মুক্তিযুদ্ধ

নভেম্বর ১৯৭১: পাকিস্তানের মনোবল ভেঙে স্বাধীনতার পথে

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হতো না জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেযামে ইসলামীর মতো দলগুলো নানাভাবে সহায়তা না করলে।স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এসব দলকেও কার্যত রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েমের নামে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়ার এমন নজির আর দ্বিতীয়টি নেই।

একাত্তরে ওই দলগুলোর কী ভূমিকা ছিল  সেদিকে একটু ফিরে তাকানো যাক। শুরু থেকেই সহায়ক বাহিনী গঠন করে, মিটিং, মিছিল, সমাবেশ করে এবং পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি সার্বিক সমর্থন জানাতে থাকেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম।মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটি গঠনের সঙ্গে যেসকল রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি এবং মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন। জেনারেল টিক্কা খানের পরামর্শ ও সহযোগিতায় তারা গঠন করে শান্তি কমিটি। প্রাথমিক পর্যায়ে জামায়াত ও অন্যান্য দলের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ১৪০ সদস্যের ‘ঢাকা নাগরিক শান্তি কমিটি’।পরে সারা দেশেই তারা কমিটি করে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার কাজে লিপ্ত থাকে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য খুলনার খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থি ব্যক্তিকে নিয়ে গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী। পরে অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তর করে পাকিস্তান সরকার। রাজাকার বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতা এ কে এম ইউসুফ। প্রথম দিকে রাজাকার বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির অধীনে। বাহিনীতে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল। সব সদস্যকে প্রতি মাসে দেড়শ রুপির মতো ভাতাও দেয়া হতো। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখানো এবং যুদ্ধে সামনে থেকে বিশেষ ভূমিকা রাখতো রাজাকাররা।

রাজাকারের পাশাপাশি আলবদর নামে একটি সশস্ত্র বাহিনীও গড়ে তোলা হয়। সেই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৩ হাজার। ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য ছাড়াও অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেকেই যোগ দিয়েছিল আলবদর বাহিনীতে। আলবদররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হয়ে যুদ্ধও করেছে। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নও করেছে তালবদররা।

আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন যুদ্ধাপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, উপ-প্রধান ছিলেন যুদ্ধাপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করা আরেক জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। একই সাজা ভোগ করা অন্য দুই জামায়াত নেতা  কাদের মোল্লা ও কামরুজ্জামানও ছিলেন আলবদর বাহিনীর নেতা। মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আলশামস নামের একটি প্যারামিলিটারি বাহিনীও গঠন করেছিল। সেই বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় তিন হাজারের মতো। ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছাইকৃত কর্মীদের নিয়ে সংগঠিত হলেও আলশামস বাহিনীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সংযোগ ছিল। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাও হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল।(তথ্যসূত্র: শান্তিকমিটি ১৯৭১: মুনতাসীর মামুন, আলবদর ১৯৭১: মুনতাসীর মামুন, জনতার আদালতে জামাতে ইসলামী: শাহরিয়ার কবির, ৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ: ডা. এম এ হাসান)

একাত্তরে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি জাতিসংঘে যান এবং পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘‘পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে অন্যায় কিছু করেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের নামে সেখানে যা চলছে, তা হলো ভারতের মদদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন৷ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচিত সেটাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করা।’’

স্বাধীনতার পরে শাহ আজিজুর রহমানকে দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় তিনি মুক্তি পান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন মুসলিম লীগের একটি বড় অংশ নিয়ে শাহ আজিজ জেনারেল জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন এবং স্বাধীনতাবিরোধী থেকে রাতারাতি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। যে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেই দেশেরই জাতীয় পতাকা উড়তে থাকে শাহ আজিজুর রহমানের গাড়িতে। শাহ আজিজুর রহমান মারা গেছেন, তবে তার কবর আছে সংসদ ভবন এলাকায়।02:20

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে৷ তখন তার ভূমিকা প্রসঙ্গে বীরবিক্রম লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খানের সঙ্গে কথা হয়েছিল৷  তিনি বলেন, ‘‘এরশাদ তো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। খামখেরা সেক্টরে তিনি ছিলেন সিক্স ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিইও। ভারতীয় বর্ডারের খুব কাছেই ছিলেন। ইচ্ছে করলে পুরো ব্যাটেলিয়ান নিয়ে হেঁটেই ঢুকে যেতে পারতেন ইন্ডিয়াতে। তার এক কোম্পানি ইন্ডিয়া চলে গিয়ে পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং মুক্তিযুদ্ধের সময়ই উনি মেজর থেকে পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়েছিলেন।’’

