মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে আলোকিত হোক নতুন প্রজন্ম
প্রাসঙ্গিক হওয়ায় একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। একাত্তর নিয়ে কাজ করার সুবাদে ঘুরে বেড়াতে হয় বিভিন্ন উপজেলায়, প্রত্যন্ত গ্রামেও। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যে একাত্তরের ঘটনা তুলে আনা আর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ধারণ করার কাজে। গেল ডিসেম্বরে ছিলাম টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সারাদেশের মতো সেখানেও পালিত হয় নানা অনুষ্ঠান।
বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে সরকারিভাবে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। স্থানীয় রামগতি শ্রী গোবিন্দ (আরএস) স্কুল মাঠে চলে এর আনুষ্ঠানিকতা। একাত্তরের ৭ই মার্চের পর এই স্কুল মাঠেই ছাত্র, কৃষক, জনতাসহ পাঁচ শতাধিক মানুষকে বাঁশের লাঠি হাতে ট্রেনিং করানো হয়। এ উদ্যোগের সাথে ছিলেন মির্জা ফরহাদ, আলী আজগর, আবুল কাশেম ভূঁইয়া, লাল মিয়া, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। ট্রেনিং করিয়েছিলেন মোতালেব নামের একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। অথচ স্থানীয় অনেকের কাছেই এই ইতিহাস এখন বিস্মৃতপ্রায়।
বিস্মৃত বলার কারণ এই যে, সেখানে নেই কোনও ‘স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ’ কিংবা কোনও ‘স্মৃতিসৌধ’। তবে, স্কুল মাঠে আছে ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত বড় একটি শহীদ মিনার।
বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে ওই শহীদ মিনারেই চলে শ্রদ্ধানিবেদন পর্ব। জানা গেল, কেবল বিজয় দিবসে নয়, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসেও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ওই শহীদ মিনারেই। স্থানীয় সংসদ সদ্য, প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসহ সব সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে স্মরণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহীদ, চার লাখ নির্যাতিত নারী, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির সূর্যসন্তানদের।
প্রশ্ন জাগে, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে একাত্তরের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদনের নিয়ম থাকলেও কেন ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে?
উত্তরটি খুব সহজ আর এই সহজ উত্তরটি দিয়েই যেন দেশে সবার দায়মুক্তি ঘটছে। উত্তর হচ্ছে— এ উপজেলায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তৈরি করা হয়নি কোনও স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ। একই অবস্থা এই জেলার দেলদুয়ার ও ঘাটাইল উপজেলায়ও। এ কারণে কালিহাতিসহ এমন উপজেলাগুলোতে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদনের একমাত্র স্থান এখনো ভাষা শহীদ মিনার।
প্রশ্ন হলো, একাত্তরে দেশ স্বাধীনের জন্য লাখো শহীদের আত্মত্যাগের স্মরণে যে স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিসৌধ নির্মিত হওয়ার কথা তা আজও হচ্ছে না কেন? যেখানে মানুষ হারানো স্বজন ও পূর্বসূরীদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, স্বাধীনতার অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেখানে কেন কোনও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি? এমনটা প্রত্যাশিত নয়।
ওইদিন (১৬ ডিসেম্বর ২০২৩) সকালে দেখেছি কালিহাতিতে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণা। বিজয় দিবসের সকালে ফুল হাতে তারা দলবেঁধে এসেছে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। কথা হয় কয়েকজনের সাথে। কৌতূহলবশত ষষ্ঠ, অষ্টম ও নবম শ্রেণির তিনজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলি।
তাদের প্রশ্ন করি, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে কোথায় শ্রদ্ধা জানাতে হয়?
সবার অকপট উত্তর— শহীদ মিনারে।
প্লাটা প্রশ্ন করি, তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য শহীদদের স্মরণে কোথায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে?
