পাখির জন্য পানি ও পাখিবন্ধুদের কথা
সারাদেশে প্রচণ্ড তাপদাহ চলছে। তীব্র গরমে পানির সংকট সবখানে। মাঠে-খালে-বিলে কোথাও পানি নেই। পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে পাখিরাও। তৃষ্ণার্ত পাখিদের কথা চিন্তা করে মন কাঁদে তার। তাই সপ্তাহ খানেক ধরে পাখির জন্য গাছে গাছে পানির পাত্র বাঁধছেন তিনি।
বলছি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের জহির রায়হানের কথা। এমন মহতী উদ্যোগের কথা গণমাধ্যমে খুব ফলাও করে না এলেও সংবাদ প্রকাশ করেছে কয়েকটি পত্রিকা।
স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে জহিরের সংসার। নিজে রংমিস্ত্রির কাজ করেন আর স্ত্রী শাহনাজ খাতুন বাড়িতে বসেই করেন সেলাইয়ের কাজ। দুজন মিলে যা উপার্জন করেন তা দিয়ে পরিবার চালাতে কষ্ট হয়। কিন্তু তবুও পাখিদের জন্য তার অগাধ ভালোবাসা।
তাই প্রতিদিন গড়ে ২০টি গাছে পাত্র বাঁধছেন নিজ খরচে। পাত্রগুলোতে লেখা, ‘পাখির জন্য পানি’। কাজের জন্য তিনি যখন যে গ্রামে যাচ্ছেন, সেখানেই গাছে পাত্র বেঁধে দিচ্ছেন। গত এক সপ্তাহে রামনগর, কালুহাটি, ডেফলবাড়ি, চণ্ডীপুর গ্রামসহ ঝিনাইদহ শহরেও প্রায় ৮০টি গাছে পাখির জন্য পানির পাত্র বেঁধেছেন তিনি।
এই তীব্র গরমে পাখিদের জন্য পানির ব্যবস্থার এমন উদ্যোগ শুরু হতে পারে সারাদেশে, প্রতিটি গ্রাম ও নগরে।
করোনাপরবর্তী সময়ে রাজধানীতে প্রায় ঘরে ঘরে প্রাণি ও পাখি পোষার প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। কিন্তু বাহিরে থাকা কুকুর, বিড়াল, কাক ও চড়ুই পাখির প্রতি আমরা কতটা আন্তরিক হয়েছি? নগরে এই তীব্র গরমে রাস্তায়, বাড়ির জানালায়, বারান্দায় বা ছাদে সামান্য পানি ও খাদ্য রেখেই আমরাও খুব সহজে পাখি ও প্রাণিগুলোকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে পারি। এমন উদ্যোগ পরিবারের শিশুদের মধ্যে পাখি ও প্রাণিদের প্রতি ভালোবাসারও শিক্ষা দিবে।
আরেক পাখিবন্ধু আকাশকলি দাসের কথা হয়তো অনেকেই জানেন। তার বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলা সদর উপজেলার কৈটোলা গ্রামে। বয়স এখন নব্বই ছুঁইছুঁই। তিনি চিরকুমার। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আজও পাখি আর প্রাণিরাই তাঁর স্বজন।
পাখি ও প্রাণিদের প্রতি আকাশকলি দাসের ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। পরবর্তীকালে পৈতৃক সূত্রে তিনি পান একটি বড় বাড়ি। বাড়িটির আশপাশের বেশির ভাগই ছিল বড় বড় গাছ আর জঙ্গলে ঢাকা। সেই গাছে বাসা বাঁধে নানা প্রজাতির অজস্র পাখি।
এসব পাখির প্রতি দৃষ্টি পড়ে শহরের পাখি শিকারিদের। এয়ারগান নিয়ে তারা নিয়মিত হানা দিতো সেখানে। তাদের পাখি হত্যা ঠেকাতেই আকাশকলি পাহারা বসান। অতঃপর পাখিদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। ভাত রেঁধে গাছের নিচে কলা পাতায় রাখা শুরু করেন। নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পেয়ে দিনে দিনে পাখির সংখ্যাও যায় বেড়ে। এভাবেই তার পাখিবন্ধু হওয়ার শুরু।
এখন তার অবসর কাটছে পাখিদের নিয়েই। পাখিদের না খাইয়ে নিজে খেতে বসেন না আকাশকলি দাস। পাখিরা তার সন্তানের মতো।
দিনাজপুরের ভাটিনা গ্রামের মানুষরাও পাখিদের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি করেছেন। সেই গ্রামে গিয়েছিলাম বারকয়েক। পাখিগ্রাম দর্শনের সেই অভিজ্ঞতা আজও মনে দাগ কেটে আছে।
দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার ভেতরে ভাটিনা গ্রামটি। এর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে ধানখেত। মেঠোপথে গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে বড় সাইনবোর্ড ‘পাখি সংরক্ষিত এলাকা, পাখি মারা নিষেধ’। গ্রামের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক বাঁশঝাড়। রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট পুকুরও। পুকুরগুলো আবার বাঁশ ও আমগাছে ঘেরা। যতই ভেতরে যাওয়া যায়, ততই পাখির কিচিরমিচির শব্দ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে।
ভাটিনা গ্রামের বাঁশঝাড়ের ডালে ডালে দেখা মেলে শত শত পাখি—চড়ুই, পানকৌড়ি, সাদাবক, কুনিবক, গুটকল, রাতচোরা, ঘুঘু, টিয়া, শালিক, বক আর মাছরাঙা। মনে হয় পাখিদের মহামিলন উৎসব যেন। বাঁশঝাড়ে দেখা পাওয়া যায় সহস্র পানকৌড়ির। পানিতে ডুব দিয়ে ঠোঁট দিয়ে তারা ধরে আনে ছোট্ট ছোট্ট মাছ। ভাটিনা গ্রামে পাখিদের এমন আনন্দ দৃশ্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
এ গ্রামের শত শত একর জমিতে আবাদ হয় টমেটোর। টমেটো বাগানগুলোতে পাখিদের বসার জন্য গেড়ে দেওয়া হয়েছে বাঁশের ছোট ছোট কঞ্চি। পোকার হাত থেকে রেহাই পেতেই এ ব্যবস্থা। কীটনাশক নয়, এখানে পাখির মাধ্যমে পোকার উপদ্রব কমানোর পদ্ধতি এটি। বসার জায়গা থাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে খেয়ে যায় সব পোকা। ফলে টমেটোর আবাদে কীটনাশক লাগে না। এতে পরিবেশ বাঁচে, বাঁচে কৃষকের খরচও। এভাবেই ভাটিনা গ্রামে প্রকৃতিই বাঁচিয়ে রাখে প্রকৃতিকে।
পাখিদের সঙ্গে গ্রামবাসীরও রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। ঝড়বৃষ্টিতে ভাটিনাবাসী বেরিয়ে পড়ে কুলা হাতে। খুঁজে খুঁজে বের করে আনে ঝড়ে আহত পাখিগুলোকে। সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে বাসায় (বাঁশঝাড়ে) পৌঁছে দিয়ে আসে তাদের। যেসব পাখি মারা যায়, তাদের জন্য কষ্ট হয় গ্রামবাসীর। মাটির গর্তে সেগুলোকে কবর দেয় তারা।
কিন্তু ভাটিনার মানুষদের এমন পাখিপ্রেম কি আগে ছিল? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। গোটা গ্রামে তখনও ছিল পাখিদের আনাগোনা। ফাঁদ পেতে পাখি ধরা ছিল গ্রামবাসীর দৈনন্দিন ব্যাপার। বিত্তবানরা এয়ারগান চালাতেন দিনভর। দিন শেষে মোটরসাইকেলে মৃত পাখির ঝাঁক ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরত শিকারিরা।
গ্রামের কলেজপড়ুয়া যুবক একরামুল হক। থাকেন ভাটিনায়, খালার বাড়িতে। নিজেদের ভাগ্য গড়া আর গ্রামের মানুষদের জন্য কাজ করার স্বপ্ন তিনি ছড়িয়ে দেন যুবকদের মধ্যে। তৈরি করেন ‘আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতি’। নিজ অর্থায়নে নানা প্রকল্পও হাতে নেন তারা।
সমিতির সভাপতি হিসেবে একবার একরামুলই প্রস্তাব করেন পুরো গ্রামটিতে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার। সেই থেকে শুরু। পাখি না মারার প্রস্তাবে প্রথমেই সম্মতি দেন স্থানীয় প্রভাবশালী হাশেম তালুকদার মেম্বার। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছেড়ে নিজের এয়ারগানটি ছুড়ে ফেলে দেন তিনি। শপথ নেন পাখি হত্যা না করার। ফলে অন্যরাও উৎসাহিত হন। এ নিয়ে মসজিদে মসজিদে চলে প্রচার। গ্রামে ঢোকার তিনটি প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়া হয় ‘পাখি মারা নিষেধ’ লেখা বড় সাইনবোর্ড। গ্রামবাসীর ভালোবাসায় এভাবেই পুরো গ্রাম মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে।
