মুক্তিযুদ্ধ

১০ খেতাবধারীর অসীম সাহসের আখ্যান ‘বীরত্বে একাত্তর’

একাত্তরে মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের বিজয়ের পেছনে ছিল বহু মুক্তিযোদ্ধার দুঃসাহসী অংশগ্রহণ। সর্বসংহারী যুদ্ধে তাঁরা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে ছিলেন সদা প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে দেশমাতৃকার সেই সাহসী সন্তানদের সম্মানিত করে বীরত্বসূচক খেতাব দিয়ে। বীরশ্রেষ্ঠ, বীর-উত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক—এই চার স্তরে মোট ৬৭৬ জনকে খেতাবে ভূষিত করা হয়। রাষ্ট্রীয় এই খেতাব নিঃসন্দেহে অকুতোভয় শ্রেষ্ঠ মানুষদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত কৃতজ্ঞতারই প্রকাশ। স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে তুলে ধরেছেন বীর-উত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মোট ১০ জন বীরের অসীম সাহসের আখ্যান।

মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ছিল অদম্য সাহস

বীর-উত্তম লিয়াকত আলী খান, ছবি: সালেক খোকন

বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার আমলাপাড়ায়। একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফ্লাইং অফিসার। মে মাসে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে ঢাকায় ফিরে চলে যান কলকাতায়। এয়ারফোর্সের জঙ্গি পাইলট হয়েও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে।

কমলপুর বিওপি (বর্ডার পোস্ট), সিলেটের কমলগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট প্রভৃতি অপারেশনে অংশ নেন।

একাত্তরের জুন মাসটি তখনো শেষ হয়নি। ওসমানী সাহেব অর্ডার পাস করলেন—‘ফাস্ট বেঙ্গল উইল অ্যাটাক কমলপুর বিওপি (বর্ডার পোস্ট)।’ চারটি কম্পানি ছিল—আলফা, ব্রাভো, চার্লি ও ডেলটা। অ্যাডজুট্যান্টের দায়িত্বের পাশাপাশি আমাকে হেডকোয়ার্টার কম্পানিরও কমান্ড করতে হতো।

বিওপি অ্যাটাকের আগে রেকি হলো। ক্যাপ্টেন মান্নান ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মুমতাজ ছিলেন খুব সাহসী। এক রাতে তাঁরা কমলপুর বিওপির ভেতরে ওদের ট্র্যান্স পজিশন জানতে যায়। এক পাঞ্জাবি সালাউদ্দিনকে ধরে ফেলে।

পরে মান্নানের সহযোগিতায় ওই পাঞ্জাবিকে মেরে ক্যাম্পে ফিরে আসে।

কিন্তু এতে পাকিস্তানিরা আমাদের অ্যাটাকের পরিকল্পনা জেনে যায়। ফলে ওরাও বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের ডেলটা কম্পানি অপারেশনে লিড করবে। তার সাপোর্টে থাকবে ক্যাপ্টেন হাফিজের (হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ) ব্রাভো কম্পানি।

আলফা কম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন মান্নান স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের চার্লি কম্পানি কাট-অফ পার্টি হিসেবে কাজ করবে। আর আমি থাকব হেডকোয়ার্টার কম্পানিতে।

নিয়মটা হচ্ছে আর্টিলারি ছোড়া শুরু হলে শত্রু তখন হেডস-ডাউন করে ফেলে। কারণ আর্টিলারির তোড়ে তারা মাথা উঁচু করতে পারে না। আমরা বেশ পেছনে ছিলাম। ফলে বোম্বিং শেষ হয়ে গেলে ওরা বাংকার থেকে উঠে মেশিনগান নিয়ে পজিশনে চলে যায়। আমরা ওদের ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতর চলে গেলাম। তখন  গোলাগুলিতে ৭৫ জন আহত ও ৩৫ জন স্পটেই শহীদ হয়।

ওই অপারেশনে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন তার গ্রুপ নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের টার্গেটে পড়ে যায়। তখন কমান্ডিং অফিসার মঈন সাহেব আমাকে বললেন, ‘লিয়াকত, ইউ টেক দিস ট্রুপস অ্যান্ড গো।’

আমি তখন হেডকোয়ার্টার্স ট্রুপস নিয়ে দৌড়ে ওই গোলাগুলির মধ্য দিয়ে ছুটে যাই সালাউদ্দিনের কাছে।

তার আগেই মেশিনগানের গুলিতে দেখলাম তার ওয়্যারলেসম্যানের বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। মেশিনগানের গুলিতে সালাউদ্দিনও উপুর হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তাকে ধরতে ক্রলিং করে আমি এগোতে থাকি। পাশে তাকিয়ে দেখি দূরে ক্যাপ্টেন মান্নান মাটিতে গড়াচ্ছে আর ডাকছে। কোনো রকমে তার কাছে সরে আসি। মান্নানের ঊরুতে গুলি লেগে রক্তাক্ত। তাকে কাঁধে নিয়ে পেছনে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকি।

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ওখানেই মারা যায়। সে খুবই সাহসী ছিল। অপারেশনের শুরুতেই চোঙা নিয়ে চিৎকার করে মুক্তিযোদ্ধাদের বলছিল, ‘আয় সামনে আয়, কিচ্ছু হবে না। এগিয়ে যা।’ রক্তাক্ত ওই অপারেশনটির কথা এখনো মনে দাগ কেটে আছে।

সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা মুভ করে চলে যাই সিলেটের কমলগঞ্জে। তখন আমাদের কমান্ডার চেঞ্জ হয়ে আসেন জিয়াউদ্দিন। ওই সময় নানা ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আমরা আরো শক্তিশালী হতে থাকি।

২৫ নভেম্বর ১৯৭১। আমরা কানাইঘাট থানা সদরের অদূরে গৌরীপুরে অবস্থান নিই। ২৬ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। প্রথমে আমরাও সাহসের সঙ্গে তা মোকাবেলা করি। ওখানেই অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (বীর-উত্তম) পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। তখন আমাকে ওই কম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে কানাইঘাটেই এক অপারেশনে বাঁ পায়ের ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হই।

পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রজন্মকে বলব, ‘তোমাদের হাতেই যাবে দেশের নেতৃত্ব। তোমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা সব সময় মনের ভেতর রেখো। এ দেশে প্রপার ডেমোক্রেসি থাকবে—এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তোমরাই পারবে দেশটা এগিয়ে নিতে।’

জীবনটাকে বাজি রেখেই লড়াই করেছি

বীরবিক্রম ইমাম উজ-জামান, ছবি: সালেক খোকন

জন্ম সিলেটের বিয়ানীবাজারের উজানঢাকি গ্রামে। একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখে গুলি করা হয় তাঁকে। তিনটি গুলি লাগলেও তিনি বেঁচে পালিয়ে চলে যান ভারতে।

