৩০ জুন হোক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আদিবাসীদের আত্মশুদ্ধিরও দিন। প্রতিষ্ঠা পাক আদিবাসীদের ভূমিসহ সকল নাগরিক অধিকার।
সাঁওতালসহ সমতলের আদিবাসীদের কাছে ৩০ জুন একটি বিশেষ দিন। এদিনে তাঁদেরই প্রাণপুরুষ সিধু-কানু নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জমিদার মহাজনদের, ইংরেজ শাসকের, পুলিশ-পাইক-পেয়াদার আর জজ–ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন, যাকে সাঁওতাল হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ বলা হয়।কিন্তু ওই বিদ্রোহের ১৬৮ বছর পরও সেই ভূমির জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে জীবন দিতে হচ্ছে সাঁওতালসহ সমতলের আদিবাসীদের। সেখানে সিধু-কানুর লড়াই কতটা উজ্জীবিত করছে তাঁদের উত্তরসূরিদের? সে প্রশ্নের উত্তর মেলানোর আগে কেন এবং কীভাবে বিদ্রোহ করেছিলেন সিধু-কানু, সেদিকে একটু ফিরে তাকানো যাক।
ইংরেজ আমলের কথা। রাজমহল পাহাড় আর আশপাশের পার্বত্য ও নদীঘেরা অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাদ করার ঘোষণা দেয় ইংরেজরা। ঘোষণায় বলা হয়, যে যত খুশি তত জমি তৈরি করতে পারবে, ওই জমির ওপর কোনো কর দিতে হবে না। এ আহ্বানে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, ছোট নাগপুর, কটক প্রভৃতি অঞ্চল থেকে হাজার হাজার সাঁওতাল ছুটে আসে। জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করে চাষাবাদের জমি। এভাবেই প্রতিষ্ঠা পায় বর্তমান সাঁওতাল পরগনা।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখেনি। তারা ওই অঞ্চলের জমির ওপরও কর ধার্য করে। এ ছাড়া ওই সময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মহাজন ও ব্যবসায়ীরাও নানাভাবে শোষণ শুরু করে সাঁওতালদের। তাদের কাছ থেকে ধান, শর্ষে ও তেলবীজ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিত ওই শোষকেরা। এর বিনিময়ে সাঁওতালদের দেওয়া হতো সামান্য অর্থ, লবণ, তামাক ও কাপড়। ধূর্ত ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের কাছ থেকে যখন কোনো জিনিস কিনত, তখন ‘কেনারাম’ নামের বেশি ওজনের বাটখারা ব্যবহার করত। আর যখন তাঁরা সাঁওতালদের কাছে কিছু বিক্রি করত, তখন ব্যবহার করত ‘বেচারাম’ নামের কম ওজনের বাটখারা। এভাবে ব্যবসায়ীরা ওজনে ঠকাত সহজ-সরল সাঁওতালদের।
আবার মহাজনদের কাছ থেকে একবার ঋণ নিলে সারা জীবনেও সেই ঋণ পরিশোধ হতো না। ঋণ দেওয়ার সময় কৌশলে তাদের কাছ থেকে বেশি টাকার টিপসইও নিত মহাজনেরা। ফলে কোনো সাঁওতালের মৃত্যু হলেও তাঁর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে বা নিকটাত্মীয়র ওপর ওই ঋণ পরিশোধের দায় বর্তাত। এভাবে বংশানুক্রমে মহাজনদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে থাকে সাঁওতালরা।
শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার ও উৎপীড়নে এভাবে সাঁওতালদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। ফলে একসময় মুক্তির পথ খোঁজে তারা। একবার বীর সিংয়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় সাঁওতালদের একটি দল। কিন্তু পাকুড় রাজার দেওয়ান জগবন্ধু রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁকে জরিমানা করে সবার সামনে জুতাপেটা করে জমিদারেরা। সে সময় গোচ্চোর মতো ধনী সাঁওতালদেরও পুলিশ দিয়ে হেনস্থা করা হতো। সাঁওতালরা আদালত আর পুলিশ থেকেও কোনো সাহায্য পেত না। ফলে ভেতরে–ভেতরে ক্ষিপ্ত হতে থাকে তারা।
সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ছিলেন চার ভাই। সঙ্গে ছিলেন তাদের দুই বোন ফুলো ও ঝানর।সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে তাঁদের জন্ম। শোষণের শিকার হয়ে একসময় চার ভাই বুঝতে পারেন, সাঁওতাল সমাজকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্যের। তাঁরা তাই সাঁওতালদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে ধর্মের ধ্বনিকেই কার্যকর বলে মনে করেন। ছড়িয়ে দিতে থাকেন একটি কল্পিত কাহিনি।
