটনা ঘটেছে। ওইসব ইতিহাস এখনও উঠে আসেনি।”
একাত্তরের একটি ঘটনার কথা এভাবে তুলে ধরেই আলাপচারিতা শুরু করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান। এক সকালে তাঁর বাড়িতে বসেই কথা হয় একাত্তর প্রসঙ্গে।
সাহাবউদ্দিন ও হাজেরা খাতুনের ছোট সন্তান মো. হাবিবুর রহমান। বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাই বাড়ি গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি পিপড়াছিট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ভর্তি হন বড়ইবাড়ি আলহাজ্ব কছিমুদ্দিন ইনস্টিউশনে (বর্তমানে বড়ইবাড়ি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ)।
তিনি এসএসসি পাশ করেন ১৯৬৭ সালে। অতঃপর টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সরকারি সা’দত কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ওই কলেজেই ভর্তি হন ডিগ্রিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ডিগ্রি পরীক্ষার্থী।
কলেজে গিয়ে হাবিবুর রহমান যুক্ত হন ছাত্র আন্দোলনে। ছাত্রলীগ করতেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তুমুল আন্দোলন হয় সা’দত কলেজে। ঢাকা থেকে তখন নির্দেশ আসে ৬ দফা ও ১১ দফা নিয়ে গ্রামপর্যায়ের মানুষকে ব্রিফ করার। খন্দকার বাতেন, মেহের আলী, লাবীব উদ্দিন, আবুল বাসার, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তারাও গ্রামপর্যায়ে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে কথা বলতেন। কালিয়াকৈরেও অ্যাডভোকেট দেওয়ান মোহাম্মদ ইব্রাহীম সাহেবসহ বড়ইবাড়ি, ফুলবাড়িয়া, মির্জাপুর, চাপাই প্রভৃতি এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে ব্রিফিংও করেছেন। এভাবেই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭০-এর নির্বাচনে হাবিবুররা কাজ করেন নিজ এলাকায়, কালিয়াকৈরে। সেখানে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান শামসুল হক। তার অপজিশনে ছিলেন মুসলিম লীগার চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন, মাছ মার্কায়।
সত্তরের নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। হাবিবুররাও তখন পথে নামেন। সবাই অপেক্ষায় থাকেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার।
ভিডিও-১৯৭১: কালিয়াকৈর থেকে আসামে যাওয়া এবং শিলচর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাবিবুরও। তার মুখেই শুনি সেদিনের ঘটনা। তার ভাষায়, “করোটিয়া কলেজ থেকে কয়েকটি বাসে যাই রেসকোর্স মাঠে। গোটা মাঠ তখন লোকে লোকারণ্য। বাঁশের লাঠি নিয়ে অপেক্ষায় সবাই। স্লোগান তুলছে থেমে থেমে। আমরা চেয়েছিলাম সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরাসরি বললেন না। কৌশলে বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর পর আর কোনো ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। বুঝে যাই যুদ্ধ ছাড়া গতি নেই।”
জুন মাসের প্রথমদিকেই পাকিস্তানি আর্মিরা ক্যাম্প করে কালিয়াকৈরে, ডাকবাংলোতে। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে চৌধুরী তানভীর আহমেদ চৌধুরী, সিদ্দিক হোসেন, তাজু মাস্টার, তজিমুদ্দিন চেয়ারম্যান, আব্দুল হালিম মেম্বার, আব্দুল আজিজ আহমদ, আব্দুর রহমান প্রমুখ। ওরা নিজেদের পরিচিত ও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে পিস কমিটিও গঠন করে। পাকিস্তানি সেনাদের খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে দিত তারা। পরে তজিমুদ্দিন পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় প্রথম আর্মস গ্রুপ গঠন করে। কিন্তু ওইসময় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধে টাঙ্গাইলের উত্তর সখীপুরে শামসুর রহমান শাহজাহান একটি সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করেছিলেন। খবর পেয়ে দলবল নিয়ে তিনি একদিন তজিমুদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে হত্যা করেন। ওইসময় আব্দুল আজিজ নামে এক মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন।
পাকিস্তানি সেনারা এসে কী করল?
