ভুনজার সন্তানরা লেখাপড়া শিখছে শুধুই ‘ঠকে যাওয়া’ থেকে রক্ষা পেতে। কী সেই কারণ?
সময়টা ছিল আষাঢ়। রাত থেকেই ঝুম বৃষ্টি। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনেকের কাছে এটি ‘রহমতের দানা’। ফসলের জন্য চারদিকে চলছে মাঠ তৈরির কাজ। সবাই কাজে ব্যস্ত। সাতদিনের মধ্যেই চারা লাগাতে হবে। সময় খুব কম। তার ওপর লোকের অভাব। বেশি মজুরি দিয়েও মিলছে না মাঠের কাজের লোক।
নয়াদীঘির আজগর এখনও খুঁজছেন দুজন পাইট। স্থানীয়রা মাঠে কাজ করার শ্রমিকদের ‘পাইট’ বলে। স্বল্প সময়ে মাঠ তৈরিতে সবাই খুঁজে আদিবাসী পাইট। দিনাজপুরের স্থানীয়দের কাছে পাইট হিসেবে আদিবাসীদের বেশ কদর রয়েছে। তারা যেমন কর্মঠ তেমনি বিশ্বাসীও। সাধারণ সময়ে আদিবাসীরা নিজ থেকেই কাজ খুঁজতে গেলেও এ সময়টাতে পাইট খুঁজতে আজগরের মতো অনেকেই ছুটে যান আদিবাসী গ্রামগুলোতে।
গ্রামের নাম পিপল্লা। আজগরসহ যখন গ্রামটিতে পৌঁছি তখন মধ্যবিকেল। পাকা রাস্তা পার হয়ে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে এগোই। যতই গ্রামের দিকে এগুচ্ছি ততই ঢোল আর আদিবাসী গানের অন্যরকম সুর কানে ভেসে আসছে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে দরদ দিয়ে একদল আদিবাসী গাইছে, ‘হে ভগবান, পতিসে পাবনে সিতারাম, জেয় ভগবান।’
আজগর জানালো- ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক, এই তিন মাস যখন কাজ থাকে না তখন এ গ্রামের একদল আদিবাসী জীবিকার জন্য গান করে মন্দির ও বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে। তারই মহড়া চলছে তখন। দরদাম করে পারিশ্রমিক ঠিক করে পাইট হিসেবে আজগর খুঁজে পেলো মালতি আর হরিমহনকে।
মাঠে গিয়ে মেয়েরা আবার কী কাজ করবে? জানতে চাইলে মালতি বলে, ‘দাদা, কাদো (ধানের চারা) গারি, ঘাস বাচি’। সাঁওতাল ভেবে বললাম, ‘তোমরা নিশ্চয়ই সাঁওতাল?’ জাত রক্ষায় পেছন থেকে হরিমহন কিছুটা চেঁচিয়ে বলল, ‘না বাবু, হামারা ভুনজার জাতি।’
পিপল্লা গ্রামে বাস করে ৪৮টি আদিবাসী ভুনজার পরিবার। একটি বড় পুকুরের চারপাশ ঘিরে এদের বাস। এই গ্রামের ভুনজাররা এখনও সাঁওতাল, ওরাওঁ বা অন্য আদিবাসীদের মতো ততোটা অস্বচ্ছল নয়। ফলে পূর্বপুরুষদের সনাতন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হওয়ার প্রলোভন তাদের প্রভাবিত করেনি। কথা হলো গোত্রপ্রধান বিসুরা মণ্ডলের সঙ্গে। এ আদিবাসীরা তাদের গোত্রের প্রধানকে বলে ‘মণ্ডল’। তাই নাম বিসুরা হলেও গোত্রের প্রধান হওয়ায় সবাই ডাকে ‘বিসুরা মণ্ডল’ বলে।
বিসুরা জানায়, এ গ্রামের ভুনজারদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা আয়োজনে গোত্রের প্রধান হিসেবে প্রথা অনুসারে তাকেই পালন করতে হয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মণ্ডল ছাড়াও গোত্রে থাকে আরো বেশ কয়েকটি দায়িত্বশীল পদ। গোত্রে মণ্ডলের পরই মহতের স্থান। এছাড়া সবাইকে নানা খবর পৌঁছে দিতে রয়েছে ‘কোতয়াল’। আর অবাধ্য কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আছে ‘সিপাহি’ পদও।
