২৫ মার্চে ঢাকার গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিশেষভাবে কাজ করছেন বিদেশে বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ। অথচ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতেই পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যার শিকার হয় স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মানুষ। ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহর নিয়ে পথে নামে সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে কুখ্যাত অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে তারা শুরু করে গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার ইপিআর ব্যারাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, পুরান ঢাকার শাঁখরীবাজারসহ ঢাকা এবং সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়।
স্বাধীনতা লাভের এতকাল পরেও কালরাতের প্রথম প্রহরের শহীদদের তালিকা আমরা চূড়ান্ত করতে পারিনি। সংরক্ষণ করা হয়নি গণহত্যার অনেক স্থানও, যা মোটেই কাম্য ছিল না।
২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির ‘৭১ বর্বরতা’ শীর্ষক স্থাপনাশিল্প প্রদর্শনী থেকে নেওয়া। প্রদর্শনীটি হয়েছিল ২০১৮ সালে।
কেমন ছিল একাত্তরের ভয়াল সেই কালরাত? এমন প্রশ্ন নিয়েই সে রাতে পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন এমন কয়েকজনের মুখোমুখি হই। তাদের চোখে দেখার চেষ্টা করি রক্তাক্ত ২৫ মার্চকে।
রাজারবাগে মানবতা পদদলিত হয়েছিল
কনস্টেবল মো. আবু শামা সামাদ। একাত্তরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন । পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
তিনি বললেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের ভেতরের রক্তাক্ত ইতিহাস। তার ভাষায়, “রাজারবাগে তখন স্পেশাল আর্মড ফোর্সে ছিলেন সাড়ে পাঁচশর মতো সদস্য। তারা থাকতেন তৎকালীন চারতলা বিল্ডিংয়ে। নিচতলায় ছিল দুটি অস্ত্রাগার। আড়াইশ থেকে তিনশ সদস্য ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান প্রভেনশিয়াল রিজার্ভ ফোর্সে (ইপিপিআরএফ)। চারটি টিনশেড ব্যারাকে থাকতেন এই ফোর্সের সদস্যরা। ডিএসবি, এসবি, বিভিন্ন সোর্স ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে আসছিল নানা খবর। পাকিস্তানের আইএসআই গোয়েন্দা সংস্থা রাজারবাগকে সিরিয়াসভাবে টার্গেট করে রেখেছে। কারণ ইস্ট পাকিস্তানের বৃহত্তম পুলিশ লাইনস ছিল রাজারবাগ, যেখানে বাঙালি সদস্য ছিলেন সবচেয়ে বেশি।
রাজারবাগের প্রতিরোধযুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা কিন্তু নেতৃত্ব দেননি। সন্ধ্যার ঠিক পরের ঘটনা। তখনো পাকিস্তানের চাঁদতারা পতাকা উড়ছিল। আমরা ‘জয় বাংলা’ ও ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান তুলে ওই পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিই।
রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টা। একটা ওয়্যারলেস মেসেজ আসে তেজগাঁও এলাকায় প্যাট্রলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুলের কাছ থেকে। মেসেজে বলা হয়, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩৭ ট্রাক সশস্ত্র সেনা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট্রিও তখন পাগলা ঘণ্টি পেটায়।
অস্ত্রাগারে গিয়ে দেখলাম তালা মারা। সেন্ট্রি বলে, ‘হাশেম স্যার (সুবেদার আবুল হাশেম) তালা মাইরা চাবি নিয়া গেছে মফিজ স্যারের বাসায়।’ দৌড়ে গেলাম সেখানে। দেখি একটি ট্রাকের ভেতর মফিজ স্যার পরিবারসহ উঠে গেছেন। তাকে থামাই। অস্ত্রাগারের চাবি চাই। চাপের মুখে একটা অস্ত্রাগারের চাবি দেন।
ওই চাবি নিয়ে একটা অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দিই। রাইফেল দিয়ে আরেকটা অস্ত্রাগারের তালার মধ্যে গুলি করেন একজন। তবু তালাটা ভাঙে না। এরপর একটা শাবল দিয়ে ওই তালাটা ভেঙে ফেলি। ভেতরের অস্ত্রগুলো তখন যে যার মতো নিয়ে যায়।
প্যারেড গ্রাউন্ডে একটা গ্রুপ, ১ নম্বর ও ২ নম্বর গেট, মূল ভবনের ছাদ ও বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি আমরা।
রাত আনুমানিক ১১টা। পাকিস্তানি কনভয়ের ওপর শান্তিনগরে ডন স্কুলের ছাদের ওপর থেকে পুলিশ প্রথম গুলি চালায়। স্বাধীনতার পক্ষে ওটাই ছিল প্রথম বুলেট।
শাহজাহান, আব্দুল হালিম, ওয়্যারলেস অপারেটর মনির, গিয়াসউদ্দিনসহ পজিশনে থাকি মূল ভবনের ছাদে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজারবাগের দিকে ওরা আক্রমণ করে। আমাদের ১০টা গুলির বিপরীতে ওরা জবাব দিয়েছে প্রায় কয়েক হাজার গুলির মাধ্যমে। ওরা ট্যাংক, রকেট লঞ্চার ও হেভি মেশিনগান ব্যবহার করে। অল্প সময়ের ভেতর টিনশেডের ব্যারাকগুলোতে আগুন লেগে যায়। জীবন বাঁচাতে ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে।
