একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকাই আমাদের বীরত্বের সূচক
কিলো ফ্লাইট নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধাভিযানের ইতিহাস। দুঃসাহসিক ওই অভিযানের এক অগ্রসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম বীর উত্তম।
“আমি তখন কলকাতায়, ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকার। আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একটি বিমানে ওঠেন। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন? বললেন না।
নামলাম একটি পরিত্যক্ত রানওয়েতে। চারপাশে জঙ্গল ও পাহাড়। ওখানে এয়ারফোর্সের আরও দুজন বৈমানিককে পাই। তারা হলেন, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম। আরও ছিলেন পিআইএরও বৈমানিক ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকি, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন সাহা, ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন সফরুদ্দিন।
জায়গাটার নাম ডিমাপুর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি ওটা। কিন্তু সেখানে কেন আসলাম? তখনও কিছুই জানি না। পরদিন সকালে খন্দকার সাহেব বললেন, আজকে একজন গুরুত্বপূর্ণ গেস্ট আসবেন। তখন সবকিছু জানতে পারবে। সকাল ১০টার দিকে একটা ডাকোটায় আসলেন একজন। কে জানেন? এয়ার ভাইস মার্শাল পিসি লাল, চিফ অব এয়ার স্টাফ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স।
তাকে একটা ছোট্ট গার্ড অব অনার দিলাম আমরা। তিনি বললেন, ‘আমরা তিনটা এয়ার ক্রাফট জোগাড় করেছি। এ তিনটা আপনারা যেভাবে ব্যবহার করতে চান করতে পারবেন।’
তারা দিয়েছিল একটা ডাকোটা ডিসি থ্রি পরিবহন বিমান, একটি অর্টার বিমান এবং আরেকটি অ্যালুয়েড হেলিকপ্টার। কিন্তু কোনোটিই যুদ্ধ বিমান ছিল না। সবগুলো ছিল সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট। যা দিয়ে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব।
আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্টারের। হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। আর ডাকোটা ডিসি থ্রি বিমানটি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন খালেদকে। সবাই অভিজ্ঞ পাইলট। তবুও তৃতীয় দিন থেকেই বিমানগুলো নিয়ে ফ্লাইং শুরু করি।
ছিলাম টিম লিডার ফর অর্টার। আমার নম্বর টু। সঙ্গে দুজন– ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ট্রেনিং। এরপর হয় নেভিগেশন। মানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। আমরা নয় ঘন্টার নেভিগেশনও করেছি। জানতে চাইতাম এত লম্বা ফ্লাইং কেন করাচ্ছেন? ওরা শুধু বলত, ‘হাই কমান্ডের নির্দেশ’।”
কিলো ফ্লাইট গ্রুপের ট্রেনিং প্রসঙ্গে এভাবেই বলছিলেন বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম।
আব্দুল ওয়াহেদ তালুকদার ও শামসুন নাহার বেগমের প্রথম সন্তান তিনি। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পাতিলাপাড়ায়। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বাউফলেই, নানার বাড়িতে। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে জয়েন করেন ১৯৬৪ সালের জুন মাসে। এর পর ট্রেনিংয়ের জন্য চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে, পিএ একাডেমি রিসালপুরে। ট্রেনিং শেষে মাত্র ২৬ স্টুডেন্ট পাস আউট করেন, যার মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুজন– তিনি ও স্কোয়াড্রোন লিডার নূরুল কাদের। পরে পাইলট অফিসার হিসেবে পোস্টিং হয় করাচিতে।
আলাপচারিতায় ফিরি একাত্তরে। প্রশ্ন রাখি ভারতীয় ওই বিমানগুলো দিয়ে কীভাবে অপারেশন করলেন?