হাবিবুর বলেন, “আর্মিরা প্রথম বাজারের পাশেই এক বাড়িতে ঢুকে নিরীহ-নিরাপরাধ ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ধীরে ধীরে তারা নদীর পাড় ধরে বাড়িঘর পুড়িয়ে ভাটির দিকে যেতে থাকে। পোড়ায় বোয়ালী গ্রামের পুরোটাই। এর পর টানপাড়ায়, সখিপুর, মৌচাকে আগুন দিয়ে অত্যাচারও করে। হিন্দুদের বাড়ি পুড়িয়েছে বেশি। মুসলমানদের মধ্যে বাসেদ শিকদার ও আব্দুল বারি শিকদার ছিলেন ধনী মানুষ। সত্তরের নির্বাচনে শামসুল হক সাহেবের পক্ষে ছিলেন। শুধু এই অপরাধেই তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসররা।”
আপনারা তখন কি করলেন?
“ওই অবস্থায় তো থাকা যায় না। আবুল বাশার, চাঁন মিয়া, আব্দুল হক, মোতালেব, হাবিল সিকদার, গাজী সামানসহ আমরা গোপনে নানা খবরাখবর রাখতাম। একদিন আমাদের নিয়ে যেতে শামসুল হক সাহেব আরফান আলী খান ও পরিমলকে পাঠান। ট্রেনিংয়ে ৪০ জন যাই প্রথমে। মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করেই ঘর ছেড়েছি। টাকা পয়সার প্রয়োজন ছিল। বড় ভাই ধান বিক্রি করে এবং মা জমানো টাকাসহ মোট ৪০০ টাকা হাতে তুলে দেন। কিছু চিড়া-মুড়ি সারের কাগজে পেঁচিয়ে বুধবারের দিন সকালে রওনা হই আমরা।”
কোথায় গেলেন?
তিনি বলেন, “প্রথমে যাই ঠেঙ্গার পার, শামসুল হক সাহেবের বাড়িতে। সেখান থেকে ডিঙি নৌকায় যাই ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের পুকুর পাড়ে। পরে সড়ক পথে হেঁটে যাই পূবাইল। সেখান থেকে নৌকায় প্রথমে নাগরি এবং পরে মেঘনা নদী পার হয়ে পিপড়ার বাজার দিয়ে পৌঁছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারগাছ হোল্ডিং ক্যাম্পে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পার করে দিত। গাইড ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহাঙ্গীর। দুইদিন থাকার পর সীমান্তবর্তী একটা নদী পার হয়ে আমরা ভারতে ঢুকি।”
ট্রেনিং নেন কোথায়?
