থানাপাড়া গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা শুনতে কি পাই
‘‘মা, এক ভাই ও বোন ছিল সঙ্গে। পদ্মার চরের কাছে গিয়ে দেখলাম হাজার হাজার মানুষ। পুলিশ একাডেমির লোক, পাশের উঠিপাড়া ও মুক্তারপুর থেকেও আসছে অনেকে। নন্দনগাছি ও ঝলমলিয়ার দিকে আগেই আর্মিরা আগুন দিয়েছে। ফলে সেখানকার লোকেরাও জীবন বাঁচাতে চলে আসছে।
আর্মিরা এসে প্রথমে নারী ও শিশুদের আলাদা করে। ফলে ছোট ভাই জকিউল ইসলামসহ মা ও বোনকে ছেড়ে দেয়। আমরা ওখানেই থাকি। খুব কাছেই পাকিস্তান আর্মির এক ক্যাপ্টেন, তার পেছনেই ওয়্যারলেস যন্ত্র নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে।
গ্রামে এক লোক ছিল, নাম আব্দুল ওহাব। পুলিশ একাডেমির মালি ছিলেন। আমরা তাকে মামা বলে ডাকতাম। তার বুকে গুলি করে ওই ক্যাপ্টেন। ঝাঁঝরা করে দেয় বুকটা। মা, মা, মা বলে তিনটা চিৎকার দেয় সে। এর পরই উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। গরু জবাইয়ের পর গরুর শরীর যেমন তড়পায় ওহাব মামার শরীরটাও তেমনই করেছিল।
আরেকজন হিন্দু লোক ছিল, ধূতি পড়া। নাম নিতাই। মুদি দোকানে কাজ করত। ‘হিন্দু হে’ বলেই ওরা তাকে গুলি করে।
সবকিছু ঘটেছে চোখের সামনে।
হঠাৎ ওয়্যারলেস একটা মেসেজ আসে। বোঝা যায় ওপাশ থেকে খুব তাড়া দিচ্ছে। এর পরই ক্যাপ্টেন এলোপাথারি ব্রাশফায়ার শুরু করে।
খালি গায়ে লুঙ্গিতে কাছা মেরে বসে ছিলাম। পাশেই ছিল আজিবর নামে এক লোক। গুলির তোড়ে তার চোখ বিচ্ছিণ্ন হয়ে ছিটকে এসে পড়ে আমার গায়ে। একজনের মাথার খুলি এসে গায়ে লাগে। চারপাশে গুলিবিদ্ধ অনেকের রক্ত ছিটে গায়ে পড়ছিল। কিন্তু দৈবক্রমে আমার শরীরে কোনও গুলি লাগেনি। শুধু অন্যের রক্তে রক্তস্নান হয় আমার।
হঠাৎ শরীরটা সামনে ঢলে পড়ে। আমার ওপরে লাশের স্তুপ। মিনিট বিশেক কোনও সেন্স ছিল না। পরে যখন জ্ঞান ফেরে ওরা তখন পেট্রোল ঢেলে লাশগুলোতে আগুনে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পেট্রোল ছিটিয়ে আগুনও জ্বালায়। তখন শুধু আল্লাহর নাম জপি।
গ্রামের এক লোক ছিল, মণি-মামা বলতাম। আমার মতোই লাশের ভেতর পড়ে ছিলেন। পরে নদীর ধারে গিয়ে জীবন বাঁচান। কুঠিপাড়ার বাদল, সেও লাশের ভেতর অক্ষত ছিল। মানুষের রক্তে তার সাদা শার্টটা লাল হয়ে গিয়েছিল।
আগুনের তাপ আসার আগেই আমি লাশের ভেতর থেকে বের হই। অতঃপর পেছন দিক দিয়ে দৌড়ে কবরস্থানের এক কবরে লুকাই। কবরটাই তখন ছিল নিরাপদ জায়গা।
তখনও রাত হয়নি। এমন সময় শুরু হয় বৃষ্টি। ভাবলাম গ্রামের দিকে যাই। কাছাকাছি এসে রক্তাক্ত অবস্থায় এক লোককে পড়ে থাকতে দেখি। কাছে যেতেই চিনে ফেলি মামা অ্যাডভোকেট আজিজুল আলমের বড় ছেলে আমার মামাতো ভাই ফেরদৌস আলমকে (বর্তমানে প্রবাসে)। গুলি লেগে তার হাঁটারও শক্তি ছিল না। আমি কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে যাই। পাশের বাড়ির গোলাম কবিরও পালিয়ে চলে আসে। তিনজন বেঁচে আছি— এটা জানলে পাকিস্তানি আর্মিরা আবার হানা দিবে। এই ভয়ে ওদের দুজনকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ি ঝিখরার দিকে।
ওইদিন শহীদ হয় আমার মামা অ্যাডভোকেট আজিজুল আলম ও ডা. আব্দুল মালেক, মামাতো ভাই খায়রুল আলম পরাগ, শফিকুল আলম পান্না এবং মামাতো ভগ্নিপতি মোহসীন আলি।”
