মুক্তিযুদ্ধ

শহীদ সুফিয়া খাতুনের রক্তমাখা কোরআন শরিফ

৭১-এর শহীদ স্মৃতি:০১

বহু আত্মত্যাগ, লড়াই, সংগ্রাম আর রক্তনদী পেরিয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য প্রায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ত্রিশ লাখ শহীদ। কিন্তু শহীদদের আত্মত্যাগের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও তেমন উঠে আসেনি। স্বাধীনতা লাভের পর অনেক শহীদ পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াইটাও ছিল আরেক যুদ্ধ। স্বাধীন দেশের ইতিহাসে সেই লড়াইয়ের ইতিহাসটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

স্বজনদের ভাষ্যে তৃণমূলে একাত্তরে শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে আনতেই এক বিকেলে মুখোমুখি হই শহীদ সুফিয়া খাতুনের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ হোসেনের। দুই ভাই-বোনের সংসারে মুরাদ বড়। সৈয়দপুরের বিহারি সমাজেই বড় হয়েছেন তারা। বাবা আমজাদ হোসেন সিকদার ছিলেন অ্যাকাউন্টস অফিসার, রেলওয়েতে। সে সুবাদেই একাত্তরে তারা থাকতেন সৈয়দপুর শহরে, আতিয়ার কলোনির এল-৭৬-বি নম্বর কোয়ার্টারে।

আলাপচারিতার শুরুতে তাদের ওপর মায়ের প্রভাব কেমন ছিল-তা তুলে ধরেন মুরাদ হোসেন। তিনি বললেন যেভাবে, “ছোটবেলায় খুব চঞ্চল ও ডানপিটে ছিলাম। বাবার আদর ও প্রশ্রয় পেয়েছি বেশি। তবে মা খুব শাসন করতেন। তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন। মাগরিবের নামাজের পর আমাদের নিয়ে পড়তে বসাতেন। পাশে বসে মাও লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়তেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতেন না তিনি। বলতেন, পড়াশোনা আগে, তারপর অন্যকিছু। মায়ের আদর্শেই বেড়ে উঠি আমরা।”

একাত্তরের শহীদ সুফিয়া খাতুন, ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া

সৈয়দপুরে তখন বিহারিরাই নেতৃত্ব দিত। ছয় দফার আন্দোলন চলছে। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যগুলোও স্পষ্ট হতে থাকে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বায়িত্বশাসন, স্বাধিকার দরকার, দরকার স্বাধীনতাও। বিহারিরা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে সৈয়দপুরে ওদের সঙ্গে বাঙালিদের বিভেদ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী বাঙালিদের ওরা ভালো চোখে দেখত না। ওরা উর্দুভাষায় নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনা করত। প্রকাশ্যে শেখ মুজিবকে ‘গাদ্দার’ বলত, গালিও দিত। শুনে ঠিক থাকতে পারত না মুরাদ রা।
সত্তরের নির্বাচনের সময় ঘটে একটি ঘটনা।

মুরাদের ভাষায়, “কলোনির পাশে চিকা (দেওয়াল লেখা) মারছিলাম। পরিচিত এক বিহারি ছেলে এসে বলে, ‘শেখ মুজিব গুণ্ডা হ্যাঁয়’। শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায়। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। ঘুষি দিয়ে ওর নাক ফাটিয়ে দিই। মুহূর্তের মধ্যে অনেক বিহারি একত্র হয়। ওরা আক্রমণ করে আমার নাকও ফাটিয়ে দেয়। সে থেকেই আমার নাকের নিচের ডগাটা এখনও ভাঙা।”

এর পর নির্বাচনে সৈয়দপুরসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বিহারিরাও তখন বাঙালির ওপর চড়াও হয়। বাঙালিদের সাথে তারা কথা বলা ও মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। বাঙালিরাও আন্দোলনের জন্য ভেতরে ভেতরে রেডি হতে থাকে। বাকী ইতিহাস শুনি মুরাদের মুখেই।

