এখনও আদিবাসীদের ভাষাগুলো বর্ণময়তা পায়নি, বরং অন্যান্য ভাষার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে।
বহবলদিঘীর কথা বলতেই এক বৃদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। খানিক চিন্তা করে মুচকি হেসে দেখিয়ে দেন দক্ষিণমুখো রাস্তাটি। পাকা রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ। সব সময়ই ছায়াঘেরা থাকে রাস্তাটি। এখানকার লোকেরা বহবলদিঘীকে বলে ‘বগলডিগী’, দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম এটি।
রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুধুই ধানক্ষেত। সোনালী-সবুজ রঙের থোকা থোকা ধান ঝুলছে। ধান কাটার দিন গুণছেন কৃষকরা। ফলন ভালো হওয়ায় সবার মুখেই আনন্দের হাসি। গোটা বহবলদিঘীতেই নানা ভাষাভাষী আদিবাসীদের বাস। ফলে এখানে সারা বছর চলে আদি মানুষদের জীবন, সংস্কৃতি ও ধর্ম প্রবাহের নানা আনুষ্ঠানিকতা। আর এ কারণেই বহবলদিঘী ‘আদিবাসী গ্রাম’ হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ছোট্ট চায়ের টং দোকানে কয়েকজন আদিবাসী বৃদ্ধের দেখা মিলল। বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছেন তারা। চায়ের সঙ্গে চলছে নানা গল্প-গুজব। ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলা আর অপরিচিত ভিন্ন এক ভাষায় কথা বলছেন তারা। ‘জোহার’ (নমস্কার) বলেই বসতে অনুরোধ জানান তারা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাদের সঙ্গে চলে আলাপচারিতা।
জানা গেল এখানে বাস করে সাঁওতাল, কড়া, ওরাওঁ, মুন্ডা, মাহালী আর ভুনজার জাতির আদিবাসীরা। বাংলা বলতে পারলেও জাতিভেদে এরা নিজেদের মধ্যে পৃথক পৃথক ভাষায় কথা বলে। এক জাতির ভাষার সঙ্গে অন্য জাতির ভাষার খানিকটা মিল থাকলেও অধিকাংশ ভাষাই স্বতন্ত্র।
চার বছরের উপেল কড়া চা খেতে এসেছে দাদার সঙ্গে। নাম জানতে চাইলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পাশ থেকে কৃষ্ণ ‘কড়া’ ভাষায় বলে, ‘তোর নাম কয়েন লাগলো’। নিজের ভাষায় কথাগুলো বুঝতে পেরে বাচ্চাটি তার নাম জানাল। পাশে বসা ওরাওঁ গ্রামের নিপেন টিগগা বাক্যটিকে তার কুরুক ভাষায় বলল এভাবে- ‘নিহাই নাম এন্দ্রা’। মনে পড়ে যায় চাকমাদের কথা। ‘তোমার নাম কী’ বাক্যটিকে চাকমা ভাষায় বলে ‘ত নাং কী’, মারমারা বলে ‘না নামে জালে’, গারো ভাষায় এটি ‘নাংনি বিমুং মাই’ আর রাখাইনরা বলে ‘মা নামে জালে’।
চা শেষ করে আমরা পা রাখি রাস্তার পাশের সাঁওতাল পাড়ায়। পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এখানকার আদিবাসীরা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে তীর ধনুক নিয়ে শিকারের উদ্দেশে বের হয় সীমান্তবর্তী গহীন শালবনে। বনে প্রবেশের আগে তারা শিকারী ভূত বা জঙ্গল দেবতা বা দানো ভূতকে পূজা করে থাকে। তাদের বিশ্বাস এতে অধিক শিকারসহ বনের ভেতরের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ সময়টাতে আদিবাসী গ্রামগুলোতে চলে খ্যামটা বা ঝুমের নাচের আসর। রাতভর চলে প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। কথার ফাঁকে প্রিয় শিকারগুলোর নাম জানতে চাইলে সাঁওতাল গ্রামে সানজিলা হরহর করে বলতে থাকে নাম- মুসা (ইদুর), কুলাই (খরগোশ), সগট (খাটাস), বিজু (বেজি), ঘুঘু ও মায়না (ময়না)।