তিনি বলেন, “হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট দুটোকে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স বেইস জোড়হাটে। ওখানে ওগুলোকে পুরোপুরি যুদ্ধ বিমানের রূপ দেওয়া হয়েছিল।
অর্টারের দুইদিকে দুটি উইংয়ে রকেট লাগানো। ডান দিকে সাতটা, বাঁ দিকে সাতটা। ডানদিকের দরজাটা খোলা। সেখানে একটা টুইন ব্যারেল ব্রাউনিং গান ফিট করা। ভেতরে পেটটা কেটে সেখানে সেট করা তিনটা বোম র্যাক। একেকটা বোম র্যাকে ৪টা করে মোট বারোটা বোম লাগানো। ২৫ পাউন্ডের একেকটা বোম, যা বিশেষ ধরনের এবং মূলত আগুন জ্বালাতে সাহায্য করবে।”
এরপরই যুদ্ধের কায়দায় ট্রেনিং শুরু হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয় সব ট্রেনিং। কিন্তু টার্গেট কী? তারা তখনও জানেন না। হঠাৎ জোড়হাটে যাওয়ার একটা মেসেজ আসে। সেখানে গিয়েই কিলো ফ্লাইট অপারেশনের নির্দেশ পান সবাই।
তার ভাষায়, “আমাকে বলল, ‘ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলম। তোমার টার্গেট হলো টু ডিসট্রয়েড চিটাগাং অয়েল রিফাইনারি। টার্গেট ডেট ২৮ নভেম্বর।’
তারা আরও জানাল, ‘চিটাগং বিমানবন্দরের রানওয়ের ঠিক পাশেই ওটা। রানওয়েতে ওদের কাছে কোনো এ কে গান (যা দিয়ে এয়ারক্রাফটে ফায়ার করা হয়) নেই। ফলে খুব নির্ভয়েই অপারেশন করা যাবে।’
সুলতান মাহমুদের টার্গেট দিল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেন, ইউএসএসও’র তেলের ডিপো ধ্বংস করা। নির্দেশনা নিয়ে ডিমাপুরে ফিরে আসলাম। সাতদিন পর আবার ডাকল। এবার টার্গেট টাইম ঠিক করে দিল। সবার টার্গেট টাইমটা ছিল একই, রাত বারোটা এক মিনিটে।
আমরা ছিলাম সুইসাইডাল গ্রুপ। ফিরে আসব কিনা জানি না। আমি ক্যাপ্টেন, কো পাইলট হলেন ক্যাপ্টেন আকরাম। বোম ফেলবেন সার্জেন্ট হক আর এয়ার গানার ছিলেন রুস্তম আলী। মোট চারজন। সঙ্গে নিলাম আরও দুজন টেকনিশিয়ানকে।
২৬ নভেম্বর ডিমাপুর ছেড়ে কৈলাশহর চলে যাই। মিলিটারি ভাষায় এটাকে বলে ফরোয়ার্ড এয়ার বেইস। সেখানে একটা তিনহাজার ফিট ছোট্ট রানওয়ে আছে। ওখানেই যাই অর্টারটা নিয়ে। পাশেই তেলিয়ামোড়া। ওখান থেকে হেলিকপ্টারে টেকওভার করবেন সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম।
২৮ নভেম্বর। আমরা প্রস্তুত। বিকেল ৪টা বা সাড়ের ৪টার দিকে একটা মোটর সাইকেলে আসেন ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের এক ফ্লাইং অফিসার। বললেন, একটা মেসেজ আছে। এটা পড়ে ফেরত দিতে হবে। খুলে দেখলাম লেখা– ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট ক্রু, ইউর কিলো ফ্লাইট মিশন ইজ সাসপেন্টেড টুডে। উই শ্যাল ইনফর্ম ইউ আওয়ার নেক্সট বুলেটিন।’
অপেক্ষায় থাকলাম। ৩ ডিসেম্বর বিকেল তখন ৫টা। মোটরসাইকেলে ওই অফিসার আবার আসলেন। এবার তার সিগন্যাল ম্যাসেজে লেখা এমন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, কনগ্রাচুলেশন। ইউর ওয়েটিং ডেজ আর ওভার। টু ডেইস ইজ দা ডে ফর ইউর ফাইনাল অ্যাটাক। অল আদারস ব্রিফিং উইল এজ বিফোর।’
সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের বললাম, এয়ারক্রাফট তৈরি করো। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চারজন ঢুকলাম প্লেনে। সবাই সবার সাথে হাত মেলালাম। রাত পৌনে আটটার দিকে আমরা টেকঅফ করি।”
কীভাবে অ্যাটক করেন? কোন বাধার মুখে কি পড়েছিলেন?