কয়েকবছর আগে পাখি নিয়ে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের একটি ঘটনা বেশ আলোচিত হয়। সেখানে রয়েছে অনেক আমবাগান। বাগানের প্রায় ৫০টি গাছে বাসা বাঁধে দেশি প্রজাতির শামুকখোলা পাখি। আমবাগানের মালিকরা মনে করলেন তারা সৌভাগ্যবান। কারণ, বাঘায় অনেক আমবাগান আর অসংখ্য গাছ রয়েছে। কিন্তু সবার গাছে বাসা বাঁধেনি শামুকখোলা পাখি। এই পাখিটি ধানখেতের শামুক খেয়ে পরোক্ষভাবে আমাদের উপকার করে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হয়।
সময়টা ছিল তাদের প্রজননের। তাই প্রতিটি গাছে শামুকখোলা পাখিগুলো ডিম দিয়েছে। ডিম ফুটে বাচ্চা হলেই তারা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। কিন্তু ঠিক তখনই যদি পাখির বাসাগুলো ভেঙে দেয়! তাহলে পাখির ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভবিষ্যতে ওই বাগানের গাছে শামুকখোলা পাখিগুলো আর আসবে না, বাসাও তারা বাঁধবে না।
গণমাধ্যমে উঠে আসা এমন একটি প্রতিবেদন মহামান্য হাইকোর্টের নজরে এলে বিজ্ঞ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যতিক্রমী এক আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, ‘আমবাগানের পাখির বাসা কখনোই ভাঙা যাবে না।’ একই সঙ্গে খোর্দ্দ বাউসা গ্রামকে কেন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চান হাইকোর্ট।
মহামান্য আদালতের কারণেই পাখির বাচ্চাগুলো রক্ষা পায় তখন। পরে শামুকখোলা পাখিগুলোকে রক্ষায় আমবাগানের মালিকপক্ষ, ইজারাদার ও আম ব্যবসায়ীদের বছরে মোট ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছিলেন। তাই রাজশাহীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক হামিদুল হক পাখিগুলোকে রক্ষায় ওই টাকার বরাদ্দ চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের আমবাগানে পাখির বাসাভাড়া হিসেবে ওই টাকা দেয় সরকার। যেসব আমবাগানে পাখির বাচ্চা হয়েছে, সেসব বাগানমালিক পাখির বাসার জন্য পান ওই টাকা। যা ছিল সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ। এভাবে স্থানীয়দের সচেতনতা আর উদ্যোগ থাকলেই রক্ষা পাবে পাখির আবাসগুলো।
পাখিরা আমাদের পরিবেশের বড় সম্পদ। প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খলে স্বাভাবিক ধারা বজায় রাখা, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভিদের পরাগায়ণ ও বীজের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পাখির। কিন্তু নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, খাদ্যসংকট, জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে এমনিতেই অনেক পাখি বিলুপ্তির পথে।
তারপরও শীত মৌসুমে সারা দেশেই নানা ধরনের দেশি ও অতিথি পাখির আনাগোনা শুরু হয়। তখন বেড়ে যায় এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার, বিষটোপ দিয়ে পাখি মারা, ফাঁদ পেতে আর ধানখেতে কারেন্ট জাল দিয়ে পাখি ধরার প্রবণতা। পাখি রক্ষায় সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগের চেয়েও কার্যকর হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি।
তাই এই তীব্র গরমে তৃষ্ণার্ত পাখিদের জন্য পানি রাখার উদ্যোগ নেওয়া হোক গ্রামে গ্রামে, শহরে বন্দরে। পাশাপাশি পাখি হত্যা, পাখি শিকার ও পাখির বাসা ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখতে স্থানীয়দের নিয়ে পাখি রক্ষা কমিটিও করা যেতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন থেকেও পাখি নিধন রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি এখনই শুরু করা প্রয়োজন। আর এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সচেতন তরুণ ও যুবকদেরই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল সন্ধ্যা ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৮ এপ্রিল ২০২৪
© 2024, https:.