থানাপাড়া গণহত্যায় প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখেছেন
শহীদদের তালিকা না হওয়া এবং শহীদ পরিবারগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে আজও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
একাত্তরের ১৩ এপ্রিল। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালায় রাজশাহীর চারঘাট থানাপাড়ায়, সারদা পুলিশ একাডেমির ভেতরে। প্রায় হাজারের ওপর নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল তারা।
নয় মাস আগের কথা। এ গণহত্যা নিয়ে সরেজমিন গবেষণার আহবান জানায় স্নেহভাজন সোহরাব হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সোহরাব তখন ইউএনও হিসেবে চারঘাট উপজেলার দায়িত্বে ছিলেন। এ গণহত্যার দিনে কী ঘটেছিল? তা প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখের দেখার চেষ্টাটা ছিল শুরু থেকেই। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নানাভাবে পাশে ছিলেন চারঘাটে গরিবের ডাক্তারখ্যাত চিকিৎসক আতিকুল হক।
ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম আসে অধ্যাপক ড. জিন্নাতুল আলম জিন্নার। খুব কাছ থেকে প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছেন তিনি। লাশ টেনেছেন, শহীদদের রক্তে নিজের শরীর ভিজিয়েছিলেন। তাঁকেও হত্যা করা হতো। কিন্তু দৈব্যক্রমেই বেঁচে যান তিনি। জিন্নাতুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের সেতুবন্ধনটি তৈরি করে দেন সাংবাদিক ও লেখক মাসকাওয়াথ আহসান।
এভাবে সরেজমিন প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও নানা-তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জানার চেষ্টা চলে থানাপাড়া হত্যাযজ্ঞের ইতিহাসটি। যা একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক জেনোসাইড বা গণহত্যার প্রামাণ্য হিসেবেই উঠে আসে। পাশাপাশি স্বাধীনতা লাভের পর শহীদ পরিবারগুলোর টিকে থাকার লড়াইয়ের করুণ ও কষ্টের অনুভূতিগুলোও আমাদেরকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। শহীদদের তালিকা না হওয়া এবং শহীদ পরিবারগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে আজও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এলএমজি দিয়ে নৃশংসভাবে মানুষগুলোকে মারে ওরা
একাত্তরে অধ্যাপক জিন্নাতুল আলম জিন্না ছিলেন অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। পুলিশ একাডেমির সঙ্গেই তার বাড়ি। থানাপাড়া গণহত্যার স্মৃতি তার বুকের ভেতর জমে আছে কষ্টের মেঘ হয়ে। রক্তাক্ত ওই দিনটির কথা তিনি বললেন যেভাবে, “ওইদিন পাকিস্তানি আর্মিরা চারদিক থেকে এমনভাবে আসছিল যে সারদা পুলিশ একাডেমির পদ্মা নদীর দিকটাতেই পালানোর একমাত্র পথ মনে করে সবাই। অনেকেই ভেবেছে সাঁতার দিয়ে ওপারে ইন্ডিয়াতে চলে যাবে। ফলে আশপাশের গ্রামগুলো থেকেও বহু মানুষ আসে। পাশেই ছিল ক্যাডেট কলেজ। সেখানকার লোকজন আর সারদা পুলিশ একাডেমির পুলিশরাও সিভিল ড্রেসে আসে সেখানে। আনুমানিক হাজার দুয়েক মানুষ জড়ো হয় ওই চরে।
