কলাম

গরিব দেশের গরিব প্রেসিডেন্টের ছেলে শেখ কামাল

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংগঠক, সংগীতানুরাগী, বিতার্কিক, নাট্যাভিনেতা রাজনীতিক। অথচ জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়েও ব্যাংক ডাকাতির মতো প্রোপাগান্ডা ভরা গালগপ্পোও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা কাজের অংশ হিসেবেই একবার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবুর মুখোমুখি হই। শেখ কামালের বন্ধু তিনি। ধানমন্ডির সাত নম্বর রোডের এগারো নম্বর প্লটে বাড়ি। খেলাধুলাই তাঁদের বন্ধুত্বের কারণ।

কেমন ছিলেন শেখ কামাল? তা জানাতেই একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন তিনি। তাঁর ভাষায়, “১৯৭২ সালে দুই বন্ধু সরকারিভাবে গিয়েছিলাম মিউনিখ অলিম্পিকে। সেখানে গিয়ে শত চেষ্টা করেও তাঁকে সরকারি টাকায় কিছু কিনে দিতে পারিনি। যাননি কোনো নাইটক্লাবেও। ওকে বলেছিলাম, প্রেসিডেন্টের ছেলে হিসেবে একটু ফিটফাট থাকতে তো পারিস। জবাবে কামাল বলেছিল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশের গরিব প্রেসিডেন্টের ছেলে আমি।”

যে সময়কার কথা বলা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ নামক দেশটি কেবল নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ঘটনাটা ছোট। তবে ছোট্ট এই ঘটনায় একজন শেখ কামালের চারিত্রিক দিকটি কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংগঠক, সংগীতানুরাগী, বিতার্কিক, নাট্যাভিনেতা ও রাজনীতিক। অথচ জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়েও ব্যাংক ডাকাতির মতো প্রোপাগান্ডা ভরা গালগপ্পোও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী একটি চক্রের মুখে ওই গল্প এখনও শোনা যায়।

ওইদিন শেখ কামালের সঙ্গে ছিলেন এবং গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁদের আরেক বন্ধু সাখাওয়াত মুবিন চৌধুরী শাহান। কথা হয় তার সঙ্গেও।

শেখ কামাল ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উত্তরাধিকার গ্রহণ করতে পারেন, এ সম্ভাবনা থেকে চক্রান্তকারীর দল রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেওয়ার আগেই তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করতে থাকে। ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িত হয়ে শেখ কামালের গুলিবিদ্ধ হওয়ার গল্প এ চরিত্র হনন অভিযানেরই একটি অংশ। শাহানের মুখে শুনি প্রকৃত ঘটনাটি।

বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে জাসদের একটি হঠকারী অংশ এবং তখনকার চীনপন্থী কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ দেশের চারদিকে, এমনকি রাজধানী শহরেও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছিল। সে রাতে গুজব রটেছিল, সন্ত্রাসীরা ঢাকার মতিঝিল এলাকায় তৎপরতা চালাবে। খবরটি জেনে শাহানসহ কয়েকজনকে নিয়ে শেখ কামাল মতিঝিল এলাকায় টহল দিতে গিয়েছিলেন। পুলিশও বেরিয়েছিল সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য। রাতের অন্ধকারে কামালের গাড়িকেই তারা সন্ত্রাসীদের গাড়ি ভেবে গুলি চালায়। তাতে শেখ কামাল গুরুতর আহত হন। এই খবরটিকেই একটি চক্র তাদের প্রোপাগান্ডার শক্তির জোরে ব্যাংক ডাকাতির গল্পে রূপ দেয় এবং সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়।

ওই সময় লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের তৎকালীন সাংবাদিক পিটার হেজেল হার্স্ট ছিলেন ঢাকায়। তাঁকেও এ খবরটি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘একজন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির দরকার কী? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজাররাই তাঁকে টাকা এনে দেবেন।’

তবে এমন ভিত্তিহীন ও মিথ্যা প্রচার শেখ কামালের কর্ম উদ্যোগকে এতটুকু দমাতে পারেনি। তিনি কাজ করে গেছেন নিজের মতো করে। অঢেল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সাদামাটা জীবনই ছিল তাঁর অসাধারণ একটি গুণ।

