শব্দদূষণ নিয়ে মুখে রা নেই দায়িত্বশীল কারোরই
কিভাবে বুঝবেন যে আপনি রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করেছেন? এক বন্ধুর এমন প্রশ্নে বেশ অবাক হই। দুয়েকজন বললেন জ্যামের কথা। কিন্তু খানিক পরে বন্ধুটি মুচকি হেসে উত্তরে বললেন—যত্রতত্র হর্ন আর শব্দদূষণের কথা।
সত্যিই কি তাই? ঢাকার শব্দদূষণের বর্তমান অবস্থা আসলে কেমন? সেটি জানতেই এই লেখার অবতারণা। ঢাকা মহানগরে যারা চলাচল করেন তারা হয়ত একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেই এর উত্তরটি বলতে শুরু করবেন।
সেনানিবাসে আইন মানে বাইরে মানে না
নিজের অভিজ্ঞতাটি আগে তুলে ধরছি। আমার বসবাস ঢাকার সেনানিবাস সংলগ্ন কাফরুল এলাকায়, তাই চলাচল করতে হয় সেনানিবাসের ভেতরের রাস্তা দিয়েই। দিনের বিশেষ সময়ে সেখানেও জ্যামের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটি নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ঠিক হয়ে যায়। ওভারটেকিং কিংবা অযথা হর্ন বাজানো থেকে সচেতনভাবেই সবাই বিরত থাকে সেখানে।
কিন্তু ওই এলাকার বাইরে আসতেই অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়। যানজটে শত শত গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। সেনানিবাসের ভেতর থেকে আসা ওই একই চালকেরা (প্রাইভেট কার, বাস ও সিএনজি) কারণে বা অকারণে ক্রমাগত হর্ন বাজাতে থাকেন। হর্ন বাজানোর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি সেটি হয়ত সে নিজেই জানে না। হর্ন থাকা মানেই যেন সেটি বাজাতে হবে। হোক তা হাসপাতাল বা স্কুলের সামনের রাস্তা। এ নিয়ে কেউ কোনও তোয়াক্কাও করে না।
ইদানিং আবার আরেক বিপত্তি ও যন্ত্রণার নাম হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেল। জ্যাম দেখলেই সেটি উঠে আসে পথচারী চলাচলের রাস্তায়। ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে চলাতেই যেন তাদের স্বাচ্ছন্দ্য। কেউ প্রতিবাদ করলেও রক্ষা নেই। কাছাকাছি থাকা সব মোটরসাইকেলের চালকেরা একত্র হয়ে প্রতিবাদকারীর ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও কম ঘটছে না। এভাবে এ নগরে যত্রতত্র হর্ন বাজানোটা যেন চালকদের অধিকারে পরিণত হয়ে গেছে!
রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নামলে মনে হবে যানবাহনের চালকরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এক্ষেত্রে চালকদের সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারেন যাত্রীরাও।
হর্ন বাজিয়ে শব্দ দূষণ করা কিন্তু সেনানিবাস এলাকায় ঘটছে না। কেননা সেখানে আইনের মুখোমুখি হওয়ার ভয় থাকে। তাহলে সেনানিবাসের বাইরে হর্ন বাজানো নিয়ে আইনের কি কোনও প্রয়োগ নেই?
নগরের কোথায় শব্দদূষণ কতটা
এই নগরে শব্দহীন জায়গা বা রাস্তা কোনটি? সাধারণ নিয়মে হাসপাতাল, মসজিদ বা বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী রাস্তা শব্দহীন থাকার কথা। এ নিয়ে সরকারি নিয়মও আছে। কয়েক বছর আগে সচিবালয় এলাকাকে ‘নো হর্ন জোন’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি কি বাস্তবে আছে? উত্তরটি এখন আর খুব সহজে দেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। কেননা নগরের কোনও জায়গা বা রাস্তাই এখন আর শব্দের অত্যাচারমুক্ত নয়। বরং যত্রতত্র শব্দ সৃষ্টি করা যেন প্রায় নাগরিক অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে!