বেলা তখন দুইটা বা আড়াইটা হবে। এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কমান্ডে আর্মিরা পুলিশ একাডেমির ভেতরে ঢুকে। তাদের দেখে চরের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হয়। ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডের উপর থেকেই উর্দুতে বলে, ‘এদার আও, এদার আও। তোমাকো লেকার হামে মিটিং কারেগা। মিটিংকা বাদ তোমকো ছোড় দে গা।’ চরের মধ্যেই প্রথমে সবাইকে একত্র করে ওরা। এরপর মহিলা ও শিশুদের আলাদা করে বলে, ‘তোম ঘারকে চলে যাও।’
তখনই এক বিষাদ ও করুণ দৃশ্য শুরু হয়। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ছেড়ে, একটা বাচ্চা ছেলে কি তার বাবাকে ছেড়ে যেতে পারে? কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিরা ধাক্কা দিয়ে, লাথি মেরে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেয়। লোক কমে তখন থাকে তেরোশ’র মতো। ওরা মিটিং করল না। সেপাইরা অস্ত্র তাক করে চারদিক ঘিরে ফেলল। ক্যাপ্টেন তখন অস্ত্র লোড করছে।
আমার সঙ্গে ছিল ছোট ভাই শফিকুল আলম পান্না, চাচা আজিজুল আলম, চাচার বড় ছেলে খায়রুল আলম পরাগ, আমার ছোট ভগ্নিপতি মহসীন আলীসহ গ্রামের চেনা মানুষেরা। জোয়ান মানুষ যারা তাদের ওরা এক এক করে ডাকতে থাকল। প্রথমে উঠাল পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার শামসু ভাইকে। ওই ক্যাপ্টেন খুব কাছ থেকে তার বুকে গুলি করে। কয়েক হাত উপরে উঠেই সে মাটিতে পড়ে যায়। মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। দু’এক মিনিট ছটফট করেই তার শরীর নিথর হয়ে যায়।
এরপরই পুলিশ একাডেমির এক স্টেনোগ্রাফারকে উঠায়। নাম তার কাজী গোলাম মোস্তফা। তাকেও গুলি করে মারল। এমনভাবে ১০ থেকে ১৫ জনকে হত্যা করে। ওদের ওয়ারল্যাসে ম্যাসেজ আসছে বারবার। ফলে ওরা তাড়াহুড়োও করছে।
আমি লুঙ্গি পরা ছিলাম। খালি গা। ইচ্ছে করেই মুখে কাদা মেখে রেখেছি। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুজে বসে আছি। হঠাৎ ওরা আমাকে ডাক দেয়, ‘এই বাচ্চু এদার আও, এদার আও।’ না শোনার ভান করি প্রথমে। পাশ থেকে একজন বলে, ‘জিন্না তোমাকে ডাকতেছে।’ তখন ধরেই নিয়েছি মেরে ফেলবে। উর্দু ভাল বুঝতাম, কথাও বলতে পারতাম। ওটাই কাজে লাগাই।
‘তোমার নাম কিয়া হে?’
ডাক নাম বলছি ওদের, ‘জিন্না।’
‘পুরা নাম কিয়া হে?’
‘মোহাম্মদ জিন্নাতুল আলম।’
‘কিয়া কারতাহে।’
‘হাম স্টুডেন্ট। ময়মনসিংহ এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিমে পারতাহে।’
‘এহায় কিস লিয়ে আয়া?’
‘সেল্টার লিলেকে ওয়াস্তে।’
বলে, ‘নেহি শালে তোম ইন্ডিয়া ভাগতা।’