বন্ধু রুহুল আহম্মদ বাবুর সঙ্গে শেখ কামাল

শেখ কামালকে বলা হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু কীভাবে তিনি এ ক্লাবটি গড়ে তোলেন। এ নিয়ে বন্ধু ও ক্রীড়া সাংবাদিক সনৎ বাবলা গভীরভাবে কাজ করেছেন এবং নানা তথ্য তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা ‘শেখ কামাল ক্রীড়াঙ্গনের ধূমকেতু’ বইটিতে। সেখানে আবাহনী ক্রীড়াচক্র গড়ার ইতিহাসটিও আরেক ইতিহাস হয়ে আছে।

পাকিস্তান আমলে ধানমন্ডিতে বাঙালি-অবাঙালি মিলিয়ে ৫০-৬০টির মতো পরিবার বাস করত। কেডিএস ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাবরেটরির সামনের মাঠে খেলত ও আড্ডা দিত এলাকার কলেজপড়ুয়া ছেলেরা। ওটাই এখনকার আবাহনী মাঠ। মাঠের পাশেই থাকতেন আমিনুর রহমান খান নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথমে শিক্ষক এবং পরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ধানমন্ডির এক লোক ওই মাঠটি কিনতে ২৬৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। এ খবর জেনে আমিনুর রহমান এলাকার তরুণদের ডেকে মাঠটি রক্ষার অনুরোধ জানান। ফলে মাঠ রক্ষার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে তরুণরা। তাদের প্রতিবাদ নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদনও ছাপা হয়। খবর পেয়ে আশপাশের এলাকার তরুণরাও অংশ নিতে থাকে ওই প্রতিবাদে।

মাঠ রক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন হারুনুর রশিদ। তাদের প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল জানালেন, মাঠ বিক্রি হবে না। কিন্তু প্রতিবাদকারীরা তাতেও শান্ত হয় না। তারা দাবি তোলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির। সরকারও তাতে রাজি হয়। কিন্তু সমস্যা হলো ব্যক্তির সঙ্গে তো চুক্তি হবে না, সরকার চুক্তি করবে সংগঠনের সঙ্গে। ঠিক তখনই হাজির হন শেখ কামাল। তার মাথাতেই প্রথম ক্লাব গঠনের চিন্তা আসে। সেটাই অন্যদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।

তখন সংগঠনের নাম চেয়ে প্রত্যেক বাড়িতে চিঠি দেওয়া হয়। অনেকেই নাম পাঠান। সেখান থেকেই নির্বাচিত হয় ‘আবাহনী’। লালমাটিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মতিউর রহমান দিয়েছিলেন এই নাম। এভাবেই সংগঠনের নাম হয় ‘আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি’। এরপর চলে সমিতির সদস্য সংগ্রহ। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা দু-টাকা চাঁদা দিয়ে সদস্য হন। ওই সংগঠনের তিনটি শাখা ছিল—ক্রীড়াচক্র, সাহিত্য চক্র ও সাংস্কৃতিক চক্র। ১৯৬৮ সালে ‘আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি’র নির্বাচনও হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে স্বাধীন দেশে খেলাধুলাতেই বেশি মনোযোগী হতে থাকেন শেখ কামাল। তিনি মনে করতেন যুদ্ধের পর তরুণদের অনেকে বিপথে চলে যেতে পারে। তাই তাদের খেলায় নিয়ে আসা বিশেষ প্রয়োজন। এ কারণেই সাহিত্য চক্র ও সংস্কৃতি চক্র বাদ দিয়ে প্রথম বিভাগে কীভাবে ফুটবল খেলা যায়—সে বিষয়ে মনোযোগ দেন তিনি।

কিন্তু পাড়ার ফুটবল খেলে তো প্রথম বিভাগে যাওয়া যায় না! তাই তাদের মাথায় চিন্তা আসে একটি প্রথম বিভাগের ক্লাবকে কিনে সেটার নাম বদলে ফেলার। তাই ঘটে। বিহারীদের ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাব কিনে আদালতে গিয়ে তার নাম বদলে করা হয় ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’। ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতির। আর নবযাত্রা হয় ১৯৭২ সালে, আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে। আর এজন্যই শেখ কামালকেই বলা হয় আবাহনীর প্রাণপুরুষ।