শব্দদূষণ নিয়ে মুখে রা নেই দায়িত্বশীল কারোরই! ঢাকা উত্তরের মেয়র যানজট, জলজট ও মশক নিধনের প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। সেটি অবশ্যই ভালো দিক। ঢাকা দক্ষিণের মেয়রও এমন বিষয়গুলো কাজের কথা বলছেন। কিন্তু দুই মেয়রের কারুর মুখেই নগরের শব্দদূষণ নিয়ে টু শব্দটিও উচ্চারিত হয়নি। ফলে নাগরিকরাও জানে না শব্দদূষণ নিয়ে তাদের পরিকল্পনাগুলোর কথা, যা জানানো প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দের মাত্রা ৮৬ ডেসিবেল বা তার চেয়ে বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল আর রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত। আর বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালের মতো ‘সাইলেন্ট জোন’ বা ‘নীরব এলাকা’য় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে।
উত্তরার শাহজালাল এভিনিউয়ে শব্দমাত্রা ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল, মিরপুর-১ এ ৯৬ ডেসিবেল, পল্লবীতে ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে সর্বোচ্চ ১০৪ দশমিক ১, শাহবাগে ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে ৮৮ ডেসিবেল।
মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানবদেহে কী সমস্যা তৈরি করে
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন মানুষ ক্রমাগত উচ্চশব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে তার শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি মানুষের ঘুমের সমস্যা তৈরি করা সহ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্ষুধামন্দা ও উদ্বেগজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয়, দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার হলে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতাও প্রবলভাবে লোপ পায়। স্কুল, কলেজ বা হাসপাতালের পাশে যে শব্দ হয়, সেখানে মানুষ মনোযোগ দিতে পারে না। এতে যেকোনও কাজের পারফরম্যান্স নষ্ট হয়। শব্দ মানুষের মস্তিষ্কে সরাসরি আঘাত করে। ফলে, মানুষের মেজাজ বিগড়ে যায়, সব সময় সে অস্থিরতায় ভোগে। আবার সোশ্যাল ভায়োলেন্সেরও একটা বড় কারণ এই শব্দদূষণ।
কত ভাগ মানুষ শব্দদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নিয়ে তেমন গবেষণা নেই। তবে ২০১৬ সালের এক বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, সরাসরি এক-তৃতীয়াংশ মানুষ শব্দদূষণ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এর পরিমাণ বর্তমানে আরও বেড়েছে বলেই মনে করেন অনেকেই। তাই এ নিয়ে আরও গবেষণার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
আইন আছে আইনের প্রয়োগ নেই
শব্দদূষণ নিয়ে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই একেবারেই। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিমালায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেটি অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা ও সেই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা দণ্ডনীয়। কিন্তু বাস্তবে সেই আইন প্রয়োগের খবর বছরে একটিও উঠে আসে না গণমাধ্যমে। ফলে আইনি বাধার মুখে না পড়ায় নাগরিকদের আইন না মানার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অনেকেই মনে করেন, ঢাকার শব্দদূষণের প্রধান কারণ যথেচ্ছাচারে যানবাহনের হর্ন বাজানো। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। অযথা হর্ন বাজানো বন্ধে পুলিশের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা নেই, যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নগর-মহানগরে, এমনকি কোনও কোনও গ্রামীণ জনপদেও এখন শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করে গেছে। শব্দদূষণের কুফল বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব এবং দূষণ প্রতিরোধে যথাযথ প্রশাসনিক নজরদারি ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শব্দদূষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে।
রাজধানীতে শব্দদূষণের বহু উৎস রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। যানবাহনের হর্ন, নির্মাণকাজ, সংস্কারের সময় পরিষেবা সংস্থাগুলোর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, যত্রতত্র মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা— কোনও ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে যথাযথ নিয়ম মানা হয় না। কর্তৃপক্ষের উচিত দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া।
শব্দদূষণ নিয়ে শব্দ করতে হবে সবারই
শব্দদূষণের প্রভাব বায়ুদূষণের মতো খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিক অনেক। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা ছাড়াও শব্দদূষণ প্রতিরোধে বিশেষভাবে প্রয়োজন ব্যাপক পরিমাণ নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি করা, যা খুব সহজেই তৈরি করতে পারেন নগরের মেয়ররা।
শব্দদূষণ নিয়ে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই এখন। এ নিয়ে সচেতনতা তৈরিরও বিকল্প নেই। নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সকলকেই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে শব্দ করতে হবে সকলে মিলেই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল সন্ধ্যা ডটকমে, প্রকাশকাল: ৯ মে ২০২৪
© 2024, https:.