উর্দুতে অনেক কথা বলার পর ক্যাপ্টেন বলে, ‘ঠিক হ্যা তোমকো নেহি মারেগা, তুম এদার বেঠো।’ আমার সঙ্গে আরও ছয়-সাতজনকেও বসাল। গ্রামের সোলায়মান ভাই ও তোসাদ্দেক নামে এক মুরগীর ব্যবসায়ীও ছিলেন। ওদের ওয়ারল্যাসে বার্তা আসছিল। ওপাশ থেকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত সবাইকে হত্যা করার। তখন ওরা ব্রাশফায়ার করার প্রস্তুতি নেয়। এটা শুরু করে ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। ২০ বা ২৫ মিনিট এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় সে। মানুষের রক্তে ভেসে যেতে থাকে গোটা চরের মাটি।
চাচাতো ভাই খায়রুল আলম পরাগের কণ্ঠ ওইসময়ই শুনতে পাই। ‘আম্মা’ বলে একটা চিৎকার দেয় সে। মা তার খুবই প্রিয় ছিল। এরপর আর কোনও সাড়া নেই! ২০-২৫ মিনিট পর গোটা চরটাই নীরব হয়ে যায়।
আমাদের ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে আসে। সেটি বেশ উঁচুতে। খানিক পরেই সেখান থেকে দেখা গেলো চরে স্তূপ করা লাশের ভেতর থেকে অনেকেই পালাচ্ছে। সবাই রক্তাক্ত। যন্ত্রণায় দিক-বেদিক ছুটছে। তখন ওই ক্যাপ্টেন চিৎকার দিয়ে বলে, ‘শালা এ লোক তো জিন্দা হে আপতাক। এলএমজি ছোড়ো, এলএমমজি ছোড়ে।’ এলএমজি দিয়ে নৃশংসভাবে মানুষগুলোকে মারে ওরা।
আমাদেরকেও আবার চরের দিকে নিয়ে আসে। সেখানে যেতেই দেখি চাচা আজিজুল আলমকে। গুলি লেগে তার ভুড়ির অনেকটাই বের হয়ে এসেছে। যন্ত্রণায় তিনি কাতরাচ্ছেন। রক্তে চারপাশটা ভরে গেছে। প্রতিবাদ করে চাচা তখন ওই ক্যাপ্টেনকে চেচিয়ে বলছিলেন, ‘এয়া কিয়া জুলুম হে ভাই। এয়া কিয়া জুলুম হে। খোদাতালা বরদাস নেহি করেগা।’ কথাগুলো পরপর তিনবার বলেন তিনি।
ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তখন গর্জে উঠে। ‘শুয়োরকা বাচ্চা’ বলেই চাচার খুব কাছে গিয়ে কপালের মাঝ বরাবর একটা গুলি করে। মাথার খুলিটা উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু না, সেটা হলো না। খুলিটা উঠে গিয়ে গোটা মুখটায় ঢেকে গেল। তিনি তখন শুধু একবার ‘উ্হ’ শব্দটি করলেন। এরপরই উপুর হয়ে পড়ে গেলেন। চাচার করুণ মৃত্যুতে বুকের ভেতরটা খামচে ধরে।
এরপর ওরা আমাদের বলে, ‘তোম সব লাশ এক জায়গায় করো।’
লাশের স্তূপ থেকে অনেকেই কিছুটা দূরে সরে গিয়ে পড়েছিল। সে লাশগুলো আমরা একত্র করতে থাকি। মারা গেলে মানুষ কতটা ভারি হয়, সেদিন বুঝেছি সেদিন। ২০টির মতো লাশ দূর থেকে এনে স্তূপ করে রেখেছিলাম আমরা। দেখেছি, অনেকের শরীরে গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে ভোগলা হয়ে বের হয়ে গেছে।
ওয়াসেল নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন, অংক করাতেন। তার রক্তাক্ত শরীরটা যখন স্তূপে ছিটকে ফেললাম তখন লুঙ্গিটা সরে যায়। জ্ঞান ছিল না তখন, পরে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। আমি তার লুঙ্গিটা টেনে দিচ্ছি। এক পাকিস্তানি সিপাহী দৌড়ে এসে আমাকে একটা লাথি দিয়ে বলে, ‘শুয়োরকা বাচ্চা, তুম আবি ইজ্জাত দেখতাহায়। থোরা বাদমে তোমারা হাল বি এছা হোগা।’
সে আরেকটা লাথি দিতেই লাশের স্তূপে গিয়ে পড়ি। সেখান থেকে যখন উঠে আসি তখন আমার সারাশরীর শহীদদের রক্তে ভেজা।