শামসুল আলম আদ্যোপান্ত বলেন যান। “প্রথমে এক হাজার ফিট উচুঁতে ফ্লাই করি। এরপর ৫০০ ফিট, এভাবে ২০০ ফিটে নেমে আসি। আস্তে আস্তে উচ্চতা কমাচ্ছিলাম যাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার ধরতে না পারে। বে অব বেঙ্গল দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন চাঁদ উঠেছে। আমি বলব, শুক্লা সপ্তমীর চন্দ্র। নিচে চকচকা পানি দেখা যাচ্ছে। প্লেনটা তখন ৫০ ফিট নিচ দিয়ে চলছে।
তখন রাত ১২টা পার হয়ে যাচ্ছে। এয়ার ক্রাফটটা আস্তে আস্তে উঁচুতে ওঠালাম। নিচে দেখলাম চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়। পাশেই ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারি। সারি সারি আলো জ্বলছে সেখানে। প্লেনটাকে একটা চক্কর দিয়েই ফার্স্ট টার্গেটে দুটো রকেট ফায়ার করি। দুই জায়গাতে হিট করল। কিন্তু কোনো এক্সপ্লোশন হলো না। দ্বিতীয় আরেকটা হিট করলাম। কিন্তু এবারও এক্সপ্লোশন নেই। বেশ অবাক হলাম। তৃতীয় হিটটি করতে যাবো তখনই এয়ারপোর্ট থেকে এ কে গান দিয়ে পাকিস্তানিরা সমানে ফায়ার শুরু করে। বুঝে যাই ইনফরমেশন ভুল ছিল। ওদের কাছে এ কে গানও আছে।
তখনও আমি টার্গেটে অটল। দুটো রকেট হিট করে টার্ন করছি অমনি বিশাল শব্দে রিফাইনারির একটা ট্যাংক এক্সপ্লোশন হলো। আরও ৪ থেকে ৬টি রকেট ফায়ার করি। দেখলাম নিচে শুধু আগুন আর আগুন। আনন্দে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠি। অনেক দূর থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহানি শিখা।
প্রায় পৌনে নয় ঘন্টা ফ্লাইংয়ে ছিলাম আমরা। ইতিহাসে এটা ছিল সবথেকে দীর্ঘ মিলিটারি অপারেশন। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও কেউ নয় ঘন্টা ফ্লাই করে টার্গেট ডে সট্রয় করে নাই। ওটা আমরাই রচনা করেছিলাম। যা ঘটেছিল কিলো ফ্লাইট অপারেশনে।
হিট করে ফিরে ল্যান্ড করি কুমরিগ্রামে। সাড়ে চারটা বাজে তখন। যখন নামি তখন দেখি গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের রিসিভ করার জন্য। মানুষটি ৬ ফিটের মতো লম্বা। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুলে বললেন, ‘বয় ওহ বয়, ইউ হ্যাভ ডান ইট’।”
ওই অপারেশনের ইমপ্যাক্ট কতটা ছিল?
এ বীর উত্তম অকপটে বলেন, “অ্যাটাকের খবরটি বিবিসিসহ বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হতে থাকে। কিলো ফ্লাইট অপারেশনের ফলেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তেল সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে তেল সরবরাহেরও সুযোগ ছিল না তাদের। পরে আরও বিশটির মতো বিমান অপারেশন করি আমরা। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়ে।”
কিলো ফ্লাইট নামকরণের অন্তর্নিহিত কারণ তুলে ধরে শামসুল আলম বলেন, “অন্যান্য গ্রুপগুলো তার কমান্ডারের নামে হয়েছে। আমরাও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার সাহেবের নামেই এর নামকরণ করতে চেয়েছি। ‘কে’ দিয়ে যেহেতু খন্দকার হয় তখন এর নাম দেওয়া হলো কিলো ফ্লাইট। ‘কে’ ফর কিলো। আর ‘ফ্লাইট’ হচ্ছে বিমানের ভাষায় স্কোয়াড্রন থেকে ছোট একটা বহর।”
শামসুল আলম যখন পশ্চিম পাকিস্তানে তখন সেখানে কি ঘটছিল?