সমতলের প্রায় সব আদিবাসীর পছন্দের শিকার একই হলেও শুধু ভাষার ভিন্নতার কারণে এদের শিকারগুলোর নামও ভিন্ন হয়। যেমন মুন্ডারা খরগোশকে তাদের ভাষায় বলে ‘লাম্ভা’, ওরাওঁরা বলে ‘খেড়া’ আর মাহালীরা ‘কুলেই’। একইভাবে আদিবাসী ভুনজাররা ইঁদুরকে বলে ‘মুসো’। তাদের খুব প্রিয় খাবার শামুক। অন্যান্য জাতির ভাষায় এটি ‘ঘুংঘি’ হলেও ভুনজারদের ভাষায় এটি ‘গোঙ্গা’।
সাঁওতাল গোত্রের মহত দালু সরেন বলেন, অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তারাও তাদের জাতির ভাষা শিখেছেন শিশু বয়স থেকে পরিবার ও গোত্রের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে। আদিবাসী ভাষায় মায়ের ঘুমপাড়ানি গান আর বাবার আদরের ভাষা শুনতে শুনতেই তারা তা রপ্ত করে ফেলে। লিখিত কোন বর্ণ না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এভাবেই মৌখিক ভাষায় তৈরি হয়েছে আদিবাসী গল্প, গান, গীত, ছড়া আর নানা রূপকথা- যা তাদের কাছে এখনও জীবন্ত হয়ে আছে।
সাঁওতাল গ্রামের পাশেই কড়া আদিবাসীদের বাস। কড়া গোত্রের সুনিয়া ‘কড়া’ ভাষায় গুনগুন করে গাইতে থাকেন ঘুমপাড়ানির গান। ঠিক এভাবে ‘নিন্না নিন্নারে নুনু, মায়ে গেল সুইহা বোচল, দাদি কান্দা বুলো হে, বাপ গাড়ি মান’ (ছোট বাবু ঘুমিয়ে পড়, তোমার মা গেছে সুই বেচতে, দাদি কাঁদছে আর বাবা গেছে গাড়ি চালাতে)।
ক্রমেই আদিবাসীরা তাদের ভাষায় নানা শব্দের আসর জমিয়ে তোলে। আদিবাসীরা খালাকে ‘মুসি’ বললেও খালুকে ডাকে ‘মোসা’ বলে। মাকে মুন্ডারা ‘মায়ে’, মাহালীরা ‘মাই’, ওরাওঁরা ‘ইয়ো’ আর কড়ারা বলে ‘মেয়া’। একইভাবে বাবাকে ডাকে ‘বাপ’ বা ‘বাপা’ বা ‘বা’ বলে। ক্রমেই মজার মজার শব্দ আবিষ্কারে বিভোর হতে থাকি। গ্রামকে মুন্ডারা বলে ‘গাও’, ওরাওঁরা ‘পাদ্দা’, কড়ারা ‘গা’ আর মাহালীরা বলে ‘আতো’।
আবার প্রায় সব আদিবাসী চামচকে বলে ‘কালসুর’। ধানকে আদিবাসীরা ‘ধন’ বা ‘ধান’ বললেও ওরাওঁ ভাষায় বলে ‘খেস্সে’। আবার ডিমকে মুন্ডারা ‘আড়া’, ওরাওঁরা ‘বি’ এবং কড়া আদিবাসীরা বলে ‘ডিমা’। মাছকে অধিকাংশ ‘মাছড়ি’ বললেও ওরাওঁ ভাষায় এটি ‘ইনজো’। নদীকে তারা ‘নাদি’ বা ‘নেদি’ বললেও মাহালীরা বলে ‘গাড়া’। একইভাবে গরুকে গরু বললেও ওরাওঁদের কাছে এটি ‘আড্ডো’।
চাঁদ ও সূর্য আদিবাসীদের দেবতা। তাদের নিয়ে রয়েছে নানা কল্পকাহিনি। চাঁদকে সাঁওতাল ভাষায় বলে ‘ইন্দাচান্দু’, মুন্ডা ভাষায় ‘চান্দ’, ওরাওঁ ভাষায় ‘চান্দু’ আর কড়া ভাষায় বলে ‘চান’। একইভাবে সূর্যকে সাঁওতালরা বলে ‘নিং চান্দু’, মুন্ডারা ‘বেলা’, ওরাওঁরা ‘বিড়ি’ আর কড়ারা বলে ‘বেড়া’। মানুষকে মুন্ডা ও কড়া ভাষায় ‘আদমি’, সাঁওতাল ভাষায় ‘হড়’, ওরাওঁ ভাষায় ‘আলায়’ বলে।
আদিবাসী ভাষার বিশাল শব্দভাণ্ডার ফেলে দালু সরেনকে নিয়ে ফিরে আসি বহবলদিঘীর রাস্তায়। জানা গেল ‘বহবল’ নামক একটি দিঘীর নামেই গোটা গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছে। দিঘী দেখতে খানিক এগুতেই একদল আদিবাসী ছেলেমেয়েদের হট্টগোল চোখে পড়ল। সবার পরনে স্কুল-ড্রেস। ভয়ে ভয়ে নাম জানালো সুদেব পাহান, বিপাশা বাছকি, নির্মল হেমব্রন আর কল্পনা সরেন। সবাই ফিরছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে।