ওরা পেট্রোল ভর্তি টিন এনে আমাদের হাতে দিয়ে বলে, ‘পেট্রোল লাগাও।’ গায়ে তখন শক্তি নেই। ভালোভাবে পেট্রোল ছিটাতেও পারছি না। পরে ওরাই লাশের স্তূপে পেট্রোল ছিটাল। কোনও মানুষকেই জীবিত ছাড়বে না। গুলি করে লাশের উপর ফেলে আমাদেরসহ আগুন ধরিয়ে দিবে। তখন শুধু বিধবা মায়ের কথা মনে পড়ছে। ছোট ভাই পান্নাকে তো মেরেই ফেলেছে। আমিও যদি মারা যাই মায়ের কি হবে। সাহস করে জান ভিক্ষা চাইতে ক্যাপ্টেনের দিকে এগোই।
আমার সারা শরীর তখনও রক্তমাখা। ক্যাপ্টেনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গর্জে ওঠে। সে ভেবেছে লাশের ভেতর থেকে উঠে এসেছি। সে তো খুনি। ফলে প্রচণ্ড ভয়ও ছিল মনে। আমার বুকের বা পাশে অস্ত্রটা ধরে সে বলল, ‘বাতাও কেয়া বলতে হো।’
বলি, ‘স্যার, মুজে মাত মারিয়ে স্যার। মুঝে বাছনিকে কহি খায়েস নেহি হে দুনিয়ামে। মাগার মেরা বেওয়া মাকে হে। এক ভাই হে। উছকো তোম মার ডালা। আগার মুজে মারেগা হামার বেওয়া মাকে দেখবাল করলে কি দুনিয়া মে কোহি নেহাগা। প্লিজ সেভ মি স্যার। ডোন্ট কিল মি।’
ক্যাপ্টেন আমার চোখের দিকে তাকিয়েই অস্ত্রটা নামিয়ে ফেলে। খানিক চিন্তা করে বলে, ‘ঠিক হ্যা তোমকো হাম নেহি মারে। তুম ঘার চালি যাও। মাকো আচ্ছাছে দেখবাল কারনা। যাব ইউনিভার্সিটি খোল যায়। তুম চল যায়েগা। ঠিক হ্যা।’
ইন্ডিয়াকে গালি দিয়ে সে আরও বলে, ‘মাদারচোদ, ইন্ডিয়া হ্যা না, ইন্ডিয়া মে মাত যা না। আর হাম লোককি এ খুনখারাবি কেহানা, কিছুকো মাদ বোল না।’
বলি, ‘ঠিক হ্যা।’
‘খোদাকি কসম?’
‘খোদাকি কসম’
‘আল্লাহকি কসম?’
বলি, ‘আল্লাহকি কসম। ইমানছে।’
মনে হয়েছে যেন নতুন জীবন পেয়েছি। আছরের আগে আগে ছাড়া পাই। অতঃপর সোজা চলে যাই মায়ের কাছে, নানা বাড়ি সাদীপুরে।”
এখনও মাঝেমধ্যে শহীদদের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়
একাত্তরের রক্তাক্ত দিনটির কথা এখনও জীবন্ত হয়ে আছে ড. জিন্নাতুল আলমের স্মৃতিতে। ভয়টা কাটেনি তার। স্বপ্নে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ এখনও দেখেন। এখনও মাঝেমধ্যে শহীদদের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। রক্তাক্ত প্রিয়জনের আর্তনাদে ঘুমাতে পারেন না। ওই ঘটনার পর থেকে সকল দেশের আর্মিকেই ঘৃণার চোখে দেখেন তিনি।
শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রসঙ্গে জিন্নাতুল আলম বলেন, “আমার বিধবা বোনের ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করেছি। কেউ কোনদিন এসে একবার জিজ্ঞেসও করেনি কীভাবে চলছে পরিবার? আর্থিক সুবিধার দরকার নেই, রাষ্ট্র তো শহীদ পরিবারগুলোর সম্মানটা অন্তত দিতে পারত। থানাপাড়ায় আনুমানিক ১৩শ মানুষ
শহীদ হয়েছে। গোটা গ্রামে এমন কোনও পরিবার পাবেন না যে কেউ শহীদ হয়নি। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনও এদের পূর্ণাঙ্গ কোনও তালিকা হয়নি।”
কষ্ট নিয়ে তিনি আরও বলেন, “কোনও সরকারই শহীদদের তালিকা করতে চায় না। হয়তো শহীদ পরিবারগুলোকে রাষ্ট্র বোঝা মনে করে। এদের স্বীকৃতি দিতে গেলে বিরাট অংকের টাকা লেগে যাবে। সুবিধা না দিক, রাষ্ট্র তো শহীদদের একটা লিস্ট তৈরি করার কাজ শুরু করতে পারত। এ দায় রাষ্ট্র কখনই এড়াতে পারে না।”