“বিহারিদের সঙ্গে দ্বন্দ বাড়তে থাকে। ওদের নেতা ছিল মতিন হাশমি, সৈয়দপুর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। পুরো বিহারি এলাকার নেতৃত্ব দিতেন। প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা দেন, ‘২৩ মার্চ যুদ্ধ হবে। বোঝাপড়া হবে এদেশে আমরা থাকব নাকি তোমরা (বাঙালিরা)।’ কিন্তু ওদের হুমকিতে আমরা আতন্কগ্রস্থ ছিলাম না। ভেতরে ভেতরে আমরাও প্রস্তুতি নিতে থাকি। মরে যাব কিন্তু পাকিস্তানি বা বিহারিদের কাছে মাথা নত নয়। এ দেশ মুক্ত করে বাঙালিদের কাছেই দিয়ে যাব-এমন শপথ নিই সবাই।

২২ মার্চ রাতেই গোলারহাটে যুদ্ধ শুরু হয়। বিহারিরা এগিয়ে আসলে গ্রামের দিক থেকে আসা বাঙালিদের সঙ্গে ফাইট হয়। রক্তাক্ত প্রান্তরে মারাঠাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়েছিল। ওখানে কারা থাকবে- মুসলমানরা নাকি মারাঠারা। সৈয়দপুরে আমাদের যুদ্ধটাও ওরকমই ছিল।
২৪ মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে আসে। মাথায় গামছা বেঁধে তারা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। ফলে পাখির মতো বাঙালি মরে। হাজার হাজার লাশ দেখে তৎকালীন এসডিও মুয়ীদ চৌধুরী থানায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তখন গ্রামের দিকে লুকিয়ে থাকি।”

শহীদ সুফিয়া খাতুনের কোরআন শরীফে এখনও লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ. ছবি: সালেক খোকন

পরিস্থিতি খারাপ দেখে মুরাদের ছোটবোন ইভা জোহরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নীলফামারী, মামার বাড়িতে। কলোনির কোয়ার্টারে তখন তার মা সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে থাকত দূরসম্পর্কের এক বোন, নাম জোবাইদা। কিন্তু মুরাদ কলোনিতে ফিরতে পারে না। বিহারিরা তার মাথার দামও ঘোষণা করে প্রকাশ্যে। এতেই তারা ক্ষান্ত হয় না। বাড়িতে আক্রমণ করে মুরাদের মমতাময়ী মাকে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করে।
ওই ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে বারবারই থেমে যান মুরাদ হোসেন। বুকে জমে থাকা কষ্টের পাহাড়ে তখন বৃষ্টি ঝরে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তিনি বলেন শহিদ মাতা সুফিয়া খাতুনের আত্মত্যাগের করুন ইতিহাসটি:

“সৈয়দপুর শহরের সব বাঙালিকে ওরা আটকে রেখেছিল। আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল তাদের ফ্যামেলিকেও বাঁচতে দেয়নি। ১৪ এপ্রিল রাতে আম্মাকে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করে। কলোনিতে ওটাই ওদের প্রথম অ্যাটাক। মেইন রোডের পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার, ছাদ দেওয়া একতলা বাড়ি। মার্চের শুরুতেই ছাদের ওপর বিশাল সাইজের একটা বাংলাদেশের পতাকা ও একটা কালো পতাকা লম্বা বাঁশ দিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত পাকিস্তানি আর্মি। বাংলাদেশের পতাকা দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়।
বিহারিরা প্রথম এসে আম্মাকে বলে, ‘উসকো উতার দো’। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে টাঙিয়েছে। এটা আমি নামাতে পারব না।’ ওরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মিদের ভয় দেখিয়ে আবারও পতাকা নামাতে বলে। এবারও আম্মা অস্বীকৃতি জানায়। তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করে ওরা। কিন্তু আম্মার বাধার কারণে পারে না। ফলে হুমকি ও গালাগালি করে চলে যায়।