২ নম্বর সেক্টরের অধীনে প্রথমে আলফা কম্পানির অধিনায়ক হিসেবে কুমিল্লা, লাকসাম, চাঁদপুর প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেন। পরে রাঙ্গামুড়া সাবসেক্টরে কমান্ডার হন। যুদ্ধকালীনই তিনি লেফটেন্যান্ট হন।

১৭ এপ্রিল প্রথম অ্যামবুশ করি কুমিল্লা-লাকসামের মাঝামাঝি বাগমারা নামক স্থানে। সকাল তখন ১০টা হবে।পাকিস্তানি সেনারা ওইপথে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা যাচ্ছিল। অ্যামবুশের ভেতর আসতেই ওদের চারটি গাড়ি উড়িয়ে দিই। গোলাগুলিতে ওদের ৬০-৭০ জন হতাহত হয়। ওরা আর্টিলারি ছুড়লে আমরাও টিকতে না পেরে বাগমারা ছেড়ে আলিশ্বরে অবস্থান নিই।

আমাদের ১৪ জন শহীদ হয়।বিমান থেকে হামলা করে পাকিস্তানিরা। তখন চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এলাকায় সরে যাই। এপিলের শেষে পাকিস্তানিরা মিয়াবাজারে আবার হামলা করে। তখন চৌদ্দগ্রাম এসে চতুর্পাশে ডিফেন্স নিলাম। মে মাসের ৭-৮ তারিখ খালেদ মোশাররফ এসে বললেন, যেভাবেই হোক দখল ধরে রাখতে হবে। উনি ছয়টি মর্টারসহ একটা মর্টার প্লাটুন সঙ্গে দিলেন।

১৪ মে শুক্রবার কুমিল্লা, লাকসাম ও ফেনীর দিক থেকে চৌদ্দগ্রামে পাকিস্তানিরা ত্রিমুখী আক্রমণ করে। দুপুর ১টায় আক্রমণ করে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে ওই যুদ্ধ। ঠেকিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পরে সরে যাই ভারতে।

এরপর বিএসএফের সহযোগিতায় আমরা রাঙ্গামুড়ায় ফরেস্টের ভেতরে নতুন ক্যাম্প স্থাপন করি। আগের তিনটি প্লাটুন ছাড়াও সেখানে ছিল মর্টার প্লাটুনের ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা। সাফায়াত মার্টার প্লাটুনের কমান্ডার। পরে ওটাই আলফা কম্পানির রাঙ্গামুড়া সাবসেক্টর হয়।

জুন মাস থেকে বিলোনিয়া মুক্ত রাখি আমরা। কিন্তু জুনের ২১ তারিখে পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টার দিয়ে পেছনে সৈন্য নামিয়ে দেয়। সামনে ও পেছনে দুদিক থেকে তখন আক্রমণের শিকার হই। ফলে সরে আবারও ভারতের রাঙ্গামুড়া সাবসেক্টরে চলে আসি। এরপর কুমিল্লা, লাকসাম ও ফেনীর রেললাইন উপড়ানো এবং চোরাগোপ্তা হামলা করে সরে পড়তাম আমরা। এভাবে জীবনকে বাজি রেখেই প্রাণপণ লড়াই করেছি রণাঙ্গনে।

অক্টোবর মাসে আবারও বিলোনিয়ায় যাওয়ার নির্দেশ আসে। এবার সঙ্গে ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মি। নভেম্বর মাসেই আমরা বিলোনিয়া মুক্ত করি। ৩ ডিসেম্বরের পর সেখান থেকে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই। ফেনী মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। এরপর ফোর বেঙ্গল, টেন বেঙ্গল আর ইন্ডিয়ান আর্মির থার্টি ওয়ান জাট আর থার্টি টু মাহার—এই চারটি ব্যাটালিয়ন মিলে আমরা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হই। টেন বেঙ্গলের কমান্ড করতেন মেজর জাফর ইমাম। টুয়াইসি ছিলেন ক্যাপ্টেন শহিদ। রাঙ্গামুড়া সাবসেক্টর বিলুপ্ত করে ফেনীতে যখন আসি তখনই ওটা টেন বেঙ্গলের আলফা কম্পানি হয়ে যায়।

মিরসরাই, সীতাকুণ্ড হয়ে আমরা কুমিরায় পৌঁছি। পথে পথে চলে যুদ্ধ। পরে টেন বেঙ্গল কুমিরা থেকে বাঁ দিকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হাটহাজারীর চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির দিকে অবস্থান নেয়।

১৬ ডিসেম্বর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির মাঝখানের রাস্তাটা ব্লক করার। বিকেলের দিকে রোড ব্লকের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখনই অধিনায়ক জাফর ইমাম ওয়্যারলেসে বললেন, ‘পাকিস্তান আর্মি আত্মসমর্পণ করেছে।’ শুনে কি যে আনন্দ লেগেছে! ওই আনন্দের কথা এখন ঠিক বোঝাতে পারব না।

ভালো কাজের প্রতি ঐক্যবদ্ধতা আর পারস্পরিক সহনশীলতা থাকলেই দেশটা পাল্টে যাবে। আগামী প্রজন্মের উদ্দেশে বলব, ‘তোমার মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের ইতিহাসটি জেনো রেখো। দেশের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকো। তোমাদের হাত ধরেই তৈরি হবে সত্যিকারের উন্নত বাংলাদেশ।’

অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল

বীরপ্রতীক হাবিবুল আলম, ছবি: সালেক খোকন

বাড়ি ঢাকায়, দিলু রোড, নিউ ইস্কাটনে। একাত্তরে ভারতের মতিনগর ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নেন দুই নম্বর প্লাটুনে। পরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ঢাকার গেরিলা হিসেবে দুই দফায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ফার্মগেট, ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর ও ঢাকার পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়াসহ বেশ কিছু অপারেশনে অংশ নেন। পরে তিনি কে-ফোর্সে জয়েন করেন

মে ১৯৭১। আমরা তখন মতিনগর ক্যাম্পে। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ডেকে ঢাকায় একটি অপারেশন করার নির্দেশ দেন। আমার দুই নম্বর ও মায়ার তিন নম্বর প্লাটুন থেকে বাছাই করে ১৭ জন ঠিক করলাম। আমিসহ ওই তালিকায় ছিল মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীন, মাহবুব আহমদ (শহীদ), শ্যামল, ভাষণ (অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে), আনোয়ার রহমান (আনু), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), ফতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাঈদ খান, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ, গাজী গোলাম দস্তগীর, তারেক এম আর চৌধুরী, নজিবুল হক, ধানমণ্ডির রেজা, আড়াইহাজারের আবদুস সামাদ, রূপগঞ্জের জব্বার ও ইফতেখার।

অপারেশনের নাম—‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হিট এন্ড রান।’ খবর ছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম ও ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান এসে সেখানে উঠবেন। পাকিস্তান সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে ঢাকায় সব কিছু স্বাভাবিক এবং তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। টার্গেট ছিল ধারণাটাই পাল্টে দেওয়ার।