মানুষকে এমনভাবে পুড়িয়েছিল যে চেনারও উপায় ছিল না
মো. রায়হান আলী মৃধার বাড়ি থানাপাড়ায়। একাত্তরে তিনি ছিলেন সারদা পাইলট স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র। গণহত্যার পর ওই গ্রামের অধিকাংশ নারীই বিধবা হন। স্বাধীনতা লাভের পর তাদের পুনর্বাসন করতে এগিয়ে আসে সুইডেন। তারা থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলে। বর্তমানে
রায়হান আলী মৃধা এ সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একাত্তরে থানাপাড়ার গণহত্যায় রায়হান আলীর বাবা আব্দুল সাত্তার ভূইঁয়া রক্তাক্ত হলেও শহীদ হন বড় ভাই জহুরুল ইসলাম হেনা ও ভগ্নিপতি কলিম উদ্দিন।
কী ঘটেছিল ওই দিনটিতে? রায়হান আলীর জবানিতে, “প্রচন্ড গুলির শব্দ পাই সকাল থেকেই। ভাবলাম গ্রামে থাকাটা নিরাপদ নয়। সবাই একাডেমির পশ্চিমে পদ্মা নদীর নিচু চরের খোলা জায়গায় আশ্রয় নিই। নদীর ধারেই বসে ছিলাম, সঙ্গে আব্বা (আব্দুল সাত্তার ভূইঁয়া), বড় ভাই (জহিরুল ইসলাম হেনা) আর ভগ্নিপতি (কলিম উদ্দিন), মা ও বোন। থানাপাড়ার অধিকাংশ লোকই ছিল সেখানে।
পাকিস্তানি আর্মিরা এসেই পুলিশ একাডেমিতে কাউকে না দেখে পদ্মা নদীর কিনারে চলে আসে। এক অফিসার (সম্ভবত এক পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন) তাদের কমান্ড করছিল। নদীর পাড়টা ছিল বেশ উঁচু। ধীরে ধীরে আমরা ওপরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ওই সময় গ্রামেরই এক ছেলে নাম আনসার, সে নদীর ধার দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। এটা দেখেই ওই ক্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হয়। সে দৌড়ে এসেই তার বুক বরাবর গুলি করে। ওটাই খুব কাছ থেকে প্রথম মানুষকে হত্যা করা দেখা। দেখলাম তার শরীরটা খানিক ছটফট করেই নিস্তেজ হয়ে গেল। তখনই ভাবলাম সবার পরিণতি হয়তো এমনটাই হবে।
ওরা ওখানেই আমাদেরকে দুইভাগে ভাগ করে। একভাগে ছিল পুরুষরা, আরেক ভাগে মেয়ে ও শিশুরা। আব্বা, বড় ভাই ও দুলাভাইয়ের সঙ্গেই বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর এক আর্মি হাত ধরে আমাকে মেয়েদের দলে মায়ের কাছে নিয়ে বসায়। কিছুক্ষণ পর ওরা বলল, ‘মেয়ে ও শিশুরা বাড়িতে চলে যাও। পুরুষদের পরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
নানা শঙ্কা আর প্রিয়জনকে ফেলে আসার কষ্ট নিয়েই আমরা বাড়ি ফিরি। আর্মিরা পুরুষ দলের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সরাসরি গুলি করে। তখনই শহীদ হয় আমার বড় ভাই জহুরুল ইসলাম হেনা আর ভগ্নিপতি কলিম উদ্দিন।আব্বার বাঁ হাতে একটি ও বাঁ পায়ে দুটি গুলি লেগেছিল। ফলে বেঁচে গিয়েছিলেন। ওই রাতেই তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি আসেন।