প্রধানমন্ত্রীর ছেলে একটি ক্লাব করেছেন—এ খবর পেয়ে ওইসময় নানাজন ভিড় করত শেখ কামালের আশেপাশে। অনেকেই ক্লাবের জন্য টাকা দিতে চাইত, অনেক ব্যবসায়ী বিশেষ সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে টাকা দেওয়ার প্রস্তাবও করে। রাজাকাররাও চেষ্টা করেছে সুবিধা দিতে এবং বিনিময়ে সুবিধা নিতে। কিন্তু শেখ কামাল ছিলেন অনড়। নিঃস্বার্থ ও মানুষ বুঝে অর্থের সহযোগিতা নেওয়ার কথা তিনি বলেছেন আবাহনীর ম্যানেজার সুভাষ সোমকে।

ক্লাবের খরচ চালানোর জন্য একটি সার্কাস দলও গঠন করা হয় তখন। শুধু তাই নয়, আবাহনীকে জনপ্রিয় ফুটবল দলে পরিণত করার জন্য ওই সময়ের সব তুখোড় খেলোয়াড়দের কাছেও ধর্ণা দিয়েছিলেন কামাল। এমনকি ক্লাবের খরচের প্রয়োজনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গলার চেইন দিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩১ জুলাই। জার্মানি যাওয়ার দিন শেখ হাসিনা তাঁর ভাই কামালকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার কী লাগবে। নিজের জন্য কিছুই চাননি তিনি। বোনকে বলেছিলেন, ‘আমার খেলোয়াড়দের জন্য অ্যাডিডাস বুট নিয়ে এসো।’

বাংলাদেশে নান্দনিক ফুটবল ও ক্রিকেটসহ অন্যান্য দেশীয় খেলার মানোন্নয়নে শেখ কামাল অক্লান্ত শ্রম দিয়ে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলনও করতেন। আবাহনীর মাধ্যমে বিদেশি কোচ এনে এ দেশে প্রথম আধুনিক ফুটবলের সূচনাও করেন তিনি।

শেখ কামাল বুঝে গিয়েছিলেন, সদ্য স্বাধীন নিঃস্ব দেশে যুদ্ধফেরত সব তরুণের রাতারাতি কর্মসংস্থান করা যাবে না। আবার পুরোনো শিক্ষাঙ্গনের বা কর্মস্থলের প্রতিও তারা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। এতে অপকর্মে জড়িয়ে পড়বে, চাঁদাবাজি, ছিনতাই আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে যাবে। তাই হতাশাযুক্ত কর্মহীন তরুণ ও কিশোরদের নিয়ে তিনি ব্যান্ড গঠনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংগীতকেও নতুন ধারায় এনে নতুন একটি প্রেরণায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে যারা আগ্রহী ছিলেন না তাদের তিনি আকৃষ্ট করতেন খেলার জগতে।

১৯৭১-এ শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা লাভের পর ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে লেখাপড়া, ক্রীড়া, সংস্কৃতিচর্চা ও জনসেবায় ফিরে যান।

জাতির পিতা এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সন্তান হয়েও সব সময় ক্ষমতা বলয়ের বাইরে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। ক্ষমতার প্রতি তাঁর কোনো মোহই ছিল না। সেনাবাহিনীর লোভনীয় পদ ছেড়ে রাজনীতি ও জনসেবায় থাকতে চেয়েছিলেন। আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেও কোনো পদ গ্রহণ না করে একজন কর্মী ও সংগঠক হিসেবেই কাজ করেছেন।

সত্তরের দশকের শুরুতে যখন সারা বিশ্বেই তরুণ প্রজন্ম ড্রাগ আর মাদকের দিকে ঝুঁকছিল, তখন শেখ কামাল তারুণ্য ও যুবসমাজকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত করার মাধ্যমে তাদের দেশ গড়ার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ও সমাজের এমন কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ নেই, যেখানে শহীদ শেখ কামালের হাতের ছোঁয়া ছিল না।