পাশাপাশি জানানো হয় ঢাকা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।কিন্তু অপারেশন করতে এমন কাউকে লাগবে যে ভালো গাড়ি চালাতে পারে। তখন ভাষণ বলল, তার এক মামা আছেন, নাম মুনির আলম মির্জা (বাদল)। ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে। এ ছাড়া শহীদুল্লাহ খান বাদল বলেছিল ঢাকার ছেলে কামরুল হক স্বপনের কথা। এ দুজনকেই সঙ্গে নিলাম।

৯ জুন ১৯৭১ তারিখে প্রথম গুলশানে যাই। তখন ডাকসান ১০০০ মডেলের নীল রঙের একটা গাড়ি একজন চালিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ওটা চেজ করি। বাদল ভাই দ্রুত গাড়ির ড্রাইভারকে সরিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর চলে আসি সিদ্ধেশ্বরীতে, বাদল ভাইয়ের বাড়িতে।

সিদ্ধেশ্বরী থেকে শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে রওনা দিই মাগরিবের ঠিক আগে। হোটেলের সামনে ছিল একটা বড় গাছ। ওই গাছটির সামনে আসি। হঠাৎ সাইরেন বাজার শব্দ পাই। দেখি পুলিশের এসকর্ট গাড়ি ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে। পেছনে একটি বা দুটো সাদা শেভ্রোলেট গাড়ি নজরে এলো। বুঝে যাই ওই গাড়িতেই রয়েছে বিশ্বব্যাংকের অতিথিরা। গাড়িগুলো আমাদের পাশ দিয়েই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢোকে।

মেইন রোডে হোটেলের ছোট গেটে এসে আমাদের গাড়ি থামে। বাদল ভাইকে বললাম আপনি গাড়ি স্টার্ট করেই রাখেন। স্বপন বের হলো, আমি বাঁ পাশ ও মায়া ডান পাশ থেকে বের হলাম। জিয়াও বের হয়ে আসে। জিয়া, মায়া ও আমার কাছে গ্রেনেড।

আমি গ্রেনেডের পিন খুলতেই দেখি জিয়া তার হাতের একটি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে। সাদা শেভ্রোলেট গাড়িটি উল্টে গেল। আমি দ্বিতীয় গ্রেনেড আর মায়া ছুড়ল তৃতীয় গ্রেনেডটি। এর মধ্যে জিয়া তার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি সদরুদ্দিনের গাড়ির ওপরে ছুড়ে দেয়। গ্রেনেডটি গাড়ির পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিস্ফোরিত হয়। দেখলাম গাড়ির পেছন দিকটা একটু ওপরে উঠেই আবার নিচে পড়ে গেল।

ভেতরে ছিল ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ ও আর্মি। তারা ফায়ারিং শুরু করার আগেই দ্রুত গাড়ি নিয়ে সরে পড়ি। বিবিসিসহ এবিসি, অলইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকা খবরটি সম্প্রচার করে। ওই অপারেশনের কারণেই প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ও তার টিম ভয়ে দ্রুত করাচি ফিরে যায়। ফলে ঢাকার ভেতরে প্রথম ওই অপারেশনটিতে পুরোপুরি সফল হয়েছিলাম।

প্রজন্মের উদ্দেশে আমি শুধু বলব, ‘আল্লাহ সব কিছুর বিকল্প দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিসেরই বিকল্প নেই। সেটা হচ্ছে পড়ালেখা। তাই তোমাদের প্রথম দায়িত্ব লেখাপড়া করা, দ্বিতীয় দায়িত্ব লেখাপড়া করা, তৃতীয় দায়িত্বও লেখাপড়া করা।’

নড়াইলে আমরা বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ ওড়াই

বীরপ্রতীক গোলাম আজাদ, ছবি: সালেক খোকন

বাড়ি নড়াইল জেলার লোহাগড়ার ইতনা গ্রামে। ভারতের বিহার চাকুলিয়ায় ট্রেনিং নেন। মুক্তিযুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাবসেক্টরে। এম এইচ সিদ্দিকীর (কমল সিদ্দিকী) নেতৃত্বে গঠিত জি-ফোর কম্পানিতে একটি প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে অপারেশন করেছেন মাগুরায় বুনোগাতি বাজার, লোহাগড়া থানা, কালনাঘাট, কুমোরডাঙ্গা, নড়াইল ও ভাটিয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকায়

আমাদের পুরো কম্পানি মার্চ করে চলে আসে মাগুরায়, বুনোগাতি বাজারে। লোকজন জানায়, পাশেই এক স্কুলে রাজাকারদের ক্যাম্প। আশপাশের গ্রামগুলোতে অত্যাচার চালায় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে। আমরা তখন ওই ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা করি।

আক্রমণের পুরো প্ল্যানটি করেন কমল সিদ্দিকী স্যার।দুটি প্লাটুন সামনের দিক থেকে আক্রমণ করবে। তাদের ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে শক্ররা। তখন বিনা বাধায় আমি প্লাটুন নিয়ে পেছন দিক দিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে যাব। কিন্তু ইনফরমেশন ভুল ছিল।

খুব ভোরে গোলাগুলি শুরু হলে পেছনে যেতেই দেখি ওদের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকার। সামনের দিকে গোলাগুলি হলে ওরা হতভম্ব হয়ে পেছনের বাংকার থেকে এলোপাতাড়ি ফায়ার করতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর একটা গ্রেনেড ওদের বাংকারে থ্রো করি। অমনি ধুম করে বিকট শব্দ হয়। বাংকারে শুনি কয়েকজনের গোঙানির শব্দ।

তখনই ওদের ক্যাম্পে উঠে পড়ি। ভেতরে থাকা রাজাকারদের সারেন্ডার করিয়ে এক ঘরে আটকে রাখি। সব আর্মসও জড়ো করে রাখি আরেক রুমে।সামনের গ্রুপ দুটি ক্যাম্পের দিকে তখনো গুলি করছিল। খানিক পরে এক ইপিআর ক্যাম্পে ঢুকেই দেখে আমার কাণ্ড। সবাইকে সারেন্ডার করিয়ে বসে আছি। তিনি খুব অবাক হন। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘গুলি বন্ধ করো। দারা সবাইকে সারেন্ডার করিয়েছে।’ ওই অপারেশনে আমার সাহস দেখে কমল সিদ্দিকী স্যার খুব বাহবা দিয়েছিলেন। দিনটির কথা মনে হলে এখনো অন্য রকম লাগে।

আমাদের গ্রাম থেকে ভাটিয়াপাড়া নদীর ওপারে, গোপালগঞ্জে। ওখানে পাকিস্তানিদের ওয়্যারলেস সেন্টার। তখন ঢাকা থেকে খুলনা ও যশোর ওয়্যারলেসেই কানেক্ট ছিল। ওটা নষ্ট হলে আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সব যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাবে।