এখানেও সবার উত্তর— শহীদ মিনার।
শিক্ষার্থীদের দোষ দেখি না। কারণ ঐতিহাসিকভাবে দেশের প্রায় সবখানেই এতদিন ধরে শহীদ মিনারেই আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’, ছাব্বিশে মার্চ ‘স্বাধীনতা দিবস’ ও ষোলই ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’-এ শ্রদ্ধা নিবেদন করে এসেছি। কিন্তু মুশকিল হলো, ওই শিক্ষার্থীরা জানে না একাত্তরে এই স্কুল মাঠে ট্রেনিং দেওয়ার ইতিহাস, তাদের কাছে তুলে ধরাও হয়নি কালিহাতির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ইতিহাসগুলোও। বরং শিক্ষার্থীরা তাদের জন্মের পর থেকেই কালিহাতিতে দেখে আসছে মাতৃভাষাদিবসসহ সকল জাতীয় দিবসেই সরকারিভাবে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে শহীদ মিনারে। ফলে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তরটি ভুল বলারও সুযোগ নেই। এভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার হচ্ছে না।
কিন্তু দেশের বেশিরভাগ উপজেলার মতো এখানেও মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ বা ‘স্মৃতিসৌধ’ নির্মিত হলে, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলে তাদের মধ্যে কোনও বিভ্রান্তি থাকতো না। তারা স্পষ্টভাবেই ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কিত করতে পারত।
টাঙ্গাইলকে বলা হয় রাজনীতির সূতিকাগার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী অগ্রগণ্য। আনোয়ারুল আলম শহীদ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও আবদুল কাদের সিদ্দিকীর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে এই বাহিনী সংগঠিত হয়। ১৮ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আর ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ছিল এই বাহিনীতে। টাঙ্গাইল ও আশপাশে এক হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তারা অভিযান পরিচালনা করত। কাদেরিয়া বাহিনী প্রায় ৭৩টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ নেয়। এই বাহিনীর বেসামরিক প্রধান ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ এবং সামরিক প্রধান ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে এই বাহিনী ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামেই পরিচিতি পায়।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় ছিল এই বাহিনীর সদর দপ্তর, আন্ধি গ্রামে ছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। বাহিনীটি পরিচালিত হতো সামরিক কায়দায়। সেখানে অর্থ বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ, রেডিও-টেলিফোন-যোগাযোগ বিভাগ, খাদ্য বিভাগ এবং বিচার ও কারা বিভাগও ছিল।
কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা দেশের ভেতরেই প্রশিক্ষণ নেন। গেরিলা যুদ্ধ সাধারণত ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। কিন্তু এ বাহিনী ‘হঠাৎ আঘাত, অবস্থান এবং অগ্রসর’ পদ্ধতি অনুসরণ করে গেরিলা যুদ্ধের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। তাৎপর্যের বিষয় হলো, একাত্তরে অধিকাংশ যুদ্ধেই তারা সফল হন। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অসংখ্য হানাদার সেনা ও তাদের দোসর নিহত ও আহত হয়। যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন এই বাহিনীর অনেক মুক্তিযোদ্ধাও।
কিন্তু এসব বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও শহীদদের স্মরণে স্বাধীনতার এত বছরেও সেখানে নির্মিত হয়নি কোনও স্মৃতিম্তম্ভ! এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে দাবি তোলা বা স্থানীয় উদ্যোগের খবরও জানা যায়নি। ফলে এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠবে— বাস্তব উদ্যোগ সেটা বলে না। সেটি হলে হয়ত ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদের স্মরণে সব উপজেলা ও স্কুল-কলেজে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হতো।
কালিহাতি উপজেলার উদাহরণ তুলে ধরলেও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ নিয়ে সারাদেশের চিত্রটিও বেশ হতাশাজনক। গত বছরের মার্চে বিডিনিউজ টেয়েন্টিফোর ডটকম-এ প্রকাশিত খবর বলছে, স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ নেই ২১ জেলার ৬১ উপজেলায়। সেখানে এখনও স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে ফুল দিতে হয় ভাষা শহীদ মিনারে।
এই ২১ জেলার মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে ঢাকা বিভাগের তিন জেলা মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। এই তিন জেলায় সদর উপজেলা ছাড়া অন্য উপজেলাগুলোতে শহীদ মিনার থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মরণে কোনও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি। এছাড়া স্বাধীনতার এত বছর পরেও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি নাটোর জেলার একটি উপজেলায়, ঝালকাঠিতে দুইটি, মাদারীপুরে চারটি, গাইবান্ধায় তিনটি, রাজবাড়িতে চারটি, ফেনীতে দুইটি, শরীয়তপুরে ছয়টি, লক্ষ্মীপুরে দুইটি, দিনাজপুরে সাতটি, ময়মনসিংহে একটি, জামালপুরে দুইটি, নওগাঁয় পাঁচটি, বরগুনায় একটি, জয়পুরহাটে তিনটি, বান্দরবানে পাঁচটি, কক্সবাজারে ছয়টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি, পিরোজপুরে পাঁচটি, চুয়াডাঙ্গায় একটি এবং টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায়।
মুক্তিযুদ্ধে স্মরণে সারা দেশের সব উপজেলায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণা থাকলেও এখনও সবখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত না হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ও আন্তরিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অথচ, ২০১৮ সালে স্বাধীনতা দিবসের আগে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছ থেকে ঘোষণা এসেছিল, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দেশের সব জেলা-উপজেলায় স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে। পাঁচ বছর পর তিনি আবারও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রশ্ন হলো, বিগত পাঁচ বছরেও তিনি কাজটি সম্পন্ন করতে পারলেন না কেন? কেন এখনও ২১টি জেলার ১৪২ উপজেলার মধ্যে ৬১টিতে মুক্তিযুদ্ধের কোনও স্মৃতিস্তম্ভ নেই? এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কি খুব কঠিন কাজ ছিল? সরকার চাইলে স্থানীয় উদ্যোগকে উৎসাহিত করেই এটি বাস্তবায়ন করতে পারত বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ-গবেষকরা।
একাত্তরের যোদ্ধারা পৌরাণিক কোনও চরিত্র নয়, বাংলার বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে।
কাজেই নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের চিত্র দেখাতে, তাদের মনে একাত্তরকে জাগ্রত রাখতে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে সব জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ করতে হবে। সারাদেশে তুলে ধরা হোক মুক্তিযুদ্ধের কথা, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা। প্রতিটি উপজেলায় নির্মিত হোক স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল-সন্ধ্যা’য়, প্রকাশকাল: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
© 2024, https:.