এখানকার গোত্রে সিপাহি নকুল ভুনজার। তিনি জানান এ জাতির ‘বন্’ প্রথা নিয়ে। গোত্রপ্রধানের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে বা অবাধ্য হলে শাস্তিস্বরূপ ওই পরিবারকে ‘বন্’ দেওয়া হয়। তখন ওই পরিবারকে আগুন, পানিসহ কোনো কিছু দেওয়া ও নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ থাকে। এটাই ‘বন’।
পুকুরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ৯০ বছর বয়স্ক কুশিমন। এখানে কতদিন থেকে আছেন? জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর মিলল না। পাশ থেকে গাবলু ভুনজার বৃদ্ধের পাশে গিয়ে বলল, ‘কেতনা দিন এহাছে’। জানা গেলো, ভুনজারদের ‘খন্টা’ ভাষা ছাড়া এ বৃদ্ধা অন্য কোন ভাষা বুঝতে পারেন না। তিনি এখানে আছেন ব্রিটিশ আমল থেকেই।
অল্প বয়সী একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। নাম আরতী বালা। মাথায় ভরাট সিঁদুর। এক মাস আগেই নাকি বিয়ে হয়েছে তার। সবাই তাই জানালো। ভুনজারদের বিয়ের পর্বগুলো নিয়ে আলাপ উঠলে মেয়েটির মা উসিলা বালা আগ্রহ নিয়ে জানান চমৎকার সব তথ্য। এ আদিবাসীদের বিয়েতে কোন ব্রাহ্মণ নয়, বরং ডাকতে হয় ‘লোউরা’ বা নাপিতকে। তিনি বর ও কনের কনিষ্ঠা আঙুল কেটে সামান্য রক্ত নিয়ে আমপাতার মধ্যে ওই রক্ত এবং সামান্য আতপ চাল একসঙ্গে উভয়ের হাতেই বেঁধে দেন।
তারপর কনের শাড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় বরের ধুতি আর উভয়পক্ষের মণ্ডল এবং সবার উপস্থিতিতে বর-কনের চারদিকে পাঁচবার ঘুরে কনের কপালে সিঁন্দুর (সিঁদুর) পরায়। সিঁদুরের পরই শুরু হয় ভোজপর্ব। সারারাত চলে আদিবাসী নৃত্য ও প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া।
বিয়ের লেনদেন সম্পর্কে এ আদিবাসীদের বেশকিছু তথ্য জেনে অবাক হই। বাঙালি সমাজে প্রকাশ্যে বা গোপনে যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা থাকলেও ভুনজারদের বিয়েতে এখনও বরপক্ষকে পণ হিসেবে মেয়েপক্ষকে দিতে হয় ২৯ টাকা ও আধ মণ চাল। তাদের যেকোন অনুষ্ঠানে শূকর বা খাসির মাংস খাওয়ানো হলেও পছন্দের তালিকায় আছে বিজু, কুচিয়া (কুচ্ছা), মুসো (ইঁদুর), দুরা (কচ্ছপ), গোঙ্গা (শামুক) ও কোকড়া (কাঁকড়া) প্রভৃতি।
ভুনজাররা মনে করে এ প্রাণিগুলো খেলে অনেক দূরারোগ্য ব্যাধি থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। মালতির ভাষায় ‘বিজু খালে প্যারালাইসিস নে হোতে’ (বিজু খেলে প্যারালাইসিস হয় না)। হরিমহন ভুনজার বলে, ‘মুসো খালে পিলে নে হোতে’ (ইঁদুর খেলে ভুঁড়ি হয় না)। গোত্রের মণ্ডল বলেন, ‘কোকড়া খালে খেসরা নে হোতে’ (কাঁকড়া খেলে বসন্ত রোগ হয় না)। এ আদিবাসীরা মনে করে টাকার অভাবে দুধ খেতে না পরলেও কুচিয়া দুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