একবার খবর আসে লঞ্চে পাকিস্তানি আর্মিরা লোহাগড়া নদী পার হয়ে কালনাঘাটের দিকে যাবে ডিজেল সাপোর্ট দিতে। আমরা পরিকল্পনা করি ওই রুটে ওদের ঢুকতে না দেওয়ার।

সকাল তখন ৮টার মতো। কালনাঘাটে নদীর পারে বাংকারের মতো করে পজিশন নিয়ে থাকি। পরিকল্পনা হয় সবাই একসঙ্গেই গুলি করার। যাতে ওরা নদী পার হতে না পারে। রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার ওপেন করি। প্রত্যুত্তরে ওরা হাজার হাজার গুলি ছোড়ে। গুলিগুলো এসে লাগে মাটিতে। আমাদের গুলিতে ওদের ছয়জন সেনা মারা পড়ে।

সকাল তখন ১০টার মতো। আক্রমণের কারণে ওরা এগোতে পারে না। ফলে ব্যাক করে। ডিসেম্বরের ৮, ১৯৭১। ভোরবেলায় লোহাগড়া থানার দক্ষিণ সাইডে পজিশন নিয়ে থাকি। সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও যুক্ত হয়।  হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। বাঁ পাশে ছিল সহযোদ্ধা মোস্তফা কামাল, বাড়ি যশোরে। একটা গুলি এসে ওর কানের দিক দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায়। ‘মা গো’ বলেই সে ছিটকে পড়ে। শরীরটা কয়েকটা ঝাঁকি দিয়েই নিথর হয়ে যায় তার দেহ।

সহযোদ্ধারা এগিয়ে এলে আমি থানার দিকে এগোই। চারপাশে ট্রেন্স করা। একদিকে চোখা করে বাঁশ গেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার পাশেই আবার কাঁটাতারের বেড়া। কারো ঢোকার সাধ্য নেই। কিন্তু আমার মনে তখন সহযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধের আগুন। ঢুকে পড়ি থানার ভেতরে। অন্য পাশ দিয়ে ঢোকে মোক্তারও। টার্গেট ছিল পুলিশের খালেক। ওকে পেয়েই মেরে দিই। পরে পুরো থানা দখলে চলে আসে।

বোমা ওদের চলন্ত ট্রাকের ওপর গিয়ে পড়ে

বীরপ্রতীক আবদুল হাকিম, ছবি: সালেক খোকন

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার মেদুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। একাত্তরে ছিলেন সেনাবাহিনীর সিপাহি, আর্মি নম্বর-৩৯৩৩১৭৫। ১১ নম্বর সেক্টরের কাদেরিয়া বাহিনীতে হাকিম কম্পানির কমান্ডার তিনি। অপারেশন করেছেন টাঙ্গাইলের দেওপাড়া, ধলাপাড়া, সরাবাড়ী, সাগরদীঘি, ইছাপুরা প্রভৃতি এলাকায়

আমাদের অস্ত্র ছিল রাইফেল, স্টেনগান আর গ্রেনেড। তখনো ভারত থেকে কোনো অস্ত্র আসেনি। থানাগুলোতে আক্রমণ করে অস্ত্র সংগ্রহ করে তা দিয়েই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পরে ভারতে থেকে অনেক অস্ত্র পাই। হাকিম কম্পানি নামেই সবাই চিনত।

১৭ আগস্টের ঘটনা। পাকিস্তানি সেনারা এক রাস্তা দিয়া টাঙ্গাইলের সাগরদীঘির দিকে অগ্রসর হয়। আমরা ওদের ঠেকানোর চেষ্টা করি। পাহাড়ি পথ।

অ্যামবুশ করি রাস্তার উত্তর পাশে। ওরা এলে গোলাগুলি শুরু হয়। তখনই বোম্বিং শুরু করে। থ্রি ইঞ্চি মর্টারের একটি স্প্লিন্টার এসে লাগে আমার পিঠের ডান সাইডে। পিটের কিছু অংশ কেটে সেটা বেরিয়ে যায়।

  রক্ত পড়ছিল অনবরত। সঙ্গে ছিল আবুল হোসেন নামে এক ডাক্তার। পিঠে জখমের প্রাথমিক চিকিৎসা তিনিই করেন।

কাদের সিদ্দিকী আহত হয়ে চলে যান ভারতে। লোক মারফত তিনি খবর পাঠান, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত  যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। আমরা তখন জামালপুরের গারামারার চর হয়ে চলে যাই ভারতে। তুরাতে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে চলে আসি মানকাচরে। অস্ত্রবোঝাই ১৮টি নৌকা নিয়ে রওনা হই। ২৪ সেপ্টেম্বরে নৌকাগুলো নিয়ে চলে আসি চর কবরিবাড়ি, সরিয়াবাড়ীতে।

কাদেরিয়া বাহিনীর উত্তর টাঙ্গাইলের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ভুয়াপুরে (ভূঞাপুর) পাকিস্তানি সেনারা বিমান থেকে বোমা ফেলে। এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯ জন মারা যায়। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমরা যাই ঘাটাইলে। সেখানে বোম্বিং করি থানার ভেতরে। এতে অনেক পাঞ্জাবি ও রাজকার মারা পড়ে।

স্বাধীনতা লাভের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আমরা তখন মোগলপাড়া স্কুলে। খবর আসে টাঙ্গাইল থেকে পাঞ্জাবিরা ময়মনসিংহের দিকে যাবে। ইছাপুরায় ওদের ঠেকাতে হবে। রাত তখন ৪টা হবে। মোগলপাড়া থেকে রওনা হয়ে দ্রুত ইছাপুরায় গোরস্তানে এসে পৌঁছি। সঙ্গে ছিল থ্রি ইঞ্চি মর্টার। যার একটা অংশ ৭৫ পাউন্ড, একটা ৬৫ পাউন্ড ও আরেকটা ৪৫ পাউন্ড। অন্যান্য আর্মস ও অ্যামুনেশনও ছিল।

গোরস্তানের উত্তর পাশে ছিল একটা কাঁঠালগাছ। ওখানেই থ্রি ইঞ্চি মর্টার সেট করি। ১৯৫০ গজ হলো ওই মর্টারের রেঞ্জ। মর্টার সেট করার সঙ্গে সঙ্গে দেখি পাঞ্জাবিবোঝাই কয়েকটা ট্রাক আসছে। তখন মজনুকে বললাম একটা বোমা ফায়ার কর। বোমা ওদের চলন্ত ট্রাকের ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে ট্রাকটা উল্টে যায়। পেছনে থাকা ট্রাকও থেমে যায়। আমরা ক্রমাগত বোমা ও গুলি করতে থাকি। চারদিকে আগুন আর আগুন। ফলে ভয়ে পাঞ্জাবিরা আর অগ্রসর হতে পারে না।

পরে পেছন দিক থেকে গাড়ি নিয়ে আসে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সন্দ সিং বাবাজি। তিনি এসে আমাদের থ্রি ইঞ্চি মর্টারটি দেখলেন। মর্টারের টেলিস্কোপ সাইড নেই, ডিগ্রি উঠানামারও কোনো কিছুই নেই। শুধু একটা ট্রাইপট আছে। এ অবস্থায় কিভাবে ফায়ার করা সম্ভব!