তরুণ ও যুবকদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। যা তৈরি করেছিলেন নিজের যোগ্যতাতেই। তার জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বগুণ নিয়ে সাংবাদিক ও কলাম লেখক প্রয়াত এ বি এম মূসা স্মৃতিকথায় উল্লেখ করে লিখেছিলেন এভাবে, ‘বঙ্গবন্ধু তিয়াত্তরের নির্বাচনে আমাকে অংশ নিতে নানা কারণে বাধ্য করলেন। আমি তাকে বললাম, আপনি তো ৩০০ আসনে যাবেন না, তবে আমার এলাকায় যেতে হবে। তিনি কী বুঝলেন জানি না, দুষ্টুমির মুচকি হাসি হেসে বললেন, আমি যাব না, তবে একজনকে পাঠাব।

সেই একজন যে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তহীন শেখ কামাল তা জানলাম এক দিন সকালে টেলিফোন পেয়ে। ফোনে শেখ কামাল বলেন, “চাচা, আব্বার হুকুম আপনার দেশের বাড়িতে যেতে হবে।’’ নির্ধারিত দিন কামাল ফেনী এলেন, সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতাদের নিয়ে। খোলা জিপে ফেনী থেকে বিলোনিয়া প্রায় ২০ মাইল যাত্রাপথ। আমি জিপের চালকের আসনে, পাশে শেখ শহীদ আর ফেনীর ছাত্রলীগ নেতা রকিবউদ্দিন।

বন্ধু রুহুল আহম্মদ বাবুর সঙ্গে শেখ কামাল

আগেই কেমন করে যেন খবরটি রটে গিয়েছিল। যাত্রাপথে দেখি রাস্তার দুই পাশে ছেলে-বুড়ো, শিশু কোলে নারী, ধানক্ষেত থেকে উঠে আসা চাষি সবাইকে। পথে কাকে যেন কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘অ্যাই বেগগুন এইচ্ছা দৌড়ার-কা? কোনাই যার।’’ সবার মুখে এক কথা ‘‘শ্যাখের পোলারে দেখতে যাই।’’ দীর্ঘ ২০ মাইল পথ কামাল শুধু মুগ্ধ জনতার সালাম নিলেন আর দিলেন, শুধু হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন। যাওয়া-আসার পথে কোথাও থামেননি, পথসভায় রাজনৈতিক ভাষণ দেননি, জনসভা করেননি, নৌকা মার্কায় ভোট চাননি। আমার নির্বাচন সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। পরশুরামে আহারপর্ব শেষে একই পথে ফেনী, অতঃপর ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। আমি গর্বিত, ৩০০টি সংসদীয় আসনের মাত্র এই একটিমাত্র নির্বাচনী এলাকা সফর করেছিলেন শেখ কামাল। স্বল্পায়ু জীবনে শেখ কামালের এই একটিমাত্র অনুল্লিখিত “রাজনীতি-সম্পৃক্ততা’’।’

১৫ অগাস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সবাইকে হত্যার পরও খুনিচক্র শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে ভীত ছিল। সে কারণেই ওই চক্র ও তাদের সুবিধাভোগীরা এই প্রতিভাবান তরুণ নেতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও কুৎসা রটনার চেষ্টা করে আসছে এবং তারা এখনো সক্রিয় রয়েছে।

খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, বিতর্ক ও সমাজসেবার প্রতি শেখ কামালের ছিল গভীর অনুরাগ। কিন্তু এই অমিত সম্ভাবনাময় তরুণের জীবনপ্রবাহ, চিন্তাচেতনা ও তার আদর্শ এবং স্বপ্নকে তরুণ ও যুবকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যতটা প্রয়োজন ছিল, ততটি কি আমরা পেরেছি? শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে জাতীয়ভাবে অনেক বেশি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা, নানামুখী জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম এবং তাঁর রাষ্ট্র ও সমাজদর্শন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাধিক ডিসিপ্লিনে গবেষণাকর্মও হতে পারে। যা হয়নি তেমন।

আমরা মনে করি তাঁর জন্মবার্ষিকী শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষটির চিন্তা-চেতনা, প্রতিভা ও আদর্শ তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই শেখ কামাল বেঁচে থাকবেন লাখো তরুণের হৃদয়ে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

ছবি: সংগৃহীত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৫ আগস্ট ২০২৩

© 2023, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button