বাংলাদেশের (তখন পূর্ব পাকিস্তান) কিছু রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ন্যাপ)-এর নেতারা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন করেছিলেন।এ কারণে তাদের নিযার্তন করে ইয়াহিয়া সরকার। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি করা হয়েছিল তাঁকে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ ছিলেন সেই উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস মওলানা ভাসানী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এ সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা রাখতে জাতিসংঘ ও  চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে তারবার্তা পাঠান৷ (তথ্যসূত্র: মওলানা ভাসানী-রাজনৈতিক  জীবন ও সংগ্রাম, লেখক: শাহরিয়ার কবির, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী: শাহজাহান মিন্টু ও রবিউল দুলাল)

নভেম্বর মাস থেকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে কোণঠাসা হতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়া গেরিলারা ঢাকার ভেতরে অর্তকিত আক্রমণ চালিয়ে সরে পড়তো।

প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস তখন ছিল রাজারবাগের উল্টো পাশে, মোমিনবাগে৷সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচিত এমপিএ আর এমএনএরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে চলে যায় মুক্তাঞ্চল ও ভারতে। পরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ফন্দি আঁটে। নির্বাচিত সব এমএনএ ও এমপিএ-র পদ শূন্য ঘোষণা করে আসনগুলোতে উপনির্বাচনের গোপন প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই পরিকল্পনার খবর জেনে যায় ঢাকার গেরিলারা। নভেম্বরের প্রথম দিন তারা পাকিস্তানের ইলেকশন কমিশন অফিসে বিস্ফোরণ ঘটায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু যুক্ত ছিলেন ওই অপারেশনে। সেই অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘খোকা ভাইয়ের(সাদেক হোসেন খোকা) নেতৃত্বে ওই অপারেশনে অংশ নিই আমি, লস্কর, সুফি আর হেদায়েত। জায়গাটা রেকি করে আসি একদিন আগেই। রোজার সময় ছিল। ঢাকায় যখন ঢুকি রাত তখন ৮টার মতো। তারাবির নামাজ চলছে।

রাস্তাঘাট ফাঁকা। ওই সময়ই বিল্ডিংয়ে ঢুকে ১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ফিট করি। বেরিয়ে এসেই বিস্ফোরণ ঘটাই। এতে গোটা শহর কেঁপে ওঠে। বিল্ডিংয়ের এক পাশ ধসে পড়ে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ইলেকশন কমিশন অফিসের কাগজপত্র। এ খবর ফলাও করে প্রচার করে বিশ্বগণমাধ্যম।’’

সেন কাকরাইল পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দেয় গেরিলাদের আরেকটি দল। বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমান ওই অপারেশনটির নেতৃত্ব দেন। সেটি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তার ভাষায়, “৫২ জনের গেরিলা দল নিয়ে আমরা ছিলাম মানিকগঞ্জের রোহা গ্রামে।

কমান্ডার ছিলেন রেজাউল করিম মানিক (পরে তিনি শহীদ হন), সহ-কমান্ডার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। একদিন মানিক ভাইকে বললাম, আমাদের সঙ্গে আছে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ও ফসফরাস গ্রেনেড। ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মি বা পুলিশ থাকে এমন জায়গার আশপাশে বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে চাই। তিনি বলেন, ‘কেমনে করবা?’ বললাম, ‘দুটো দিন সময় দিলে পুরো প্ল্যানটা করা যাবে।’ সময় দিলেন তিনি।

আলতাফ হোসেন টুনিকে নিয়ে রেকি করতে বের হই। কাকরাইল পেট্রোল পাম্পটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুব কাছে। সেটাই বেছে নিই। পাম্পের উল্টোদিকে ছোট একটা টং দোকান ছিল। সেখানে চা খেতে খেতে কোথায় এক্সপ্লোসিভ লাগাবো, ওয়েট (চাপা দেওয়ার মতো ভারি জিনিস) দেওয়ার মতো কী আছে, কয়জন ডিউটি করে- সব দেখে আসি। ক্যাম্পে ফিরে মানিক ভাই ও বাচ্চু ভাইকে নিয়ে পুরো প্ল্যানটা করি। চারজন লাগবে। আমি আর টুনি যাবো। সঙ্গে থাকবে আরও দুজন। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে পুলিশ আসতে এক মিনিটও লাগবে না। তাহলে পালাবো কীভাবে? খন্দকার মাহাবুব উদ্দিনের ছেলে নেহাল ছিল বন্ধু। তার কাছে গাড়ি চাইলাম। সে বলল, রোজার মাস, শুধু ইফতারের সময় বের হই, তখনই মাথায় ক্লিক করে ‘দ্যাট ইজ দ্য বেস্ট টাইম।’’

ক্যাম্পে ফিরে মানিক ভাই ও বাচ্চু ভাইকে জানালাম। তারা বললেন, মহাখালী ওয়্যারলেস গেটে গেলে ফেরদৌস নামের একজন তোমাদের আর্মস দেবে। নভেম্বরের এক তারিখ। মানিক ভাই দুজন ছেলেকে সঙ্গে দিলেন। ওরা বাজারের ব্যাগে করে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আসে। আমি আর টুনি রিকশায় মহাখালী ওয়্যারলেস থেকে একটা কম্বলে মোড়ানো স্টেনগান নিয়ে গন্তব্যে যাই। নেহালও গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে রাখে।