আমাকে ডেকে বললেন, ‘হাউ হ্যাব ইউ ফায়ার।’

আমি বলি, ‘ওপিজি গড।’ মানে আল্লাহ নিজেই অবজারবেশন পোস্টে কাজ করেছেন।

শুনে তিনি পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘সাববাশ বাঙালি।’ তার এই কথাটা এখনও কানে বাজে।’

১০ তারিখে পিটিআই স্কুলে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়াই

বীরপ্রতীক কাজী জয়নাল আবেদীন, ছবি: সালেক খোকন

নোয়াখালী জেলার সেনবাগের দেবীসেনপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। একাত্তরে তিনি বিমানবাহিনীর এয়ারম্যান ছিলেন। যুদ্ধ করেছেন প্রথমে জেড ফোর্সের ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সে। পরে ১১ নম্বর সেক্টরে, কামালপুর ক্যাম্পের কমান্ডার হন।

একাধিক অপারেশনে অংশ নেওয়াসহ ধানুয়া কামালপুরে পাকিস্তানি আর্মিদের আত্মসমর্পণে অংশ নেন

আমাদের ক্যাম্পের ওপরে পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই আক্রমণ করত। একদিন ভোর ৫টার দিকে সব বাংকার ও ট্রেন্সে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যালার্ট করে দিই। এরপর ৪ নম্বর বাংকারে চলে আসি। ওটা ছিল কামালপুরের মুখোমুখি।

দেখলাম পাকিস্তানি সেনারা অ্যাডভান্স হচ্ছে লেলিং পজিশনে। বাংকারে হেলালুজ্জামানসহ চার-পাঁচজন। পাকিস্তানিরা ১০-১২ জন। রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ারিং শুরু করে দিই।

ডানে ৫ নম্বর বাংকারসহ অন্যান্য বাংকারে ছিল এলএমজি। সবগুলো গর্জে ওঠে। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে।

মাঝেমধ্যে ইন্ডিয়ান আর্মির পরিকল্পনায় সামনে গিয়েও আক্রমণ করেছি। মেজর সলো সিং ও ক্যাপ্টেন গোকলে ছিলেন।

আমাকে খুব পছন্দ করতেন। পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমণ করলে পেছন দিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ওদের রিএনফোর্সমেন্ট আসত। তাই একদিন ইন্ডিয়ান আর্মিদের সঙ্গে গোপনে কামালপুরের পেছনের দিকে অ্যামবুশ করি।

সাধারণত রাস্তার এক পাশে অ্যামবুশ করতে হয়। কিন্তু ওইদিন আমরা করলাম দুই পাশে। ইন্ডিয়ান আর্মির প্রায় প্রত্যেকের কাছে বেলচা থাকত। তারা যেখানে যেত, সেটা দিয়ে গর্ত করে পজিশন নিত। গর্তের ভেতর সাপ যেমন তেমনি গর্তের ভেতর যোদ্ধাও বিপজ্জনক।

আমাদের একটি কম্পানি কামালপুর আক্রমণ করে উত্তর দিক থেকে। আমরা দক্ষিণ দিকে কামালপুর-বকশীগঞ্জ রোডে অ্যামবুশ করে অপেক্ষায় আছি। ওদের রিএনফোর্সমেন্ট আসবে বকশীগঞ্জ থেকে, এ পথ দিয়েই। ওরা রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার শুরু হয়। ওদের তখন পালানোরও পথ ছিল না। কারণ রাস্তার ডানেও আমরা, বাঁয়েও। অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা যায় ওই দিন।

নভেম্বরের শেষ দিকেই আমরা কামালপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্পের পেছনের দিক ঘিরে রাখি। সেক্টর কমান্ডার তখন ক্যাপ্টেন আজিজ। কিন্তু অপারেশনটা আমরা করি ইন্ডিয়ান আর্মির নির্দেশে। ওখানে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের সাপোর্ট আসতে পারে না। রেশন আসাও বন্ধ হয়ে যায়। গোলাবারুদ কমতে থাকে। তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আমরা তাদের ওপর গুলি করছি। কিন্তু ওরা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে না। ইন্ডিয়ান আর্মি শেলিংও করল। কিন্তু ওদের কোনো সাড়া নেই।

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ওদের ক্যাম্পে একটা চিঠি পাঠানো হলো। লেখা ছিল এমন— ‘তোমাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালানোর পথ নাই। সারেন্ডার করো।’ মুক্তিযোদ্ধা বশিরকে দিয়ে ওই চিঠিটি পাঠান ব্রিগেডিয়ার ক্লিয়ার। কিন্তু বশির গিয়ে আর ফিরে আসে না। সবার মধ্যে তখন উত্তেজনা। মুক্তিযোদ্ধারা চাচ্ছে ভেতরে ঢুকতে। পরে আরো একটি চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় আনিসুল হক সজ্জুকে। সন্ধ্যার দিকে সবাই বের হয়ে আসে। সঙ্গে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ও তার নেতৃত্বে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা। ওরা সারেন্ডার করে বানরোডের ওপরে, ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে।

এরপর এক কম্পানি ফোর্স নিয়ে আমি বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে দেওয়ানগঞ্জ এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখ জামালপুর মুক্ত করি। সেখানে পিটিআই স্কুলে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়াই এবং শত শত মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠ আকাশে তুলে গায়—‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’। পরে টাঙ্গাইল হয়ে তিনি চলে যান ময়মনসিংহে।

বাঁচা ছিল অ্যাকসিডেন্ট মরাই ছিল স্বাভাবিক

বীরপ্রতীক নূর উদ্দিন আহমেদ, ছবি: সালেক খোকন

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায়, সাতাইহাল গ্রামে তাঁর জন্ম। একাত্তরে ভারতের ওমরানগরে দেড় মাস ট্রেনিং করেন। অতঃপর ৪ নম্বর সেক্টরে প্রথমে কুকিতল সাবসেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেন জকিগঞ্জ আটগ্রাম ব্রিজ, লাঠিটিলা বর্ডার, দিলকুশা চা-বাগান, ছোটলেখা চা-বাগানে এবং পরে জালালপুর সাবসেক্টরের অধীন কানাইঘাটের মনিপুর ক্যাম্প এলাকায়

লাঠিটিলা বর্ডারে ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের একটা ক্যাম্প। ওখানে আক্রমণ চালাতে হবে। রেকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। গোপনে ওই এলাকায় গিয়ে লোক মারফত নানা তথ্য নিয়ে রেকি করি। ভিন্নভাবে আরো দুজনও রেকি করে। পরে দু-তিনটা রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা হয় ।এভাবেই ঠিক হয় টার্গেট।