কথা হয় ধর্মান্তরিত হওয়া প্রসঙ্গে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, অনেক অর্থ পেলে তারা ধর্মান্তরিত হবে কিনা? জানতে চাইলে গোত্রের মণ্ডলের সাফ জবাব, ‘হবে না তো, কেনে হবে!’ কথা হয় যুবক বয়সী মানু ভুনজারের সঙ্গে। তার সব আনন্দ পূজা ঘিরে। সে জানায়, হিন্দুধর্মের প্রায় সব পূজাই ভুনজাররা উদযাপন করে। তবে ভাদ্র মাসে কালিপূজার ছয়দিন পর তারা পালন করে একটি বিশেষ ধরনের পূজা। তাদের ভাষায়, ‘সুর্যা হু পূজা’।
এ পূজার তিনদিন আগ থেকে পবিত্রতার সঙ্গে থাকতে হয় উপোস। উপোস অবস্থায় দুধ-কলা ছাড়াও খাওয়া যায় বিনা লবণে আতপ চালের ভাত। আদিবাসী ভাষায় এটি ‘খির’। পূজার দিন সকালে সূর্য উঠার সময় নদীর মধ্যে কোমর পানিতে নেমে সূর্যকে ভোগ দিয়ে প্রার্থনা করে তারা। এ আদিবাসীদের বিশ্বাস এ পূজার মাধ্যমে একইসঙ্গে সূর্য ও গঙ্গার আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
সামরি বালার বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল পূজার স্থান ও দেবতা। সে জানায়, এটি তাদের দৈনন্দিন দেবতা বিশহরি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পূজা দেয় সে। তার বিশ্বাস পূজা না করে পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে একসময় অনেকেই স্বপ্নে ভয়ংকর সাপ দেখতে পায়। সামরির মতো ভুনজাররা এখনো ‘ভূতে’ বিশ্বাস করে। বাড়িতে কারো পেটের ব্যথা বা বমি হলেই বলতে থাকে ‘ভূতে ধরলেছে’। আর এর জন্য ঝাড়ফুঁকই তাদের একমাত্র চিকিৎসা।
অন্য আদিবাসী জাতির মতো ভুনজারদেরও একসময় ছিল শত শত বিঘা জমি। তারা অধিকাংশ ছিল সহজ সরল। দলের মণ্ডল জানায়, ব্রিটিশ আমল থেকে তারা এখানে থাকলেও তাদের অধিকাংশ জমিই আজ অন্যের দখলে। প্রায় সবাই এখন ভূমিহীন। কিছু জমি নিয়ে চলছে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধও। আর সে কারণেই প্রায়ই পেতে হয় প্রাণনাশের হুমকি।
হরিমহনের বক্তব্য একটু ভিন্ন। সে মনে করে মূর্খতাই আদিবাসীদের জমি বেদখল হওয়ার অন্যতম কারণ। তার ভাষায়, ‘হামনির জমি জোর করে মানসে লেলেল কে, হামনি মূর্খ গতিকে মানসে লেলেল কে’। তাই দুই ছেলেকেই সে লেখাপড়া শিখাচ্ছে। বড় কোন স্বপ্নে নয়, তার বিশ্বাস ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখলে তাদের জমি আর অন্য কেউ বেদখল করে নিতে পারবে না, ঠকাতেও পারবে না। হরিমহন বলে ‘পড়ালেখা করলে আর ঠোকাল নে পারতে।’
ফেরার পথে বারবার কানে বাজছিল হরিমহনের কথাগুলো। একই দেশে কোন জাতির সন্তানরা লেখাপড়া করছে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে, আর অন্য জাতির সন্তানরা লেখাপড়া করছে শুধুই ঠকে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে। এই বৈষম্য নিয়েই কি এদেশে বড় হতে থাকবে আদিবাসী সন্তানরা? আমরা কি কখনও পাবো বৈষম্যহীন সমাজ?
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৭ নভেম্বর ২০২৩
© 2024, https:.