পরদিন সকালে বড় ভাইকে খুঁজতে চাচার সঙ্গে যাই ওই চরে। পাকিস্তানি আর্মি মানুষজনকে গুলি করে হত্যা করে এমনভাবে পুড়িয়েছিল যে চেহারাগুলো চেনারও উপায় ছিল না। মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে-একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারাই সেটা প্রমাণ করেছে।
নদীর পাড়ে পশ্চিমে দেখলাম অনেকগুলো মৃতদেহ। সেখানেই শনাক্ত করি বড় ভাইয়ের লাশটা। সম্ভবত গুলি খেয়েও জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। ফলে খানিকটা দূরে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করেই মারা গেছেন। মৃতদেহ দেখেই প্রথম ভয় পেয়ে যাই। চেনার উপায় ছিল না। তাকে নিয়ে আসতে পারিনি। পরে থানাপাড়া থেকে কয়েকজন গিয়ে সেখানেই গর্ত করে ভাইসহ একেক গর্তে ১০টি বা ২০টি দেহ একত্রে কোনোরকমে মাটি চাপা দেয়।”
সরকারিভাবে এখনও স্বীকৃতি পায়নি থানাপাড়ার শহীদ পরিবারগুলো। এ নিয়ে কষ্টের অনুভূতি রায়হান আলী ব্যক্ত করেন এভাবে, “যারা যুদ্ধ করেছেন তারা অনেক কষ্টের পরেও পরিবারে ফেরত আসতে পেরেছেন। কিন্তু ১৩ এপ্রিল বা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যারা শহীদ হন তাদের পরিবার তো কেবল নিঃস্বই হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হলো আর রাষ্ট্রও ভুলে গেল ওই পরিবারগুলোকে। এটি মেনে নেওয়া সত্যি অনেক কষ্টের। “
একজনের মাথার খুলি এসে আমার গায়ে পড়ে
থানাপাড়া গণহত্যা নিয়ে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোকাররম হোসেনের সঙ্গে। একাত্তরে ছিলেন ডিগ্রি ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র। দৈবক্রমে বেঁচে ফিরেন ওইদিন। রক্তাক্ত ওই ইতিহাসের কথা তিনি বললেন এভাবে, “আমার সঙ্গে ছিল মা, এক ভাই ও বোন। পদ্মার চরের কাছে গিয়ে দেখলাম হাজার হাজার মানুষ। পুলিশ একাডেমির লোক, পাশের উঠিপাড়া ও মুক্তারপুর থেকেও আসছে অনেকে। নন্দনগাছি ও ঝলমলিয়ার দিকে আগেই আর্মিরা আগুন দিসে। ফলে সেখানকার লোকেরাও জীবন বাঁচাতে চলে আসছে।
আর্মিরা এসে প্রথমে নারী ও শিশুদের আলাদা করে। ফলে ছোট ভাই জকিউল ইসলামসহ মা ও বোনকে ছেড়ে দেয়। আমরা ওখানেই থাকি। খুব কাছেই পাকিস্তান আর্মির এক ক্যাপ্টেন, তার পেছনেই ওয়ারল্যাস যন্ত্র নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে।
গ্রামে এক লোক ছিলেন, নাম আব্দুল ওহাব। পুলিশ একাডেমির মালি ছিলেন। আমরা তাকে মামা বলে ডাকতাম। তার বুকে গুলি করে ওই ক্যাপ্টেন। ঝাজরা করে দেয় বুকটা।
‘মা, মা, মা’ বলে তিনটা চিৎকার দেন তিনি। এর পরই উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যান। গরু জবাইয়ের পর গরুর শরীর যেমন দরপায় ওহাব মামার শরীরটাও তেমনই করেছিল ।
আরেকজন হিন্দু লোক ছিলেন, ধূতি পড়া। নাম নিতাই। মুদি দোকানে কাজ করতেন । ‘হিন্দু হে’ বলেই ওরা তাকে গুলি করে। সবকিছু ঘটেছে চোখের সামনে।
হঠাৎ ওয়ারল্যাসে একটা ম্যাসেজ আসে। বোঝা যায় ওপাশ থেকে খুব তাড়া দিচ্ছে। এরপরই ক্যাপ্টেন এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার শুরু করে।