থানাপাড়া গণহত্যায় দৈবক্রমে বেঁচে ফেরার ঘটনা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোকাররম হোসেন। একাত্তরে তিনি ছিলেন ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
গণহত্যা নিয়ে কথা হয় থানাপাড়াবাসী মো. রায়হান আলী মৃধার সঙ্গেও। একাত্তরে তিনি ছিলেন সারদা পাইলট স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র। গণহত্যায় শহীদ হন তার বড় ভাই জহুরুল ইসলাম হেনা ও ভগ্নিপতি কলিম উদ্দিন। রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসেন বাবা আব্দুল সাত্তার ভূইঁয়া। রায়হানও ছিলেন সেখানে।
কী ঘটেছিল ওই দিনটিতে?
তার ভাষায়, ‘‘প্রচণ্ড গুলির শব্দ পাই সকাল থেকেই। ভাবলাম গ্রামে থাকাটা নিরাপদ নয়। সবাই একাডেমির পশ্চিমে পদ্মা নদীর নিচু চরের খোলা জায়গায় আশ্রয় নিই। নদীর ধারেই বসে ছিলাম, সঙ্গে আব্বা (আব্দুল সাত্তার ভূইঁয়া), বড় ভাই (জহুরুল ইসলাম হেনা) আর ভগ্নিপতি (কলিম উদ্দিন), মা ও বোন। থানাপাড়ার অধিকাংশ লোকই ছিল সেখানে।
পাকিস্তানি আর্মিরা এসেই পুলিশ একাডেমিতে কাউকে না দেখে পদ্মা নদীর কিনারে চলে আসে। এক অফিসার (সম্ভবত এক পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন) তাদের কমান্ড করছিল।
নদীর পাড়টা ছিল বেশ উচুঁ। ধীরে ধীরে আমরা ওপরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ওই সময় গ্রামেরই এক ছেলে নাম আনসার, সে নদীর ধার দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। এটা দেখেই ওই ক্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হয়। সে দৌড়ে এসেই তার বুক বরাবর গুলি করে। ওটাই ছিল খুব কাছ থেকে প্রথম মানুষ হত্যা করা দেখা।
দেখলাম তার শরীরটা খানিক ছটফট করেই নিস্তেজ হয়ে গেল। তখনই ভাবলাম সবার পরিণতি হয়তো এমনই হবে।
থানাপাড়া গণহত্যায় নিহত শহীদদের নামফলক, চারঘাট থানাপাড়া। আলোকচিত্র:সালেক খোকন।
ওরা আমাদেরকে দুইভাগে ভাগ করে। একভাগে ছিল পুরুষরা, আরেক ভাগে মেয়ে ও শিশুরা। আব্বা, বড় ভাই ও দুলাভাইয়ের সঙ্গেই বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর এক আর্মি হাত ধরে আমাকে মেয়েদের দলে মায়ের কাছে নিয়ে বসায়। কিছুক্ষণ পর ওরা বলল, ‘মেয়ে ও শিশুরা বাড়িতে চলে যাও। পুরুষদের পরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
নানা শংকা আর প্রিয়জনকে ফেলে আসার কষ্ট নিয়েই আমরা বাড়ি ফিরি। আর্মিরা পুরুষ দলের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সরাসরি গুলি করে। তখনই শহীদ হয় আমার বড় ভাই জহুরুল ইসলাম হেনা আর ভগ্নিপতি কলিম উদ্দিন। আব্বার বাঁ হাতে একটি ও বাঁ পায়ে দুটি গুলি লেগেছিল। ফলে বেঁচে গিয়েছিলেন। ওই রাতেই তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি আসেন।
পরদিন সকালে বড় ভাইকে খুঁজতে চাচার সঙ্গে যাই ওই চরে। পাকিস্তানি আর্মি মানুষজনকে গুলি করে হত্যা করে এমনভাবে পুড়িয়েছিল যে চেহারাগুলো চেনারও উপায় ছিল না। মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা সেটা প্রমাণ করেছে।’’
একাত্তরের ১৩ এপ্রিল। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালায় রাজশাহীর চারঘাট থানাপাড়ায়, সারদা পুলিশ একাডেমির ভেতরে। প্রায় হাজারের ওপর নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল তারা।
