কলাম

ঝিনুক থেকে চুন তৈরির গ্রাম

লোকসংস্কৃতির প্রাচীন রীতি পান খাওয়া। পান খেয়ে ঠোঁট ও জিহ্বা লাল করাতেই যেন এখানকার সরলপ্রাণ মানুষের আনন্দ। পানকে সুস্বাদু করে চুন। সবারই পছন্দ ঝিনুকের চুন। দিনাজপুরেই রয়েছে এ চুন তৈরির একাধিক গ্রাম। খবরটি জেনে এক সকালে বন্ধু কাজিমের সঙ্গে পা রাখি ঝিনুক চুনের এক গ্রামে। গ্রামের নাম ভবাইনগর। দিনাজপুর শহর থেকে ফুলবাড়িয়া যাওয়ার রাস্তায় কিলো ছয়েক পথ পেরোলেই মিলবে গ্রামটি। স্থানীয়দের কাছে এটি চুনিয়াপাড়া নামে পরিচিত।

ভাদ্র মাস। তাল পাকা গরম। চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এ সময় প্রকৃতিতে অবগাহন করতেই এসেছি দিনাজপুরে, এক বন্ধুর বাড়িতে।কান্তজীর মন্দির, রামসাগর, রাজবাড়ির মতো অনন্য সব ঐতিহাসিক স্থানের পরশ নিয়ে ঘুরে দেখছি দিনাজপুরের পথ-প্রান্তর। এখানে এসে পান খাওয়ার রীতিটি বেশ নজরে আসে। লোকসংস্কৃতির প্রাচীন রীতি এই পান খাওয়া। পান খেয়ে ঠোঁট ও জিহ্বা লাল করাতেই যেন এখানকার সরলপ্রাণ মানুষের আনন্দ।

পানকে সুস্বাদু করে চুন। এখানকার সবারই পছন্দ ঝিনুকের চুন। দিনাজপুরেই রয়েছে এ চুন তৈরির একাধিক গ্রাম। খবরটি জেনে এক সকালে বন্ধু কাজিমের সঙ্গে পা রাখি ঝিনুক চুনের এক গ্রামে।

গ্রামের নাম ভবাইনগর। দিনাজপুর শহর থেকে ফুলবাড়িয়া যাওয়ার রাস্তায় কিলো ছয়েক পথ পেরোলেই মিলবে গ্রামটি। স্থানীয়দের কাছে এটি চুনিয়াপাড়া।

একটি বাড়ির উঠানে ঝিনুক ছড়ানো। গল্প জমিয়ে সেখানে কাজ করছেন এক দম্পতি—মঙ্গল চন্দ্র দেবনাথ ও  নেপালী রানী।

বাঁশের চালুনিতে ঝিনুকের ময়লা সরিয়ে নিচ্ছেন স্ত্রী আর চুনের উপযোগী ঝিনুকগুলোকে আলাদা করে রেখে দিচ্ছেন স্বামী। চুন তৈরি তাঁদের পূর্বপুরুষের পেশা। মঙ্গলের ভাষায়, ‘চৌদ্দগুষ্টি ধরে চুনের কর্ম করে যাই।’

জানা যায়, মোহনপুর, চিরিরবন্দর, বনতারার মতো নদী এলাকায় কিছু লোক নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করেন। সেই ঝিনুকের খোসা কিনেই তৈরি করা হয় চুন।

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, কালের কণ্ঠ

মঙ্গলের ভাষায়, ‘ওরা পানিতে ডুব দিয়া ঝিনাই তুলি নিয়া আসে, হাঁসে খাই নেয়, মানুষে খাই নেয় মাংসটা, আমরা খোসা কিনে চুন বানাই। এক ডালি (১০ কেজির মতো) ঝিনুক ১০০ টাকায় কিনি। তিন মণ মাল লাগে হামার।’

চুন যাঁরা তৈরি করেন, সবাই তাঁদের ‘চুনিয়া’ বলেই ডাকে। ঝিনুক এনে চুনিয়ারা প্রথমে পরিষ্কার করেন। এরপর কুটিতে (ঝিনুক পোড়ানোর এক ধরনের চুলা) খড়, কাঠ ও ঝিনুক পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে আগুনে পোড়ান। পোড়া ঝিনুক চালুনির মাধ্যমে বেছে মাটির গর্তে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়। অতঃপর তাতে পানি মিশিয়ে নাড়লেই তৈরি হয় মণ্ডের মতো চুন। এক মণ ঝিনুক থেকে চুন হয় ১৩ কেজি। বিশেষ কায়দায় পানি মিশিয়ে তা ৫০ কেজি করা হয়।

এভাবে প্রস্তুতকৃত চুন জালের সাহায্যে ছেঁকে, বাঁশের ঝুড়িতে কলাপাতায় মুড়ে হাট-বাজারে ফেরি করেন চুনিয়ারা। তাঁদের দেখলে দোকানিরা হাঁকডাক দিয়ে বলেন, ‘চুনিয়া ভাই আইছে, চুন ধরি।’

ঝিনুক চুন কেন ভালো? মঙ্গল বলেন, ‘এই চুনে ক্যালসিয়াম বেশি। অন্য চুন খাইলে অসুখ-বিসুখ হয়। একটু বেশি খাইলেও মুখ পুড়ে যায়। এই চুনে মুখ পোড়ে না।’

লাভের কথা উঠতেই মলিন মুখে নেপালীর উত্তর, ‘৩০ টাকা কেজি বিক্রি করে পাঁচ টাকা লাভ। খাটন হিসেবে কোনো লাভ নাই।’

চুন তৈরির কষ্টের কথা জানান পাশের বাড়ির রানী বালা। তাঁর ভাষায়, ‘মাথা চক মারে। গোটা অঙ্গটা চুনদি শানা হয়ে যায়। শরীরে ব্যথা হয়, জ্বর আসে। শীতের সময় শরীরে কাঁপ আসি যায়।’

রানীর সঙ্গে কথা জুড়ে দিয়ে নেপালী বলেন, ‘মাঝে মাঝে ফুটি যায় আঙুলের মাথাগুলো। হাতের তালুতেও ক্ষত হয়। তখন গরম ভাত হাত দি নাড়তে পারি না।’

ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরি একটি শিল্প। কিন্তু স্বল্প পুঁজির কারণে আজ হুমকির মুখে পড়েছে চুনিয়াদের আদি এ পেশাটি। এই শিল্পটিকে বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষ পাতায়, প্রকাশকাল: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button