ফজরের আজান দিচ্ছে তখন। আর্মিরা রাজারবাগের ১ ও ২ নম্বর গেট দুটি ট্যাংকের সাহায্যে ভেঙে ভেতরে ঢোকে। আসে ১০টি খালি ট্রাকও। এক থেকে দেড় শ পুলিশের লাশ পড়ে ছিল। ওগুলো ট্রাকে করে ওরা সরিয়ে ফেলে।
ছাদে উঠে টেনেহিঁচড়ে নামায় আমাদের। বেয়নেট দিয়েও খুঁচিয়েছে, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হাত ওপর দিকে তুলে মারতে মারতে নিচে নামিয়েছে। রাস্তায় ফেলে ক্রলিং করায়। নির্দয়ভাবে পেটায়ও।
দেখলাম একটা ময়লার ড্রেনে পড়ে আছে আমাদের ক্যান্টিন বয়। বয়স চৌদ্দর মতো। আর্মিরা তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে পিচঢালা রাস্তায় এনে আছড়ায়। তার মুখ ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে বলছিল, ‘পানি পানি’। এক পাকিস্তানি আর্মি পাশে নিয়ে প্যান্টের জিপার খুলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। ওই মুহূর্তটা খুবই খারাপ লাগছিল। একাত্তরে মানবতা প্রতি মুহূর্তে পদদলিত হয়েছে রাজারবাগে!”
ওরা পাখির মতো মারতে থাকে ঢাকার মানুষকে
সাইদুর রহমান প্যাটেল। তার বাড়ি পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে গিয়ে প্যাটেল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ গঠনসহ প্রথম দুটি ম্যাচে অংশ নেন। পরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। ২৫ মার্চ নিয়ে তিনি বলেন, “পাকিস্তানি সেনারা পাখির মতো মারতে থাকে ঢাকার মানুষকে। আমরা তখন লোহারপুলের ওপর ড্রাম, ভাঙা জিনিস, গাছের ডাল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করি। পাকিস্তানিদের গাড়ি যেন না আসতে পারে সে জন্য মনিজার রহমান গার্লস হাই স্কুল ও বাবুল লন্ড্রির সামনে তৈরি করি বড় গর্ত। গেণ্ডারিয়া স্টেশনের শ্রমিকদের নিয়ে জুরাইন ও দয়াগঞ্জের রেললাইনের কয়েকটা পাতও উপড়ে ফেলি।
সূত্রাপুর থানার ওসি তখন সিকদার। সেকেন্ড অফিসার সাত্তার খানের মাধ্যমে খবর পাই বাঙালি পুলিশ সদস্যদের আর্মস কেড়ে নিয়ে থানায় বসিয়ে রেখেছেন ওসি। সেনারা তখন সদরঘাটে হত্যা চালিয়ে লালকুঠির আর্মির সাব-ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছে। খুব কাছেই সূত্রাপুর থানা। তবু জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে আমরা ২৭ জন থানা আক্রমণ করি। অতঃপর থানা থেকে একটি রিভলবারসহ ৩১টি রাইফেল নিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসি ধূপখোলা মাঠে। তখন ভোর হয় হয়। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পাঁচ রাউন্ড গুলি ছুড়ে আত্মগোপনে চলে যাই। এর পরই পাকিস্তানি সেনারা রকেট লঞ্চার দিয়ে ব্যারিকেড উড়িয়ে গেণ্ডারিয়ায় ঢুকে অত্যাচার চালাতে থাকে। ২৭ মার্চ ওরা গুলি করে হত্যা করে ১৩ জনকে। এর মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির দুলালও ছিলেন।”
সোবহানবাগ মসজিদে ফেলে রাখা হয় খোকন ভাইয়ের লাশ
রুহুল আহম্মদ বাবু। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ৪ নম্বর সেক্টরে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে ইকবাল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক হল) পানির ট্যাংকের মাঠে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করেন ছাত্রনেতারা। বাবু সেখানে ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করেন। ২৫ মার্চের একটি অজানা ঘটনার কথা তিনি বললেন যেভাবে, “সন্ধ্যায় সিরাজ নামে একজন এসে বলে, ‘বাবু, আজ রাতে আর্মি নামব। যেভাবে পারছ ব্যারিকেড দে। কলাবাগান লেকের পাশে বড় একটা গাছ ছিল। এলাকার লোকজন নিয়া আমরা ওই গাছ কেটে রাস্তায় ফেলি। মনে তখন অন্য রকম স্পিরিট।
ঢাকা কলেজের উল্টো দিকে চিটাগাং হোটেল। সেখানে বসে বুন্দিয়া আর পরোটা খাচ্ছি। সঙ্গে মাহবুবুর রহমান সেলিম, আইয়ুব খান, আমার ছোট ভাই আর খোকন ভাই। রাত তখন আনুমানিক ১১টা। হঠাৎ গুলির শব্দ। খোকন ভাই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ধানমণ্ডিতে কে গোলাগুলি করে? বাবু চল তো, শেখ সাহেবরে পাহারা দিমু।’
আমাদের জিপের সামনে বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ লাগানো। বনেটের ওপর আমি বইসা আছি ওই ডামি রাইফেলটা নিয়া। পথে পাকিস্তানিদের সাঁজোয়া গাড়িগুলো সাইড দেয়। ওরা ভাবছে কোনো আর্মি অফিসারের গাড়ি হবে। আমরা দ্রুত কলাবাগানের বশিরউদ্দিন রোডে যাই। ছায়ানটের অফিস ছিল ওখানে। সেখানেই গাড়িটা রাখি।
বুঝে যাই কিছু একটা ঘটবে। পান্থপথে তখন ধানমণ্ডি লেকেরই একটা ডোবা ছিল। সেটা পার হয়ে ওপারে গিয়ে শেখ সাহেবের বাড়িতে যাব—এমনটাই পরিকল্পনা। রাস্তার পাশে ডোবার আড়ালে লুকিয়ে আমরা। প্রথম খোকন ভাই দৌড়ে রাস্তা পার হন। ওপারে গিয়ে হাতের টর্চটা জ্বালাতেই অজস্র গুলির শব্দ। কী হলো? দেখলাম তিনি মাটিতে পড়েই ছটফট করছেন। একসময় তা নিথর হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। আর্মিদের দুটি জিপ আসে। তার মুখে ওরা লাইট মেরেই বলে—‘শালা মার গিয়া’। তখনই রিয়ালাইজ করলাম—‘হোয়াট দ্য হেল’। আমরা যা করতে যাচ্ছি তা তো ছেলেখেলা নয়।