এর কিছুক্ষণ পরেই আর্মিসহ বিহারিদের একটি সশস্ত্র দল এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। মা তখন রেহালে রেখে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। পেছনের দরজা দিয়ে তিনি ওই বোনটাকে পাঠান পাশের বাড়িতে, আব্বার বন্ধুকে ডেকে আনতে। কিন্তু পথের মধ্যেই বিহারিরা বোনটাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সামনের দরজা ভেঙে তারা ঘরের ভেতরে যখন ঢোকে, আম্মা তখন কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। ওদের কাছে প্রাণভিক্ষাও চান। কিন্তু পিশাচদের মন গলে না। কোরআন শরিফ ধরা অবস্থাতেই আম্মাকে ওরা কোপ দিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। রক্তে ভেসে যায় পুরো ঘর। আল্লাহর কালাম কোরআন শরিফও মাটিকে পড়ে রক্তে ভিজে যায়।

মুসলমান হয়েও পাকিস্তানের পক্ষে বিহারিরা এমন বর্বরতা চালিয়েছিল। পরে আম্মার লাশ পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। তার লাশটাও ফেরত দেয়নি ওরা। বোন জোবাইদার লাশটা রাস্তায় পড়েছিল কয়েকদিন। দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকলে স্থানীয়রা পরে তা মাটি চাপা দেয়।
আশাপাশের পরিচিতজনরা আম্মার করুণ ও নির্মম মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। তাদের মুখেই শুনেছি সবকিছু। বিহারিরা চলে গেলে পাশের বাসার একজন ঘর থেকে আম্মার রক্তমাখা কোরআন শরিফটি তুলে নেন। পরে সেটি আমরা সংগ্রহ করি। রক্তমাখা ওই কোরআন শরিফটাই আমাদের মায়ের শেষ স্মৃতি। যার পাতায় পাতায় রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।”

সৈয়দপুরে বাঙালিদের প্রতি বিহারিদের নির্মমতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধে। তাদের বর্বরতা আর হিংস্রতার কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। অথচ একাত্তরে গণহত্যায় যুক্ত বিহারিদের বিচার এখনও আমরা করতে পারেনি। মায়ের রক্তমাখা কোরআন শরিফটা হাতে নিলে বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। পতাকা দুটি যদি না টাঙাতাম তাহলে হয়তো ওরা আম্মাকে এভাবে হত্যা করত না। মাঝেমধ্যে নিজেকেও অপরাধী মনে হয়। স্বপ্নে আম্মার চিৎকার শুনে জেগে উঠি প্রায়ই। তখন খুব কষ্ট লাগে। এই দুঃখের কথা ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা তো মাকে ফিরে পাইনি, তার লাশও পাইনি। ফলে তার কবরও নেই। পুরো দেশের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের রক্ত। কিন্তু এ দেশ কি মনে রাখবে আমার শহীদ মাকে?

আক্ষেপ নিয়ে মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আবেদন করলেও স্বাধীনতার জন্য শহীদ আমার মায়ের নাম উঠেনি সরকারের শহীদ তালিকায়। একাত্তরে শত শত মায়েরা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা কি মনে রেখেছি তাঁদের? তাদের আত্মত্যাগের কয়টি ইতিহাস জানে এ প্রজন্ম। আজ আপনি এসেছেন বলে বলতে পারছি। কিন্তু সকল শহীদদের ইতিহাস তুলে ধরতে না পারার দায় রাষ্ট্রসহ আমরাও এড়াতে পারব না।’

শহীদ সুফিয়া খাতুনের মতো লাখো শহীদের রক্তে ভিজে আছে স্বাধীন দেশের সবুজ ঘাস, বেদনার্ত উর্বর ফসলি মাটি। তাঁদের শোকে আজো অশ্রুসজল স্বজনদের মায়াভরা চোখ। এ দেশের মুক্তির জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তারা সবাই এ জাতির সূর্যসন্তান। তাদের অসীম আত্মত্যাগ বাঙালির চিরকালের প্রেরণা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন নিউজপেপার সকাল সন্ধ্যায়, প্রকাশকাল: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button