তিনি বলেন, “২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যায় নামে পাকিস্তানি সেনারা। তখন আমি রাওয়ালপিন্ডিতে। বিসিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিওর খবরে গণহত্যার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এর মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা বাঙালি বৈমানিক সবার ফ্লাইট বাতিল করে গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়।”
তখন কী করলেন?
ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলমের উত্তর, “এপ্রিলেই বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু সুযোগ হয়নি। কী করব আরও ভাবছি। মে মাসে ছুটির আবেদন করি করাচি যাওয়ার। ওখানে কয়েকদিন ঘুরে আসতে চাই। কারণ বিবেচনা করে সাতদিনের ছুটিও মঞ্জুর হয়।
দুটো টিকিট কাটলাম। রাওয়ালপিন্ডি টু করাচি, করাচি টু রাওয়ালপিন্ডি। করাচি গিয়ে অফিসার্স মেসে উঠলাম। কয়েকদিন খুব ঘুরে বেড়ালাম। এদিকে ঢাকায় যাওয়ার টিকিট খুঁজছি। বহুকষ্টে এক বন্ধু একটি টিকিট কিনে আনে। যেদিন রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে যাওয়ার কথা ওইদিনই এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকার বিমানে চড়ে বসি। মূলত এটাই ছিল আমার প্ল্যান। বর্ডার দিয়ে চোরের মতো না গিয়ে রাজার মতো দেশে চলে যাব। একাত্তরের জুন মাসের ৩ তারিখ বিকেল ৪.৫৫ মিনিটে পিএআই-এর ফ্লাইটে ল্যান্ড করি ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে।”
ঢাকায় এসেই গ্রেফতার হন শামসুল আলম। অতঃপর তার ওপর চলে নিদারুণ ও অমানবিক নির্যাতন। সেসব কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হন তিনি।
তার ভাষায়, “একটা গাড়িতে তারা আমাকে তুলে ক্যান্টনমেন্টের এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। ওখানে একটা ছোট্ট রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। খুব অন্ধকার রুমটায়। গাদাগাদি করে অনেক লোক মেঝেতে শুয়ে আছে। মিট মিট করে একটা হারিকেন জ্বলছে। এক কোণা থেকে একজন (পরে জেনেছি উনি মেজর আওলাদ) হাত দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে শুয়ে পড়তে বলে। আমি তাই করি।”
এরপরই কি টর্চার শুরু করে?
“হ্যাঁ। অনেকক্ষণ পর দরজায় আওয়াজ।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম সাব কোন হে?