“প্রথমে যাই ইছামতি ক্যাম্পে। ওখানে লেফটরাইট চলে পনের দিনের মতো। ক্যাম্পের দায়িত্বে ধামরাইয়ের এমপিএ জালাল উদ্দিন আর টুয়াইসি ছিলেন মোহাম্মদ আলী অ্যাডভোকেট। এর পরই আমাদেরকে আসামের শিলচর ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ওখানে ট্রেনিং হয় এক মাসের ওপরে। মুজিব, নজরুল, তাজউদ্দিন নামের অদ্যাক্ষরে এম, এন, টি– তিনটা উইং ছিল। আমি ‘এম’ উইংয়ের স্কট লিডার ছিলাম।”
ট্রেনিংয়ের একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা এই মুক্তিযোদ্ধা তুলে ধরেন ঠিক এভাবে, “একদিন গ্রেনেড থ্রো শেখানো হচ্ছিল। ফারুক নামে এক ছেলে গ্রেনেডের পিন খুলে ভয়েই সেটা হাত থেকে ফেলে দেয়। দ্রুত লাফ দিয়ে আমি সেটা ফেলে দিই পাহাড়ের নিচে। তা না হলে ফারুক হয়তো মারা যেত। এটা দেখে ওস্তাদরা বেশ অবাক হন। তারা একে অপরকে বলতেন, ‘এমন ছেলে আর জোশ যদি থাকে তবে বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই’।”
মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানদের কসম প্যারেড হয় শিলচরে। তারা অস্ত্র পান আগরতলায়, হোল্ডিং ক্যাম্প থেকে। তার নামে অস্ত্র ইস্যু হয় এসএমসি (শট মেশিন কার্বাইট), একটা মাইন ও একটা এন্টি এয়ারক্রাফট মাইন। ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন কালিয়ারকৈর এলাকায়। সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এ সেক্টরটি ছিল মূলত হাবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, আখাউড়া-ভৈরবের পূর্ব উত্তর অংশ এবং ঢাকা নর্থ এলাকা নিয়ে।
কালিয়াককৈরকে চারটি সেকশনে ভাগ করা হয়– উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও মাঝের এলাকা। হাবিবুর ছিলেন উত্তর এলাকায়। দশ জন নিয়ে একটা সেকশন। ওই সেকশনের কমান্ড করতেন তিনি। বাকি সেকশন কমান্ডাররা হলেন সামসুদ্দিন সরকার, সামসুল হক, খন্দকার আব্দুস সালাম। চারটি সেকশন মিলে আবার একটি গ্রুপ ছিল। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আনোয়ার হোসেন। আর তখন থানার কমান্ড করতেন ডিএ কাইয়ুম। অক্টোবর মাসে তারা কুমিল্লা দিয়ে ভেতরে ঢুকে নদী পথে নরসিংদী ও পূবাইল হয়ে মির্জাপুর দিয়ে কালিয়াকৈর আসেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “একাত্তরে ঢাকা নর্থের (বর্তমান গাজীপুর জেলা) পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিল চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। তার নির্দেশেই রাজাকাররা কাজ করত। প্রথমে কালিয়াকৈর বাজারের পাশে নদীর পাড়ের বাঙ্কার থেকে ধরে আনি ৭ রাজাকারকে। পরে কালিয়াকৈর বাজারের মধ্য থেকে ধরে আনি সিদ্দিক হোসেনকে। ধরে আনা হয় আব্দুল আজিজ, আলী আহমেদ, আব্দুল হালিমকেও। তখন শত শত মানুষ তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ তোলে। এভাবে চেয়ারম্যান আলী আহমদ গ্রামের গরীব ছেলেদের নাম রাজাকারের তালিকায় তুলে দিয়েছিল। অনেকেই তখন গরু আর ছাগল বিক্রি করে ওদের টাকা দিয়ে নাম কাটাইছে। আব্দুল আজিজ প্রতিদিন গ্রামের নানা খবর দিয়ে আসত আর্মি ক্যাম্পে। তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ আসায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাঁচিয়ে রাখেনি।”
অপারেশন প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তুলে ধরেন নানা ঘটনা। তার ভাষায়, “বোয়ালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পাশেই জংলা এলাকার ভেতরের এক মাঠে প্রতিদিন ৩০ জনকে ট্রেনিং করাতাম আমরা। অ্যাম্বুশ করে বিভিন্ন জায়গায় থেকে যে অস্ত্র পেয়েছি সেগুলো ওই ট্রেনিংপ্রাপ্তদের মাঝেই বিতরণ করি। ওরাই অপারেশনগুলোতে সঙ্গে থেকেছে। গ্রামের নানা খবর আনাসহ গ্রামগুলোতেও পাহারায় থাকত।