ভাষা নিয়ে সুদেব পাহানের সঙ্গে কথা বলে ব্যথিত ও লজ্জিত হই। বিদালয়ের প্রথম শ্রেণিতে যখন সে ভর্তি হয় তখন মায়ের মুন্ডা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানত না। নিজের মাতৃভাষায় পড়তে না পেরে সুদেবের শিশুমনে দাগ কাটে। সুদেব জানায়, তার স্কুলে কোন আদিবাসী শিক্ষক না থাকায় ভালোভাবে বাংলা ভাষা বুঝতে, পড়তে ও লিখতে তার প্রায় বছরখানেক লেগেছিল। নিজের মাতৃভাষা ছেড়ে অন্য ভাষা শেখার ভীতিতে বহুদিন সে স্কুল পালিয়ে পাশের শালবনে লুকিয়ে থাকত। তার জীবনকথা শুনে মনে পড়ে যায় আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা। রক্তে দিয়ে এদেশে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব হলেও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না অন্য জাতির মাতৃভাষাগুলোকে। এ যেন প্রদীপের নিজের অন্ধকারের মতো।
ভাষাগত বৈচিত্র্যের কারণ নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে নানা ধারণাও প্রচলিত আছে। তারা মনে করে, মানব সন্তানের জন্ম শুধু পৃথিবীর একটি অংশে হয়নি। ভিন্ন ভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানে জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণেই মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে নানা প্রকাশভঙ্গির। আর এই প্রকাশভঙ্গিই পরবর্তীতে ভাষায় রূপান্তরিত হয়। সাঁওতাল গ্রামের দালু সরেনের বিশ্বাসও প্রায় একই।
আদিকালে মানুষ একটি স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করেনি। খাদ্য সংগ্রহ, শিকার আর চাষাবাদের জন্য মানুষ দলবেঁধে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়াত। আর তখন এই দলগুলোর সদস্যদের মধ্যে নানা প্রয়োজনে তৈরি হতো এক রকমের প্রকাশভঙ্গির, এক ধরনের ভাষার। এভাবেই জাতিভেদে আদিবাসীদের নানা ভাষার উদ্ভব ঘটে। সাঁওতাল ভাষার কোন লিখিত বর্ণমালা না থাকলেও এই ভাষাকে লিখিত রূপ দেওয়া, অভিধান তৈরি করা, পুস্তক রচনা ও লোককাহিনি সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে খ্রিস্টান মিশন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালী ভাষার ওপর ‘অলচিকি’ নামক বর্ণমালাও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তার তেমন প্রসার ঘটেনি।
দিঘীর কাছে এসে দেখা মিলল মধ্যবয়সী আব্রাহাম হাজদার সঙ্গে। শিক্ষিত এই যুবক মাহালী জাতির মহত। নিজের জাতির ভাষা নিয়ে জানায় নানা তথ্য। ভাষাগত দিক থেকে মাহালী আদিবাসীরা অস্ট্রিক ভাষার অনুসারী। বলা হয় অস্ট্রিক ভাষাই বাংলা ভাষার ভিত্তি স্থাপন করেছে। এই ভাষার অসংখ্য শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতে মুন্ডারী ভাষাকেও এই ভাষার প্রধান শাখা হিসেবে ধরা হয়, যা দীর্ঘদিন ধরে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, কোরওয়া, জুয়াং, কোরবু প্রভৃতি জাতি ব্যবহার করে। মাহালী ভাষার লিখিত কোন বর্ণ না থাকলেও ইদানিং কিছু প্রতিষ্ঠান মাহালী ভাষা লেখার নিয়ম উদ্ভাবন করেছে। সে হিসেবে মাহালী ভাষায় ৪০টি বর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি স্বরবর্ণ ও ৩৫টি ব্যঞ্জনবর্ণ। কিন্তু বাস্তবে মাহালীদের ভাষার সঙ্গে তা পুরোপুরি মিলে না।
ভাবের বাহন ভাষা। ভাষাকে ধরে রাখার জন্য বর্ণের আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এখনও আদিবাসীদের ভাষাগুলো বর্ণময়তা পায়নি। বরং অন্যান্য ভাষার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে আদি ভাষাগুলো। আদিবাসী গ্রাম থেকে যখন ফিরছি তখন চারদিকে নিঝুম অন্ধকার। আকাশে অজস্র তারার মেলা। হঠাৎ চোখের সামনেই নিঃশব্দে খসে পড়ে একটি তারা। দূর থেকে ভেসে আসে আদিবাসীদের গান আর বাদ্যি। মনের ভেতর তখনও ঘোরপাক খায় বর্ণহীন ভাষাগুলোর ছন্দ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩
© 2024, https:.