উঠে দাঁড়ালাম, সামনে গেলাম।
‘আপ বাহার লিকে’
বাইরে গেলাম। রাত তখন। চারপাশে খানিক চাঁদের আলো। হেটে যাচ্ছি। এমন সময় পেছন থেকে এক সোলজার লাঠি দিয়ে দারাম করে একটা বাড়ি মারে। পড়তে গিয়েও পড়লাম না।
বলে, ‘বানচোদ, সামনে দেখ।’
সামনে আরও আট-দশজন সোলজার। চাঁদের আলোতে মুখগুলো মোটামুটি দেখা যায়। ভেরি ইয়াং। বয়স ২৪-২৬ হবে।
ওরা অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। ক্রমাগত সব উত্তর দিচ্ছি।
হঠাৎ একজন বলল, ‘আর কত প্রশ্ন করবি।’
বলেই সে আমার পিঠে লাঠির বাড়ি দিতে থাকে। সবাই মিলেই মারছে। শক্তি তখনও অনেক। সব সহ্য করেও দাঁড়িয়ে থাকি।
ওরা মারছে আর বলছে, ‘শালা শেখ মুজিবকা বাচ্চা।’
শেখ মুজিবের ছেলে বা সন্তান আমি! শুনে কেন জানি ওই মারটাই আমার কাছে গর্বের হয়ে ওঠে। আজ পর্যন্ত যার জন্য আমি গর্ববোধ করি। এই অনুভূতিটা ঠিক বলে বোঝাতে পারব না।
ওই রুমে অনেক সিনিয়র অফিসাররা ছিলেন। কেউ স্কোয়াড্রন লিডার, কেউ মেজর। তিন মাস আগেই ধরে এনেছে তাদের। শমসের মবিন চৌধুরীও ছিলেন। সবার ওপরই নির্যাতন চলত। প্রত্যেক সন্ধ্যায় ওরা পেটাতে আসত। এটা ছিল একটা রুটিন। মাসখানেক এভাবেই নির্যাতন চলে। তখন শুধু মৃত্যুর প্রহর গুণতাম।
শেষ পর্যন্ত কি আপনাকে ওখানেই রেখেছিল?
তিনি বলেন, “না। জুলাই মাসে একদিন চোখ বেঁধে জিপে তুলে নেয়। ভাবলাম, হয়তো গুলি করে শেষ করে দেবে। ক্রিসেন্ট লেকে ঢুকতেই বাঁ দিকের প্রথম বাড়িটায় নিলো। এখন ওটা পার্লামেন্ট ভবনের বিল্ডিংয়েরই অংশ। তখন ওটা ছিল সেন্ট্রাল ইন্টারোগেশন সেন্টার। চোখ খুলতেই জায়গাটা চিনে ফেলি।
রাতের দিকে পাকিস্তানি আর্মির এক মেজর আসে। তিন-চারটা সাদা কাগজ আর কাঠপেন্সিল এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার স্টেটমেন্টটা একটু লেখো। আমরা জানতে চাই তুমি কেন পালিয়ে এসেছিলে? কী তোমার উদ্দেশ্য? কী তোমার আদর্শ? কারা তোমাকে সাহায্য করেছে আসার জন্য? তোমার প্ল্যান কী ছিল?
সত্য কথা লিখলে তোমাকে রিলিজ করে দেব।’ বলেই চলে গেলেন।
অনেক চিন্তা করে লিখলাম এমন, ‘২৫ মার্চের ঘটনার পর খুব আপসেট হয়ে গেছি। বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। এত উতালা হই যে চলে আসছি। ছুটি তখন দিচ্ছিল না। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি, বাবা-মা, ভাই-বোনদের দেখার জন্য।’
সকালে মেজর আসে। স্টেটমেন্টটা পড়েই ছিড়ে ফেলে বলে, ‘বাকোয়াজ লিখছো’।
এভাবে তিনদিন একই কথা লিখলাম।
চর্তুথ দিন এসে বলল, ‘তুমি আজ থেকে সব কাপড় খুলে ফেলবে। নেকেড হয়ে থাকবে’।
গায়ে একটা পাঞ্জাবি ছিল, খুলে ফেললাম। ওখানে বসা বা শোয়ার উপায় ছিল না। শুধুই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এরপর আবারও কাগজ দিল। একই জিনিস লিখলাম। ছিড়ে ফেলল।
তখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। খুব ক্লান্ত লাগছে। ধরেই নিয়েছি মারা যাবো।
ওইসময় আরেকটা কাগজ চেয়ে নিলাম। এরপর বহু চিন্তা করে নিজেই লিখলাম নিজের ডেথ ওয়ারেন্ট এভাবে, ‘আই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, পাক-৪৯২১ কেম টু ইস্ট পাকিস্তান উইথ এন ইনটেনশন টু জয়েন ফ্রিডম স্টাগল।’ নিচে নাম লিখে সিগনেচার দিয়ে দিলাম।
তখন আমাকে খুব ভালো খাওয়াল। বুঝে নিলাম এরপরই হয়তো আমার মৃত্যু ঘটবে।