ডিসেম্বরের ১১ তারিখের ঘটনা। শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা সরে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। কড্ডার ব্রিজটা ছিল ভাঙা। নদী পার হতে না পেরে ওখানে তারা জড়ো হতে থাকে। তখন আশাপাশে যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে। পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানও তাদের কাভারিং দিচ্ছে।
এ খবর পেয়ে বোয়ালী থেকে আমরা এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর আরও বেশকিছু গ্রুপ অগ্রসর হয়। সাকাশ্বর পৌঁছি দেখি হেলিকপ্টার থেকে ইন্ডিয়ান আর্মিরাও নেমে অবস্থান নিয়েছে। আমার ছিলাম দেড়-দুইশ জনের মতো।
ভিডিও-১৯৭১: কালিয়াকৈর অপারেশন এবং রাজাকারদের তৎপরতা
তুরাগ নদীর পাশেই গোয়ালে নদী। পাহাড় থেকে নেমে এসে নদীটা তুরাগে মিশেছে। ওটাই কড্ডায় আসছে। হঠাৎ খবর পাই, আমাদের পক্ষে গোয়ালে নদীর ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান আসছে। সত্যিই তাই। একেবারে পানির ওপর দিয়ে প্লেনটা কড্ডায় এসেই পাকিস্তানি সেনাদের দিকে ফায়ার দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয়। আমরাও তখন তুমুল গুলি চালাই। বৃষ্টির মতো চলে দুপক্ষের গুলি।
কয়েকটা মাটির ঘরের আড়ালে ছিল আমাদের পজিশন। নদীর ওপারে পাকিস্তানি আর্মি। গোলাগুলিতে হঠাৎ ওদের একটা যুদ্ধবিমান পড়ে যায় পিরোজ আলী গ্রামে। এতে আমাদের বেশ সুবিধা হয়। কিন্তু গোলাগুলিতে তখন আমার সেকশনের আলী আহমেদ শহীদ হন। এসএলআর-এর গুলি লেগেছিল তার। পাশেই ছিল পুলিশের এক লোক, নাম সাহাবুদ্দিন। গুলি লেগে সেও ছিটকে পড়ে। সবকিছু ঘটছে চোখের সামনেই। সাকাশ্বরের নোমেজ উদ্দিন ও আব্দুল আজিজ প্রাণপন যুদ্ধ করছিল। ওরা দৌড়ে শেল্টার বদলানোর চেষ্টা করে। তখনই গুলি লাগে। খানিক ছটফট করেই তাদের দেহ নিথর হয়ে যায়।
আমরা একটু এগিয়ে গেলে পাকিস্তানিরাও পেছনে নাউজুরে একত্রিত হয়। পরে তারা ঢাকার দিকে সরতে থাকে। ওদের একটা প্লেনসহ অগণিত সৈন্য মারা যায় ওই অপারেশনে। কালিয়াকৈরে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল ওটা। আমরা বলি, সাকাশ্বর বরাবো কড্ডা নাউজুর যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে ইন্ডিয়ান আর্মির কয়েকজন সেনাও শহীদ হন।”
এরপর আপনারা কী করলেন?
“আমরা তখন ক্যাম্পভুক্ত হয়ে থাকি। রাজাকার ও পিস কমিটির যারা লুকিয়ে ছিল তাদের খুঁজে বের করি। তাজু মাস্টার ও হোসেন সরকার ছিল কুখ্যাত পিস কমিটির নেতা। একজনের বাড়ি খালপাড়, আরেকজনের চাপাইর। মানুষের ওপর অনেক অত্যাচার করেছে তারা। শত শত মানুষ তাদের মৃত্যু কামনা করে। কিন্তু পিস কমিটির সবচেয়ে বড় নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীকে আমরা পাই নাই। দেশ স্বাধীনের আগেই সে লুকিয়ে চলে যায় ইংল্যান্ডে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তানভীর আহমেদ দেশে ফিরে আসে, যুক্ত হয় বিএনপির রাজনীতিতে।”
একাত্তরের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি আর্মিরা যখন ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় তখন কিছু রাজাকার অস্ত্রসহ হাবিবুর রহমানদের কাছে সারেন্ডার করে। এভাবে সারেন্ডার করা ৮ জন রাজাকার পরে মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছে তারা।
কীভাবে তা সম্ভব হলো?