সেই কাহিনি এমন—‘একদিন রাতে সিধু ও কানু তাঁদের ঘরে বসে নানা বিষয়ে চিন্তা করছিলেন। ঠিক তখনই সিধুর মাথার ওপর এক টুকরা কাগজ এসে পড়ে। আর সেই মুহূর্তেই ঠাকুর (ভগবান) তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ান। সাঁওতালি পোশাকে ঠাকুরকে অন্য রকম লাগছিল। তাঁর প্রতি হাতে ১০টি করে আঙুল, হাতে ছিল একটি সাদা রংয়ের বই এবং তাতে তিনি কী যেন লিখেছিলেন। বইটি এবং তাঁর সঙ্গে ২০ টুকরা কাগজ তিনি সিধু ও কানুর হাতে তুলে দিয়েই শূন্যে মিলিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে দুই ব্যক্তি তাঁদের সামনে এসে হাজির হন। তাঁরা দুই ভাইয়ের কাছে ঠাকুরের নির্দেশগুলো ব্যাখ্যা করেন এবং হঠাৎ শূন্যে মিলিয়ে যান। এভাবে সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই ভগবান আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং বইয়ের পৃষ্ঠায় ও কাগজের টুকরায় সাঁওতালদের জন্য লিখে গেছেন নানা নির্দেশনা।’
ভগবানের সেই নির্দেশনাগুলো শুনতেই চারপাশের সাঁওতালদের জমায়েত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিধু-কানু সবার কাছে পাতাসমেত ছোট শালের ডাল পাঠান। মূলত শালডাল তাঁদের একতার প্রতীক।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। সিধু-কানুর ডাকে প্রায় ৪০০ গ্রামের ১০ হাজার সাঁওতাল একত্র হন ভাগনাদিহি গ্রামে। ওই দিন দুই ভাই সব ঘটনা তুলে ধরে সবার উদ্দেশে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘ভগবান সব উৎপীড়নকারীকে উচ্ছেদ করে সাঁওতালদের স্বাধীন জীবন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন।’
শুনেই উপস্থিত সাঁওতালরা একবাক্যে শপথ নেয় জমিদার মহাজনদের, ইংরেজ শাসকের, পুলিশ-পাইক-পেয়াদার আর জজ–ম্যাজিস্ট্রেটের নিপীড়ন ও দাসত্ব সহ্য না করার। সিদ্ধান্ত হয় খাজনা না দেওয়ার। বিদ্রোহী সাঁওতালদের কণ্ঠে ওই দিন উচ্চারিত হয়েছিল—‘জমি চাই, মুক্তি চাই।’ এভাবেই সিধু-কানুর সাঁওতাল হুল বা বিদ্রোহ শুরু হয়।
এ বিদ্রোহের ফলে বিহারের একটি অংশ এবং বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ জেলার বৃহৎ অঞ্চলের ইংরেজ শাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। তখন ইংরেজরা বিদ্রোহ দমনের বড় প্রস্তুতি নিতে থাকে। তারা হত্যা করে হাজার হাজার সাঁওতালকে। এতে বিদ্রোহীরা পিছু হটতে বাধ্য হন।
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। সিধুর গোপন আস্তানায় হানা দিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ইংরেজরা (মতান্তরে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল)। এর আগেই সাঁওতাল বিদ্রোহের অপর দুই নায়ক চাঁদ ও ভৈরব ভাগলপুরের কাছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেন। আর ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বীরভূম জেলার ওপারবাঁধের কাছে কানু একদল সশস্ত্র পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ধারণা করা হয়, পরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সিধু-কানুদের চার ভাইয়ের সঙ্গে এই বিদ্রোহে তাঁদের দুই বোন ফুলো ও ঝানর প্রাণ দিয়েছিলেন। নেতারা সবাই মারা যাওয়ার পরও সাঁওতালরা মাথা নত বা আত্মসমর্পণ করেননি। প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে মৃত্যুকেই বরং শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছিলেন।
সাঁওতালরা কি পরাজিত হয়েছিল? না, সরাসরি বিজয় না হলেও সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল, দামিন-ই-কো এলাকাসহ বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয় এবং সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে। পাশাপাশি সাঁওতাল বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে কৃষক সংগ্রাম ও সিপাহী বিদ্রোহেরও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