রাতে আমরা পজিশন নিয়ে ভোরে আক্রমণ করি। মিত্রবাহিনী পেছন থেকে আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়। দুদিক থেকে আক্রমণ চলে।

ওই ক্যাম্পে সাতজনের মতো পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। ওরা পাল্টা আক্রমণও চালায়। কিন্তু তার আগেই সফলভাবে ফিরে আসি।

আমরা তখন কুকিতল ক্যাম্পে। আর দিলকুশা চা-বাগানে পাকিস্তান আর্মিদের শক্তিশালি ঘাঁটি।

ওই ক্যাম্পে মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। আশপাশের গ্রামে ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দিত। আমাদের ক্যাম্প কমান্ডার রুহুল আহমেদ বাবুর সিদ্ধান্ত ওই ক্যাম্পে অপারেশন করতে হবে।

সহযোদ্ধা শামসুল হক রেকি করে সব খবর এনে দেন। অপারেশনে ছিলাম অ্যাসল্ট পার্টিতে, ৩৩ জনের একটি প্লাটুনকে কমান্ডও করি। পরিকল্পনা হয়, সামনাসামনি যুদ্ধের ভেতরই আমরা ক্যাম্পে উঠে যাব। গোলাগুলি শুরু করবে কাভারিং পার্টি। তাদের সামনে থাকবে অ্যাসল্ট পার্টি। শত্রু যেন ভেগে যেতে না পারে বা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকে সাহায্য করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করবে কাট অফ পার্টি। অপারেশনে অ্যাসল্ট পার্টিতে যারা থাকে তারা মৃত্যুকে মেনে নিয়েই এগোয়। বাঁচা হলো অ্যাকসিডেন্ট, মরা হলো স্বাভাবিক।

পাকিস্তানি সেনারা তো ট্রেন্ড সোলজার। আর্টিলারি শুরু হলেই ওরা ক্যাম্প ছেড়ে দেয়। তখন কাভারিং পার্টি এসএলআর ও এলএমজির ফায়ার শুরু করে। ক্রলিং করে আমরা তখন এগোই। টিলার দিকে উঠব, কিন্তু পেছন থেকে কাভারিং পার্টির ফায়ার বন্ধ হয় না। ক্যাম্পে উঠতে গিয়ে আমাদের গুলিতেই তিনজন মারা যায়। ক্যাম্পে উঠে ওদের বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করি। মাত্র ২৫-৩০ মিনিট ক্যাম্পটি দখলে ছিল।

আমাদের ‘কাট অফ’ পার্টি জায়গামতো যেতেই পারেনি। ফলে পাকিস্তানি আর্মিরা পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে আমরা ক্যাম্প থেকে নিচে নেমে যেতে থাকি। ওরা গুলি করতে থাকে। চা-বাগানের নালা দিয়ে এগোই। কিছু দূর আসতেই দেখি ক্যাম্প কমান্ডার বাবু ভাই রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। গুলিতে তার পা ঝাঁজরা হয়ে গেছে। দুইজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে খায়রুল মজিদ গামছা দিয়ে পিঠে বেঁধে বাবু ভাইকে তুলে নেয়।

সহযোদ্ধা ইন্দ্র কুমার চক্রবর্তীও ফেরেনি। মৃত্যুই তাকে ওই অপারেশনে টেনে আনে। জীবিত ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। হিন্দু হওয়ায় তাকে নির্মমভাবে টর্চার করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। তার কথা মনে হলে এখনও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে।

এর পর ছোটলেখা চা বাগানে যুদ্ধ হয়। ওই অপারেশনে আমি ছিলাম ‘কাট অফ’ পার্টির প্রধান। টুয়াইসি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ, আখাউড়া বাড়ি। ১১ জনের গ্রুপ নিয়ে রাতে রওনা হই। আর্মি ছিল ৩০ জনের ওপরে। আমি গন্তব্যে গিয়েই অ্যান্টিট্যাংক মাইন ফিট করি। পাকিস্তানিরা টের পেয়েই টু ইঞ্চ মর্টার ছোড়ে। ফলে বারুদে আমার সারা শরীরে ক্ষত হয়। আমাদের দুজন সহযোদ্ধাও মারা যায়। তখন নির্দেশ আসে অ্যামুনেশন শেষ, সরে যেতে হবে।  নালার পথ ধরে এগোই অনুমান করে। দুদিন পরে ফিরি ক্যাম্পে। আমাদের দেখে সবাই তো অবাক। অপারেশনের একদিন পরও না ফেরায় আমাদের মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল।

বলা হলো কর্নেল তাহেরের কোড হবে ‘কর্তা’

বীরপ্রতীক ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, ছবি: সালেক খোকন
জন্ম নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের তাঁর বড় ভাই। একাত্তরে ভারতের তুরা থেকে দুই মাসের ট্রেনিং শেষে এক্সপ্লোসিভের ওপর বিশেষ ট্রেনিংও সমাপ্ত করেন।  মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ১১ নম্বর সেক্টরের হালুয়াঘাটের ঘোষগাঁও বিওপি এলাকায়

হালুয়াঘাটের ঘোষগাঁওয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিওপিতে সাপ্লাই আসা বন্ধ করতে হবে। কিভাবে? ওখানে রাস্তায় একটি ব্রিজ আছে। সেটি উড়িয়ে দিলেই সাপ্লাই লাইন কাট অফ হবে। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট হওয়ায় এ দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে।

আলম নামে চট্টগ্রামের একটি ছেলেকে নিই সঙ্গে। ক্যালকুশেন করে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে বাহারকে (শাখাওয়াত হোসেন বাহার, বীরপ্রতীক) বললাম, সাপোর্টিং ফায়ার দেবে তোমরা। রাত ১২টায় হেঁটে ব্রিজের কাছে পৌঁছে যাই। ব্রিজের দুই পাশে কয়েকজন পাকিস্তানি আর্মি পাহাড়ারত ছিল। বাহাররা ফায়ার ওপেন করতেই ওরা পালিয়ে যায়।

তখন পানিতে নেমে আমরা ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ ও ডেটোনেটর সেট করে করটেক্স নিয়ে এসে ফিউজ জোড়া দিই তীরে বসে। এর পরই ধুম করে উড়িয়ে দিই ব্রিজটাকে। সফল অপারেশন ছিল ওটা। এরপর সেক্টর গঠন হলে চলে যাই এগারো নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে।

কামালপুর এবারের অপারেশনটা ভিন্ন রকমের। আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় ভারতের মারাঠা রেজিমেন্ট, গুর্খা রেজিমেন্ট আর গার্ড রেজিমেন্ট। সবগুলোর কমান্ডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। সিদ্ধান্ত হয় অপারেশনটির নেতৃত্ব দেবেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের।