কিন্তু না! একদিন পরই ওরা চোখ বেঁধে আমাকে আগের রুমটাতে রেখে আসে। তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় এক ফ্লাইং অফিসার আসে একটি চিঠি নিয়ে। সেটা ছিল মূলত আমার চার্জশিট। মার্শাল ল ৩৯-সি ধারায় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।”
তারিখটা ১৪ অগাস্ট। অবাঙালি গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাসুদ ছিলেন শামসুল আলমদের অধিনায়ক ও বেইস কমান্ডার। তিনি তার সঙ্গে দেখা করেন। সমস্ত ঘটনা শুনে মাসুদ বলেন, ‘তোমাকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়েছে। এখন তোমাকে পাকিস্তান ফিরে যেতে হবে। ভারতের সঙ্গে শিগগিরই যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছি। এ কারণেই আমাদের অনেক পাইলট প্রয়োজন।
মনে মনে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চান শামসুল আলম। গায়ের পোশাক খুলে তাকে শরীরজুড়ে বেত্রাঘাতের নির্যাতনের চিহ্নগুলো দেখান তিনি। গোটা শরীরেই ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বাধা ছিল তখন। তিনি এক মাসের ছুটি চান। কিন্তু ওই গ্রুপ ক্যাপ্টেন পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এয়ারফোর্সে রির্পোট করার শর্তে তাকে এক সপ্তাহের ছুটি দিয়ে মুক্ত করে দেন। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম।
মুক্তি পেয়ে প্রথমে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। অতঃপর কয়েকজন গেরিলার সহযোগিতায় প্রথমে আগরতলায় এবং পরে কোলকাতায় চলে যান।
একাত্তরে কিলো ফ্লাইট অপারেশনে সাহসী ভূমিকার জন্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলমকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর নতুন বিমানবাহিনী গড়ার কাজেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদপর্যাদা লাভ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে তাকে স্বাধীনতা পদকও প্রদান করা হয়।
কথা ওঠে স্বাধীনতা লাভের পরের দেশ নিয়ে। এই বীর উত্তম নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন যেভাবে, “একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকাই আমাদের বীরত্বের সূচক। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন কিছুই ছিল না। নয়টা মাস তো কৃষকরা খাদ্যও তৈরি করেনি। ফুড ছিল অধিকাংশই পাকিস্তানপন্থি ও রাজাকারাদের ঘরে লুকানো। তবুও বঙ্গবন্ধু হাল ছাড়েননি। সাত কোটি মানুষই ছিল তার সম্পদ। লক্ষ-কোটি লোক তখন তার নেতৃত্বে নিরলসভাবে দেশ গড়ার কাজে লিপ্ত হয়েছিল। নানা সেক্টরে কাজও শুরু হয়। সবাই হৃদয় দিয়েই দেশের জন্য কাজ করেছে। আমরা যখন এয়ারফোর্সে ডিউটি করি। এয়ারম্যানরা আসত খালি পায়ে। আমাদের বেতন ছিল কম। তবুও বলতাম নো প্রবলেম। খেয়েপরে তো বেঁচে আছি।”
বীর উত্তম শামসুল আলম এখন প্রায়ত। কিন্তু তার বলা সকল কথাই প্রজন্মের নিকট ইতিহাস হয়ে থাকবে। যতই বাধা আসুক, তারাই দেশটাকে এগিয়ে নেবে আগামী প্রজন্ম– এমনটাই বিশ্বাস ছিল তার। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশেই তিনি বলে গেছেন শেষ কথাগুলো, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস বুকে ধারণ করো। দেশের জন্য নিঃস্বার্থ ও নিরলসভাবে কাজ করে যেও। এটা খুব সুন্দর একটি দেশ। এই দেশটাকে নষ্ট হতে দিও না। ভালোবেসে দেশটাকে তোমরাই পারবে এগিয়ে নিতে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৪ ডিসেম্বর ২০২৩
© 2024, https:.