আক্ষেপ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “ওরা আমাদের কাছেই সারেন্ডার করেছিল। এর কয়েকদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। পরে বিএনপির আমলে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। কিন্তু একাত্তরে একদিনও যে রাজাকার ছিল সে কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। এটাই তো হওয়া উচিত ছিল। ২০২০ সালে প্রতিবাদ জানালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। নিয়ম ছিল জামুকা সুপারিশ করে পাঠালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গেজেট করবে। কিন্তু বিএনপির আমলে কোনো সুপারিশ ছাড়াই সরাসরি মন্ত্রণালয় তাদের গেজেট করে দেয়। এটা শুধু এখানেই নয়। সারাদেশে এমন আছে টোটাল প্রায় ৩৪ হাজারের মতো।
গেজেট হয়েছে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে। শুনেছি ওই আদেশ বাতিল করতে গেলে সংসদে আইন পাস করতে হবে। এখন পর্যন্ত সে আইন পাস হয় নাই। ফলে এরা আবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ফিরে এসেছে এবং ভাতাও পাচ্ছে। একাত্তরে ওরা দম্ভ নিয়ে বাড়িঘর পোড়াইছে, এখন বুক ফুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তুলছে। আমাদের কাছে এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে! ওরা রাজাকারেরও ভাতা পেত। একাত্তরে যাদের বাড়িঘর ওরা পোড়াইছে তাদের মনের অবস্থা একটু ভেবে দেখেন। স্বাধীন দেশে এমনটা তো আমরা আশা করিনি। গেজেট বাতিলের আইনটা তো হওয়া উচিত ছিল “
তখনকার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে এখনকার নেতাদের তুলনামূলক আলোচনায় এ বীর মুক্তিযোদ্ধার মত এমন, “আমাদের সময় ছাত্রনেতারা ছিলের আর্দশিক। এখন আদর্শের চেয়ে লেজুড়ভিত্তিক বেশি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এমন, ‘অর্থনীতি ছাড়া রাজনীতি অন্ধ এবং রাজনীতি ছাড়া অর্থনীতি বন্ধ’। বঙ্গবন্ধু বলেছেন ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা। যেটাকে সংক্ষেপে আমরা সোনার বাংলা বলি। এটা গড়তে গেলে বঙ্গবন্ধু যে নিষ্ঠা এবং আদর্শ ধারণ করতেন তা নেতা-কর্মীদের চরিত্রে প্রতিফলন ঘটাতে হবে।”
নানা সমস্যা থাকলেও দেশে যুগান্তকারী উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান। তার আশা ও নির্ভরতা আগামী প্রজন্মের প্রতি। সকল বাঁধা অতিক্রম করে তারাই স্বাধীন এ দেশটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে– এমনটাই তার বিশ্বাস।
তাই প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “পাহাড়ের ঝর্ণাধারা বড় বড় পাথরকে গড়িয়ে এনে নুড়ি পাথরে পরিণত করে। তারপর সেটা সাগর-মহাসাগরে ভেসে যায়, বালিতে রূপান্তরিত হয়ে। বড় বড় পাথর ভাঙার একটা আনন্দ আছে। স্রোতধারার একটা ছন্দ আছে। এদেশের পাথরের মতো যে প্রতিবন্ধতাগুলো আছে তোমরা সেগুলো স্রোতের ধারায় চুরমার করে দেশটাকে এগিয়ে নিও। তোমাদের খণ্ড খণ্ড প্রতিবাদ ও ঐক্যই শক্তি। মনে রাখবে একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাসই তোমাদেরকে জয়ের শিক্ষা দেবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিভাগে, প্রকাশকাল: ১৩ জুলাই ২০২৩
© 2023, https:.