ইফতারের ঠিক আগে চোখের ইশারায় চারজন মুভ করলাম। আমি আর টুনি স্টেনগান নিয়ে পাম্পের বাইরে যে দুজন কাজ করছিল তদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পর্দা টেনে দিয়ে সবাইকে বললাম, ‘চুপ করে বসেন। আপনাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না।’ দুজন গেরিলা আমার নির্দেশে বাইরে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে থাকে। বালিভর্তি দুটি বালতি এক্সপ্লোসিভের ওপর চাপা দেয়। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের সঙ্গে ডেটোনেটর সেট করে দুই মিনিটের ফিউজ লাগায়। ফিউজে আগুন দিয়েই ওরা ডাক দেয় আমাদের। তখন পাম্পের লোকদের বলি, ‘তোমরা শুধু দৌড়াতে থাকবে।’ আমরাও দ্রুত গাড়িতে উঠে সরে পড়লাম। রাজারবাগ এলাকায় ওমর নামে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িটি ছিল শেল্টার। সেখানে পৌঁছাতেই বিশাল বিস্ফোরণে পুরো ঢাকা কেঁপে ওঠে। আমরা আনন্দে একে অপরের মুখের দিকে তাকাই।”08:14

ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর এমন দুঃসাহসিক অভিযান ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা বিষ্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ক্রমেই ভেঙে পড়ে। এ নিয়ে আন্তার্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি  একটা খবরে লিখেছিল, ‘‘রাতের বেলা ঢাকা নগরী মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকে। এমন কি দিনের বেলায়ও হানাদার বাহিনী দলবদ্ধ না হয়ে আজকাল শহরে ঘুরাফেরা করতে সাহস পাচ্ছে না।”

এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সকল পুলিশ সদস্য পাকিস্তান সরকার ঢাকায় এনেছিল তারাও দেশে ফিরে যাবার জন্য এ সময় একদিনের ধর্মঘট ডেকে বসে। ফলে বিপাকে পড়ে পাকিস্তান সরকার। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত জোরালো হতে থাকে। নভেম্বরে হোয়াইট হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন। বৈঠকের মূল প্রসঙ্গ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আলোচনা ব্যর্থ হয়। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ প্রশ্নে কোনো ছাড় দেননি৷ তখন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। তবে ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতায় ওয়াশিংটনের পাকিস্তানপন্থি কৌশলগুলো

অকার্যকর হতে থাকে৷ পাকিস্তান যেন বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তিনি যেন সসম্মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে অনেক রাষ্ট্রে ধরনা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে বিশ্বজনমতও আসে বাংলাদেশের পক্ষে।(তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, পৃষ্ঠা-৩৪৬)

পাকিস্তানি সেনারা তাদের নিয়মিত বাহিনীর ঝুঁকি কমাতে যে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিল তা একসময় প্রায় ভেঙে পড়ে। সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর কাছে রাজাকাররা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে থাকে। এতে তাদের প্রতি পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রাজাকারদের আত্মসমর্পণ ঠেকাতে তারা এক জেলার রাজাকারদের অন্য জেলায় দ্রুত বদলি করতে থাকে।

নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধে আরেকটি নতুন মোড় নেয়। চূড়ান্ত যুদ্ধের পরিকল্পনায় মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের সার্বিক সম্মতিতে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে একটি ‘যৌথ বাহিনী’ গঠিত হয়। যৌথ বাহিননীর অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার এক সামরিক নির্দেশনায় সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি যুদ্ধ সেক্টরে বিভক্ত করে উভয় দেশের যুদ্ধরত ইউনিটগুলোর সমন্বয় করা হয়।

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরও একইভাবে একটি নির্দেশনা জারি করে। ২১ নভেম্বর ‘যৌথ বাহিনী’ প্রথম যশোরের চৌগাছায় অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে। চৌগাছার সফল ওই যুদ্ধে ভারতীয় সাঁজোয়া বাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘ব্যাটল অব চৌগাছা’ বা ‘চৌগাছার যুদ্ধ’ নামে অভিহিত হয়ে আছে।

মিত্রবাহিনী, মুক্তিবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে পরিচালিত এই যৌথ অভিযান রণাঙ্গনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। পাশাপাশি এটি মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যান্য যুদ্ধের জন্য নতুন মাইলফলক হিসেবেও বিবেচিত হয়। এ কারণেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী প্রতিবছর ২১ নভেম্বরকে  সাড়ম্বরে ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে, প্রকাশকাল: ২৪ নভেম্বর ২০২৩

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button