খালি গায়ে লুঙ্গিতে কাছা মেরে বসে ছিলাম। পাশেই ছিল আজিবর নামে এক লোক।গুলির তোড়ে তার চোখ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে এসে পড়ে আমার গায়ে। একজনের মাথার খুলি এসে গায়ে লাগে। চারপাশে গুলিবিদ্ধ অনেকের রক্ত ছিটে গায়ে পড়ছিল। কিন্তু দৈবক্রমে আমার শরীরে কোনো গুলি লাগেনি। শুধু অন্যের রক্তে রক্তস্নান হয় আমার।
হঠাৎ শরীরটা সামনে ঢলে পড়ে। আমার ওপরে লাশের স্তূপ। মিনিট বিশেক কোনো সেন্স ছিল না। পরে যখন জ্ঞান ফেরে ওরা তখন পেট্রোল ঢেলে লাশগুলোতে আগুনে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পেট্রোল ছিটিয়ে আগুনও জ্বালায়। তখন শুধু আল্লাহর নাম জপি।
গ্রামের এক লোক ছিলেন, মনি মামা বলতাম। আমার মতোই লাশের ভেতর পড়েছিলেন। পরে নদীর ধারে গিয়ে জীবন বাঁচান। কুঠিপাড়ার বাদল, সেও লাশের ভেতর অক্ষত ছিল। মানুষের রক্তে তার সাদা শার্টটা লাল হয়ে গিয়েছিল।
আগুনের তাপ আসার আগেই আমি লাশের ভেতর থেকে বের হই। অতঃপর পেছন দিক দিয়ে দৌড়ে কবরস্থানের এক কবরে লুকাই। কবরটাই তখন ছিল নিরাপদ জায়গা।
তখনও রাত হয়নি। এমন সময় শুরু হয় বৃষ্টি। ভাবলাম গ্রামের দিকে যাই। কাছাকাছি এসে রক্তাক্ত অবস্থায় এক লোককে পড়ে থাকতে দেখি। কাছে যেতেই চিনে ফেলি মামা অ্যাডভোকেট আজিজুল আলমের বড় ছেলে আমার মামাতো ভাই ফেরদৌস আলমকে (বর্তমানে প্রবাসে)। গুলি লেগে তার হাঁটারও শক্তি ছিল না। আমি কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে যাই। পাশের বাড়িতে গোলাম কবিরও পালিয়ে চলে আসে। তিনজন বেঁচে আছি— এটা জানালে পাকিস্তানি আর্মিরা আবার হানা দিবে। এই ভয়ে ওদের দুজনকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ি ঝিখরার দিকে।
ওইদিন শহীদ হয় আমার মামা অ্যাডভোকেট আজিজুল আলম ও ডা. আব্দুল মালেক, মামাতো ভাই খায়রুল আলম পরাগ, শফিকুল আলম পান্না এবং মামাতো ভগ্নিপতি মোহসীন আলী।”
দেশ স্বাধীন হলেও একাত্তরে জেনোসাইড বা গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিচার করা উচিত ছিল বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যে গণহত্যা চালিয়েছিল সেই জার্মান সৈন্যদের বিচার করা হয়েছিল তাদের মৃত্যুর অনেক পরেও। পাকিস্তানি সেনা যারা একাত্তরে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তাদেরও বিচার করতে হবে। থানাপাড়ার গণহত্যা নিয়ে আমাদের বক্তব্যই প্রামাণ্য হিসেবে সাক্ষ্য দিবে।
আমি বিশ্বাস করি, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এ বাংলার মাটি, এ বাংলার মানুষ একদিন এর বিচার পাবেই। আমাদের প্রজন্মই এই দাবিকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
দেখি মানুষ পড়ছে আর মরছে
ওয়াজাহান বেওয়ার বাড়িও থানাপাড়ায়। ১৩ এপ্রিল গণহত্যায় শহীদ হন তার স্বামী নুরুল হক খলিফা। সেদিনটির কথা তিনি বলেন এভাবে, “স্বামী এসে বলে, ‘আর্মি আসতেছে, পালাতে হবে।’
‘কোথায় যাবে?’
বলেন, ‘গাঙ্গে চল।’
‘গাঙ্গে গেলে কি বাঁচব আমরা?’
