জেলখানায় মোরগ-কবুতর পুষতেন বঙ্গবন্ধু
রাতের বেলা নৌকা চলছে। নৌকার ভেতর ঘুমিয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু।
হঠাৎ ডাকাত পড়েছে। এলাকার সবাই বঙ্গবন্ধুকে চেনে, তাকে ভালোবাসে। ডাকাতরা যখন জানতে পারল নৌকায় বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন তারা ডাকাতি না করেই চলে যায়। যাওয়ার সময় মাঝিকে এক ঘা দিয়ে বলল, ‘শালা, আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়!’
ঘুম থেকে উঠে ঘটনাটি শুনলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর মজা করে বললেন, ‘বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের মনে কতটা জায়গা করে নিয়েছিলেন সেটি বোঝা যায় তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ উল্লিখিত এই ঘটনাটিতে। এখানে তার রসবোধপূর্ণ হৃদয়ের পরিচয় মেলে।
কেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু? বন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করাটাকে মানতে পারতেন না বঙ্গবন্ধু। ‘পশুর চেয়েও তারা অধম’ বলে মনে করতেন। জেলখানায় মোরগ ও পাখি পুষতেন।
উদাহরণ তুলে ধরে ‘কারাগারের রোজনামচায়’ (১১৮ পৃষ্ঠায়) তিনি লিখেছেন, “আমার মোরগটা আর দুইটা বাচ্চা আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ঘাস থেকে পোকা খায়। ছোট কবুতরের বাচ্চাটা দিনভর মোরগটার কাছে কাছে থাকে। ছোট মুরগির বাচ্চারা ওকে মারে, কিন্তু মোরগটা কিছুই বলে না। কাক যদি ওকে আক্রমণ করতে চায় তবে মোরগ কাকদের ধাওয়া করে। রাতে ওরা একসাথেই পাকের ঘরে থাকে। এই গভীর বন্ধুত্ব ওদের সাথে। একসাথে থাকতে থাকতে একটা মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ অনেক সময় বন্ধুদের সাথে বেইমানি করে। পশু কখনো বেইমানি করে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পশুরাও বোধ হয় মানুষের চেয়ে একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ।”
কারাগারের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বন্দি জীবনের বন্ধু বলতে গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই আর কাকের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। বইটির ২২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আমগাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না… সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়।
“আমার ঘরটার কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়। বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু, যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই, তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে।”
শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে-শেখ মুজিবুর রহমান
কিশোর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধুর কষ্টসহিষ্ণুতার গুণ, দৃঢ়সংকল্প চরিত্র, লক্ষ্যে পৌঁছবার পণ এবং একইসঙ্গে মানবিক চিন্তাসমৃদ্ধ সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির পরিচয় মেলে। কোনো কাজেই তিনি ‘না’ বলতেন না। বলতেন, “কোনো কাজে সফল হতে হলে থাকতে হবে `Sincerity of purpose’ এবং `Honesty of purpose’। আর এই দর্শনটা তার ভেতর গ্রোথিত ছিল।
শোষকের হাতে শোষিতের নিপীড়ন ওই বয়সেও চোখ এড়ায়নি বঙ্গবন্ধুর। তার ভাষায়, “শোষিত যারা তাদের বড় আত্মপরিচয়ের অভাব, আত্মসচেতনতার অভাব। নিজেকে তারা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না, বুঝবে না, ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।”
তার বিশ্বাস ছিল ‘মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়। অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।’ বলেছিলেন, “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়, এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।”
বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তার জীবনের অনেকটা সময়ই জেলে কাটাতে হয়েছে। ফলে বঞ্চিত হয় তার পরিবার। পরিবারের প্রতি তার প্রবল টানও ছিল। কিন্তু সেটি ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছিল দেশ ও মানুষের সেবার কাছে।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন জাতির পিতা? স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেন, “শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।”
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। ব্যক্তি মুজিবের মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু তার আদর্শের মৃত্যু নেই। এই মহান নেতাকে জানলেই জানা হবে বাংলাদেশকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৫ আগস্ট ২০২৩
© 2023, https:.