রাতেই লুকিয়ে বাসায় ফিরলাম। শরীরটা তখনো কাঁপছে। খোকন ভাইয়ের জন্য বুকের ভেতর চাপা কষ্ট। কারফিউ উঠলে আমরা লাশের খোঁজে বের হই। ওরা লাশটা সোবহানবাগ মসজিদের বারান্দায় ফেলে রেখেছিল। হাতটায় তখনো টর্চলাইট ধরা। গুলিতে আরেক হাত উড়ে গেছে। বাড়ি ফিরতেই আম্মা বললেন যুদ্ধে যাও।”
শাঁখারীপট্টিতে মানুষ পুড়ে চর্বি গলে পড়ে ছিল
একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য ‘বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা’য় অংশ নিয়েছিলেন অন্যতম ডেপুটি লিডার হিসেবে। বাবা চাকরি করতেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। সেই সুবাদে কামরুল আমান থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন তোলারাম কলেজের ছাত্র।
কামরুল আমান বললেন এভাবে, “২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতের মধ্যেই ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কারফিউ চলছিল। তা শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়েই রওনা হলাম ঢাকার দিকে। ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ। ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে ঢাকা থেকে। সবার মুখে লোক মরার খবর। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে সাত-আটজনের গলা কাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানে না। দেহ তখনো কই মাছের মতো নড়ছিল। এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কবজি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। কার লাশ এটা? কেউ জানে না। খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারীপট্টিতে। আহা রে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পোড়াইছে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারীপট্টির প্রবেশমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনো আগুন জ্বলছিল। একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে। মানুষ পুড়ে চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে, তাতে পড়েছে আমার পা। এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য কী হতে পারে!’’
একাত্তরে ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরও ১৯৭১ সালে যে সীমাহীন গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চায়নি পাকিস্তানের কোনো সরকার, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও। পাশাপাশি মিলেনি গণহত্যার আন্তজার্তিক স্বীকৃতি।
মাসখানেক আগে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি, নেদারল্যান্ডসের হেগে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) বাংলাদেশ বিবৃতি প্রদান করে। নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ সেখানে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে দেওয়া বিবৃতিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানির কথা প্রথমবারের মতো উল্লেখ করেন। এটি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে রেকর্ড হওয়ায় বাংলাদেশের গণহত্যায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল বা প্রমাণ হিসাবে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
এর আগে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’ শীর্ষক ৮ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাব তোলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে। এতে একাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
এছাড়া একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো পাকিস্তানিদের বর্বরতা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’। সেসব অপরাধ ও গণহত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করে নিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি।
২০২২ সালের প্রথম দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’ একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এসব উদ্যোগ গণহত্যা বা জেনোসাইডের আন্তজার্তিক স্বীকৃতি আদায়ে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।
তবে একাত্তরে গণহত্যার বিষয়ে উল্লিখিত উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিশেষভাবে কাজ করছেন বিদেশে বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ। অথচ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই বললেই চলে । এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে দীর্ঘপরিকল্পনা ও বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার অপরাধ প্রমাণের তথ্য-উপাত্ত ও প্রামাণ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ব জনমত গড়ার কার্যকরী উদ্যোগও নিতে হবে সরকারকেই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ মার্চ ২০২৪
© 2024, https:.