১৩ নভেম্বর ১৯৭১। রাত ১২টার পরই অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর কামালপুর অ্যাটাক করা হবে। বলা হলো কর্নেল তাহেরের কোড হবে ‘কর্তা’। রাত ১১টায় রওনা হলাম। কামালপুরের আগেই বানরোড। তারও পেছনে কর্নেল তাহেরের কমান্ড পোস্ট। আমরা ওখানেই পজিশন নিই। পাশেই ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, গুর্খা রেজিমেন্টে কর্নেল বারাখ, মারাঠা রেজিমেন্টের কর্নেল বুলবুল, গার্টস রেজিমেন্টের বারাট।

আর্টিলারি ফায়ারের পর শুরু হবে অপারেশন। রাত তখন ১২টা। মুহুর্মুহু শেল ড্রপিং হচ্ছে কামালপুর বিওপির ওপর। পাকিস্তানি সেনারাও ফায়ার করছে। ট্রেসার ফায়ারও যাচ্ছে।  কর্নেল তাহেরের কাছে একটা ওয়াকিটকি। সেখানে লেফটেন্যান্ট মিজান জানাল, ‘কর্তা আমরা পাকিস্তানিদের প্রথম লাইনের বাংকার দখল করে নিয়েছি।’

রাত তখন ৩টার মতো। ওয়াকিটকিতে কর্নেল তাহের বারবার বলছিলেন, ‘মিজান, তুমি কোথায়?’ ওপাশে কোনো সাড়া নেই। ভোর হয়ে আসছে। হঠাৎ উনি কমান্ড পোস্ট থেকে উঠে সামনে রওনা হন। সঙ্গে আমরাও।

বানরোডের কাছে গিয়ে বর্ডার ক্রস করি। তাহের ভাই পজিশন নিয়ে নিয়ে এগোয়। বানরোডের ঢালে এসে বসলেন দুই পা ভাঁজ করে। এক পাশে আমি, আরেক পাশে বাহার, পেছনে তিন-চারজন পজিশনে। কর্নেল তাহের কলফ স্টিক দিয়ে পাকিস্তানিদের দেখালেই, ওদিকে ফায়ার দিচ্ছি। এর মধ্যেই হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো। খেয়াল করলাম কর্নেল তাহের আমার ওপর পড়ে যাচ্ছেন। দেখলাম তার বাঁ পা-টা প্রায় বিচ্ছিন্ন, দু-তিনটা ভেইনের সঙ্গে ঝুলে আছে কোনো রকমে।

উনাকে ধরতে গেলে উনি বলেন, ‘আমার কিছু হয়নি। তোমরা যুদ্ধটা চালিয়ে যাও।’ রক্ত গিয়ে কর্নেল তাহের নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। আমি তখন ভুল করে ওয়াকিটকিতে বলে ফেললাম, ‘কর্তা ইজ ডেড।’

চোখ ফাঁকি দিয়েই গ্রেনেড চার্জ করি

বীরবিক্রম হায়দার আলী,ছবি: সালেক খোকন

তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার শ্রীপুর মাইজহাটিতে। ছিলেন ইপিআরের সিপাহি। ইপিআর নম্বর ছিল-১৩৭৪২। ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে একটি কম্পানির দুই নম্বর প্লাটুনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন।

পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করেছেন আখউড়া, শাহবাজপুর ব্রিজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, তেলিয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।

১৪ আগস্ট ১৯৭১। শেষ রাতের ঘটনা। তেলিয়াপাড়ার চা-বাগানে অন্ধকারে খালি চোখে দূরের কিছু দেখা যায় না। চা-বাগানের ভেতরে আমাদের ক্যাম্প।

সবাই পরিশ্রান্ত। ক্যাম্পে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকজন সহযোদ্ধা পাহারা দিচ্ছেন। এমন সময় গোলাগুলির শব্দ।পাকিস্তানি সেনারা আকস্মিক আক্রমণ করে। সবাই হকচকিত। যে যেভাবে পারে দ্রুত অবস্থান নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। কিন্তু পাকিস্তানিরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। তখন আমরা পেছনে সরে যাই।

কিন্তু তার আগেই চোখের সামনে আমাদের ১৪ জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়। নিরাপদ জায়গায় চলে গেলে আসেন অধিনায়ক সফিউল্লাহ সাহেব। বলেন, ‘আমাদের ১৪ জনকে মারছে, আমি ওদের চার গুণ মৃত্যু দেখতে চাই।’ অধিনায়কের কথা শুনে আমরাও উদ্দীপ্ত হই। আরো শক্তি সঞ্চয় করে পরদিন ভোরেই পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাই। গার্ডেনের বিভিন্ন জায়গায় ওরা ছিল তিন ব্যাটালিয়ন। আমরা ছিলাম দুই ব্যাটালিয়ন। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আমি চালাতাম এলএমজি। সঙ্গে ছিলেন হাবিলদার কুদরত আলী, নায়েক বরকত আলী ও নায়েক সুবেদার ফরিদ উদ্দিন প্রমুখ।

একটি টিলার ওপর পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগান পোস্ট। তারা সেখান থেকে গুলি করছে। ফলে আমরা এগোতে পারি না। তখন পাহাড়ি নালার মধ্য দিয়ে ক্রল করে একাই ওদিকে এগোই। সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মেশিনগান পোস্টে দুটি গ্রেনেড চার্জ করি। ফলে সেখান থেকে গুলি বন্ধ হয়ে যায়। চার পাকিস্তানি সেনা সেখানেই আহতাবস্থায় পড়ে ছিল। পরে এসএমজির গুলিতে তাদের শেষ করে দিই। এর ফলে আমরা খুব সহজে ক্যাম্পটিকে পুনর্দখল করি।

আরেক অপারেশনে ছিলাম ডিফেন্সের গ্রুপে, দুই নম্বর প্লাটুনে। কম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন। তার কমান্ডে অগ্রসর হই। তখন আমাদের সঙ্গে ভারতীয় আর্মি ছিল ২০ জন। আমরাও ছিলাম ২০ জন। অপারেশনে গেলে ৪০ জনই একসঙ্গে বের হতাম।

তেলিয়াপাড়ায় ঢুকছি। সবার ফ্রন্টে আমি। দেখি দূরে ওত পেতে আছে পাঞ্জাবিরা। ওদের দেখে ফেলি। তখনই ছোট্ট একটা পুকুরের পাশ থেকে এলএমজি ফায়ার দিয়ে ওদের তিনটি এলএমজি উড়িয়ে দিই। আমাদের সবাই তখন বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। সংকেত না দিলে হয়তো কেউ বাঁচত না। এমন সাহসিকতার জন্য ইন্ডিয়ান আর্মি জড়িয়ে ধরে, কোলে তুলে নিয়ে একদিন ছুটিও দেয়। খুব আনন্দ লেগেছে ওই দিন।