কিন্তু এ দেশে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা আজও পায়নি তাদের ভূমির ন্যায্য অধিকার। বিশেষ করে সমতলের আদিবাসীদের অধিকাংশ জমি ছিল কালেকটিভ। জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদের পর সেগুলো জমিনদারি খাস হয়ে যায়। এখনো অনেক এলাকায় আদিবাসীরা থাকছে, চাষ করছে, এমন জমিকে সরকার খাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানার জমিগুলোও আদিবাসীরা দখলে রাখতে পারছে না। প্রশাসনের অসাধু এক শ্রেণির কর্মকর্তার সহযোগিতায় আদিবাসীদের জমিগুলো দখল করে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালিরা। এ নিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর তারিখে গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের আওতাধীন সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। ঘটনার দিন পুলিশ চিনিকলের জমিতে গড়ে তোলা বসতি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে এবং সাঁওতাল পল্লি মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিন সাঁওতাল- শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ।কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এর আগে নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে ২০১৪ সালে খুন হন দিনাজপুরের সাঁওতাল কৃষক টুডু সরেন। ভূমিদস্যুরা জাল দলিলের মাধ্যমে দখল করে নেয় তাঁর ৩৩ একর জমি। এছাড়া নিজেদের বসতভিটা সরকারের অধিগ্রহণের প্রতিবাদে জীবন দিয়েছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের পীরেন স্নাল। দিনাজপুরে কড়াদের ভূমির দখল নিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে কয়েক বছর আগে। ভূমি নিয়ে মামলা এখনও চলছে। এভাবে প্রায়ই মামলা-হামলা, অত্যাচার-নির্যাতনে ভূমিহীন হচ্ছেন সমতলের আদিবাসীরা।
ভূমি হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটেও পড়েছে তারা। কারণ এই ভূমিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তাদের জীবন ও সংস্কৃতি। জমির সঙ্গে সঙ্গে কমছে আদিবাসীদের সংখ্যাও। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল, দক্ষিণাঞ্চলের রাখাইন, মধ্যাঞ্চলের গারোদের মতো সমতলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর দখলি জমি যেমন কমছে, তেমনি কমছে তাদের জনসংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদিবাসীদের জীবনবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এ জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন তারা। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সে উদ্যোগ কবে ঘটবে- জানা নেই আমাদের।
অন্যদিকে সাঁওতালরা মনে করেন, আজও অন্যায়, অত্যাচার আর নানামুখী বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁদের রুখে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তি সিধু-কানু।তাঁদের বিশ্বাস, সাঁওতালদের সত্তায় সিধু-কানু বারবার ফিরে আসে। কিন্তু সত্যিই কি তাই! সিধু-কানুর লড়াইয়ের ইতিহাস কি জানেন এ প্রজন্মের সাঁওতাল আদিবাসীদের সবাই? নাকি এনজিও নির্ভর কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকছে। সাঁওতালদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে সিধু-কানুর ধর্মের ধ্বনি বর্তমান সময়ে ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের মনে কতটা দাগ কাটতে পারছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও হয়তো অবান্তর হবে না।
আবার সাঁওতালরা তাদের অধিকার আদায়ে যতটা সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে তেমন আন্দোলন বা প্রতিবাদ আমরা দেখছি না কড়া, ওঁরাও, গারো, ভুনজার, মুন্ডা, মুষহরসহ অন্যান্য আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষদের ক্ষেত্রে। কিন্তু আদিবাসীদের ভূমিকেন্দ্রিক অধিকার আদায়ের জন্য সকল জাতির মানুষদেরই সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ রাখা জরুরি। যা তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হবে আদিবাসী নেতা ও তাঁদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোকে। আর সিধু-কানুর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এ কাজটি করতে হবে সকল রাজনীতি ও প্রলোভনের উর্ধ্বে থেকেই। তাই ৩০ জুন হোক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আদিবাসীদের আত্মশুদ্ধিরও দিন। প্রতিষ্ঠা পাক আদিবাসীদের ভূমিসহ সকল নাগরিক অধিকার।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিভাগে, প্রকাশকাল: ৩০ জুন ২০২৩
© 2023, https:.