এ নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘‘নদীর পাড়ে পশ্চিমে দেখলাম অনেকগুলো মৃতদেহ। সেখানেই শনাক্ত করি বড় ভাইয়ের লাশটা। সম্ভবত গুলি খেয়েও জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। ফলে খানিকটা দূরে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করেই মারা গেছেন। মৃতদেহ দেখেই প্রথম ভয় পেয়ে যাই। চেনার উপায় ছিল না। তাকে নিয়ে আসতে পারিনি। পরবর্তীকালে থানাপাড়া থেকে কয়েকজন গিয়ে সেখানেই গর্ত করে ভাইসহ একেক গর্তে ১০টি বা ২০টি দেহ একত্রে কোনওরকমে মাটি চাপা দেয়।’’
গণহত্যার পর থানাপাড়া গ্রামের অধিকাংশ নারীই বিধবা হন। স্বাধীনতা লাভের পর তাদের পূনর্বাসন করতে এগিয়ে আসে সুইডেন। তারা ‘থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলে। বর্তমানে রায়হান আলী মৃধা এ সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিচারের দাবি:
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একাত্তরের জেনোসাইড বা গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিচার দাবি করা উচিত ছিল বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা মোকাররম হোসেন।
তিনি বলেন, ‘‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যে গণহত্যা চালিয়েছিল সেই জার্মান সৈন্যদের বিচার করা হয়েছিল তাদের মৃত্যুর অনেক পরেও। পাকিস্তানি সেনা যারা একাত্তরে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তাদেরও বিচার করতে হবে। থানাপাড়ার গণহত্যা নিয়ে আমাদের বক্তব্যই প্রামাণ্য হিসেবে সাক্ষ্য দিবে। আমি বিশ্বাস করি, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এ বাংলার মাটি, এ বাংলার মানুষ একদিন এর বিচার পাবেই। আমাদের প্রজন্মই এই দাবিকে বাঁচিয়ে রাখবে।’’
দেশ স্বাধীন হলো, রাষ্ট্রও ভুলে গেলো শহীদ পরিবারগুলোকে:
থানাপাড়া গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীরা একাত্তরের হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের আন্তর্জাতিক বিচারের দাবির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু এখনও সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়নি থানাপাড়ার শহীদ পরিবারগুলো।
এ নিয়ে কষ্টের অনুভূতি প্রত্যক্ষদর্শী রায়হান আলী ব্যক্ত করেন যেভাবে, “যারা যুদ্ধ করেছেন তারা অনেক কষ্টের পরেও পরিবারে ফেরত আসতে পেরেছেন। কিন্তু ১৩ এপ্রিল বা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যারা শহীদ হন তাদের পরিবারগুলো তো কেবল নিঃস্বই হয়েছে। দেশ স্বাধীন হলো আর রাষ্ট্রও ভুলে গেলো ওই পরিবারগুলোকে— এটি মেনে নেওয়া সত্যি অনেক কষ্টের।’’
যাদের রক্তে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশে সেই সকল শহীদদেরকেই আমরা ভুলে গেছি! একাত্তরে শহীদের তালিকা করার প্রক্রিয়া স্বাধীনতার তিপান্ন বছরেও শুরু হয়নি। ফলে স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পরিবারগুলোর। এমন কষ্টের অনুভূতি থানাপাড়ার প্রায় প্রতিটি শহীদ পরিবারের হৃদয়ে আজও রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।
একাত্তরের শহীদ স্বজনদের বুকে চেপে রাখা কান্নার শব্দ কবে পৌঁছবে সরকারের কাছে?
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল সন্ধ্যা ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৬ মে ২০২৪
© 2024, https:.