আগস্ট মাসে শাহবাজপুর ব্রিজে ওরা দক্ষিণ সাউডে, আমরা ছিলাম পশ্চিম সাইডে। ওরা ব্রিজের ওপর দিয়ে এপারে আসতে চায়। আমরা তখন অ্যান্টিট্যাংক মাইন দিয়ে ব্রিজটা উড়িয়ে দিই। ফলে ওরা এপারে আসতে পারে না, অনেক হতাহতও হয়। সহযোদ্ধাসহ সবার গলায় একটা টোকেন ঝুলানো থাকত। হিন্দু হলে লেখা থাকত ‘এইচ’ আর মুসলমান হলে ‘এম’। আর ছিল বডি নম্বর। ওগুলো দিয়েই নিহত সহযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতাম আমরা।

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান ছিল অনেক। তারা সাহায্য না করলে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারতাম না। খাদ্য দিছে, গোলাবারুদ এগিয়ে দিছে গ্রামের সাধারণ মানুষরাই। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে এমন খবর পেলে পাঞ্জাবিরা তাদের অস্তিত্ব রাখত না। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত, গুলি করে মারত। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আমাদের সাহায্য করেছে তারা।

আগামী প্রজন্মকে বলব, তোমরা কথা ও কাজে সৎপথে থেকো, দেশের উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখো, আর ক্ষমতাশালী হলে দেশের দু-চারটি গরিব মানুষকে সাহায্য করো। দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম।

পা পচে সাদা সাদা পোকা ধরে গিয়েছিল

বীরবিক্রম আবুল কালাম আজাদ, ছবি: সালেক খোকন

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার পারদিঘুলিয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। একাত্তরে টাঙ্গাইলে ১৫ দিনের ট্রেনিং করেন। অতঃপর কাদেরিয়া বাহিনীর অধীনে টাঙ্গাইল শহরে গেরিলা অপারেশন করেন রাজাকার মুসা কমান্ডারের বাড়িতে, ঢাকাইয়াপট্টি মার্কেটের বারান্দায় অবস্থান নেওয়া রাজাকার ক্যাম্পে, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার হাউস প্রভৃতি জায়গায়

পরিকল্পনা হয় টাঙ্গাইল শহরের বৈদ্যুতিক পাওয়ার হাউস ধ্বংস করার। শহরটাকে অন্ধকার করা গেলে আক্রমণ করাও সহজ হবে।

এবারও দায়িত্ব পড়ে আজাদ আর বাকুর ওপর। দুজনে ৬০টি গ্রেনেড আর এক্সপ্লোসিভ নিয়ে শহরে চলে যাই। ১৬ আগস্ট ১৯৭১। ভোরে তারুটিয়া ভাতকুড়া নামক জায়গায় ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডে চকের মধ্যে ছোট্ট একটা ট্রান্সমিটার আছে।

ভাবলাম ওটা ধ্বংস করলে হয়তো ঢাকা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। দুজনই দিনের বেলায় সেখানে গেলাম। ভাতকুড়া কবরখানায় এক কবরে গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ লুকিয়ে রাখি প্রথমে। সন্ধ্যার পর গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ নিয়ে গন্তব্যে যাই।

ইলেকট্রিক পোলে এক্সপ্লোসিভ ফিট করতে মাটি খুঁড়তে থাকি। এমন সময় শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। ফলে আগুন জ্বালানো সম্ভব হয় না। পুরো অপারেশনটাই ব্যর্থ হয়।

পরদিন খুব ভোরে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে ডিঙি নৌকায় একটা খাল পার হয়ে হেঁটে এগোই। হঠাৎ পেছন থেকে দুজন রাজাকার দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমরা ওদের সঙ্গে তর্ক করি আর সরে যাওয়ার প্ল্যান করছি।

এমন সময় তিন দিক থেকে এগিয়ে আসে এক থেকে দেড় শ সেনা। ওরা গুলি করছে।  সামনে ধানক্ষেতের আইলের কাছে পজিশন নিই, ওদের দিকে একটা করে গ্রেনেড থ্রো করি।

মাঝেমধ্যে পিস্তলের সিঙ্গেল শটও দিই। হঠাৎ একটা শব্দ হয়। তখনই জ্ঞান হারাই। ওদের গুলির একটা স্প্লিন্টার আমার বাঁ চোখের হাড়ে আঘাত করে পিছলে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা চতুর্দিক ঘিরে আছে। যে যেভাবে পারছে আমাকে পেটাতে থাকে। সারা শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়।

আমাকে পেটাতে পেটাতে প্রথমে থানায় এবং পরে নিয়ে যায় সার্কিট হাউসে। এরপর শুরু হয় নিদারুণ টর্চার। একটা রুমে রাতে রাখে। দেয়ালের চতুর্দিকে ও মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। সব সময় প্রস্তুত থাকতাম মৃত্যুর জন্য। দেড় মাস প্রায় প্রতিদিনই চলে টর্চার।

একদিন আমাকে নিয়ে যায় ফাইনাল ইন্টারোগেশন সেন্টারে। টর্চার করার জন্য ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিও আছে। আমাকে বসানো হলো। চা-নাশতাও খেতে দিল।

এরপর একটা স্টেটমেন্ট এগিয়ে দিয়ে মেজর বলল, ‘এদারসে দস্তগত কর দেও।’

‘কেয়া লিখায়ে’। ওরা বলে, ‘জো কুচ লেখায়া দস্তগত কর দেও।’

বলি নেহি। আগে পড়লে। বলল, ঠিক হায়।

ইংরেজিতে লেখা ছিল এমন, ‘আমি ইন্ডিয়ান অনুচর, গুপ্তচর ও ফোর্স। ইন্ডিয়া থেকে আমার মতো অনেকেই পাঠানো হয়েছে পাকিস্তানকে শেষ করে দেওয়ার জন্য।’

দস্তখত করলে তারা সেটা বিশ্বকে দেখাবে পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা মুক্তিযুদ্ধ নয়। ওটা ভারত ঘটাচ্ছে।

রাজি হলাম না। ফলে শুরু হয় ইলেকট্রিক শক। এরপরও দস্তখত দিতে রাজি হই না।

তখন এক হাবিলদার দুটো চিকন রড আগুনে লাল করে নিয়ে আসে। তখন আমার হাত ওপরে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এর পর গরম রড দুটো দুই পায়ের তালুতে ঢুকিয়ে দেয়। জীবনটা তখন বের হয়ে যাচ্ছিল। চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারাই।

অচেতন অবস্থায় ছিলাম প্রায় ৭দিন। পায়ের ক্ষতে ওষুধ দেয় নাই কোনো। পা পঁচে সাদা সাদা পোকা ধরে গিয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছি। কাঁদতেও দিতো না ওরা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কন্ঠে, প্রকাশকাল: ২৬ মার্চ ২০২৪, স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ সংখ্যায়।

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button