তিনি বলেন, ‘আল্লাহই জানে।’
শ্বশুর যেতে চান না। বলছেন, ‘তোমরা যাও বেটা। আমি আর যাইতে পারব না হাইটি (হেঁটে)। মসজিদেই থাকব।’
গাঙ্গ পাড়ে (পদ্মার পাড়ে) গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষ। আমার ছোট দুই ছেলে। একটা তিন আরেকটা দুই বছরের। ওদের নিয়া ওখানেই থাকি। পাকিস্তানি মিলিটারিরা গাঙ্গ পাড় এসে দেখে মানুষ আর মানুষ। ওরা সবাইরে চরের মধ্যেই বসায়। এরপর ছেলেদের রেখে দিয়ে নারীদের সন্তানসহ ছেড়ে দেয়। ওইসময়ই স্বামীর সাথে আমার শেষ কথা হয়। ছেলেকে আমার হাতে দিয়া সে বলছে, ‘ছেলেটাকে রাখো। আমার বাঁচার আর উপায় নাই। আমাকে বোধ হয় মাইরে দিবে। মাফ সাব করে দিও।’
বড় ছেলেটাকে হাত ধরলাম, ছোটটাকে কোলে নিয়েই সরে যাই। রাইফেল দিয়ে যখন হচ্ছে না তখন আর্মিরা মেশিনগান ফিট করল। খুব শব্দ হচ্ছে— ধুম ধুম।
আমরা দূর থেকে তাকিয়ে থাকি। দেখি মানুষ পড়ছে আর মরছে। দূর থেকে দেখলাম স্বামীটা চোখের সামনেই মরল। ওরা সব মুরদাগুলোকে এক জায়গায় পালা দিল টানি টানি। ওর ভেতর তিন চার ড্রাম পেট্রোল ডালি আগুন ধরিয়ে দেয়।
দূর থাকি দেখছি আগুন জ্বলছে। স্বামী হয়তো ফিরব। সে আশায় সারারাত অপেক্ষায় থাকি। আল্লাহকে বলি— ‘স্বামীকে ফিরিয়ে দেও।’ সকালেই ওখানে যাই। স্বামীকে পেলাম না। পুড়ে গেলো নাকি ডুবে গেলো জানি না। দেবর ইবনে সউদের লাশটা পাইছি। কিন্তু স্বামীর লাশ হয়তো ছাই হয়ে গেছে।”
স্বাধীন দেশে ওয়াজাহান বেওয়ার বেঁচে থাকার লড়াইটা ছিল আরেক যুদ্ধ। সে যুদ্ধে পাশে পাননি কাউকেই। দেশের জন্য জীবন দিলেও শহীদ স্বামী বা তার পরিবারের খোঁজ রাখেনি স্বাধীন দেশের কোনো সরকার। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।
দুঃখ নিয়ে ওয়াজাহান বেওয়া বলেন সে কথা: “স্বামী মারা যাওয়ার পর আমরা সাগরে পড়ি। বহু কষ্ট করছি। মজিবর (শেখ মুজিবুর রহমান) দুই হাজার টাকা দিছিল। এরপর আর কেউ খোঁজ নেয়নি। বড় ছেলেটা এখন লেবারি করে আর ছোটটার একটা পানবিড়ির দোকান আছে। বড় ছেলের সন্তানরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। কিন্তু এখনও কোনো চাকরি পায় নাই। দেশের জন্য মইরা গেলেই আর দাম থাকে না। তাই শহীদ পরিবারেরও কোনো দাম নাই। মুক্তিযোদ্ধা হলে অন্তত নাতির চাকরিটা হতো। আমরা তো সবকথা খুলি কই। কিন্তু কিছুই তো হয় না ভাই।”
যাদের রক্তে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশে সেই সকল শহীদদেরকেই আমরা ভুলে গেছি! এমনটাই মত দেন চারঘাট গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীরা। শহীদের তালিকা করার প্রক্রিয়া স্বাধীনতার তিপান্ন বছরেও শুরু হয়নি। ফলে স্বীকৃতি মিলেনি শহীদদের। এমন কষ্টের অনুভূতি থানাপাড়ার প্রায় প্রতিটি শহীদ পরিবারের হৃদয়ে আজও রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। দেশ এখন উন্নতির দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু শহীদ স্বজনদের চাপা কষ্টকে চাপা দিয়ে আমরা কি নির্মাণ করতে পারব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। একাত্তরের শহীদ স্বজনদের বুকে চেপে রাখা কান্নার শব্দ কবে পৌঁছবে সরকারের কানে!
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৩ এপ্রিল ২০২৪
© 2024, https:.