উচিতপুরে যাওয়া উচিত
উচিতপুর ঘাটের ডুবো রাস্তার দুই পাশে বড় বড় ট্রলার বাঁধা। ট্রলারের নামগুলোও বেশ—স্বাধীন পরিবহন, ভাই ভাই পরিবহন, আশিক পরিবহন প্রভৃতি। এখান থেকেই যাওয়া যায় মাগান, জয় বাংলা, গোবিন্দশ্রী, কদমশ্রী, জগন্নাথপুর, খালিয়াজুরী, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও টাঙ্গুয়ার হাওর অঞ্চলে। পর্যটনশিল্পের বিকাশে নতুন নতুন স্থানকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং ভ্রমণপ্রেমীদের আসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার উদাহরণ উচিতপুর, পর্যটকদের পদচারণে যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকেও গতিশীল করছে।
বিকেল হয় হয়। কয়ার হাওরে ভাসছি তখন। হঠাৎ দুলে ওঠে ট্রলারটি। চারপাশে দমকা হাওয়া।বড় বড় ঢেউ এসে দোলা দিচ্ছে। ট্রলারের ভেতর থেকে চোখ রাখি আকাশে। কখন যে মেঘ জমেছে, টেরই পাইনি। ক্রমেই তা ঢেকে দিচ্ছে তপ্ত সূর্যটাকে।
মেঘের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের রশ্মি। মেঘ-সূর্যের এ এক অনন্য খেলা। খুব কাছেই ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা, পাল তোলা। ঢেউয়ের তালে দুলছিল নৌকায় বসা দুজন।
তবু জাল ফেলে আপন মনে বিশেষ কায়দায় মাছ ধরছে তারা। দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গাছ। শরীরটা জলে ডুবিয়ে কোঁকড়ানো সবুজ চুলগুলো যেন ভাসিয়ে রেখেছে গাছগুলো। মাঝি জানাল, ওগুলো হিজলগাছ। সব কটি গাছেই ঠায় দাঁড়িয়ে মাছরাঙার দল।
একেকটির রূপ একেক রকম। হঠাৎ চোখের সামনেই একটি মাছরাঙা হাওরের পানিতে দেয় ডুব। খানিক পরে উঠতেই তার ঠোঁটে নড়ছিল ছোট্ট একটি মাছ।
মনোমুগ্ধকর এমন দৃশ্যের গল্প শুনলে উচিতপুর যাওয়া উচিত কি না—সে সিদ্ধান্ত নেওয়াও খুব সহজ হয়। নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার এই হাওর অঞ্চল ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই ঢাকার মহাখালী থেকে বাসে সরাসরি চলে আসি উচিতপুরে।
যখন পৌঁছি, তখন মধ্য দুপুর। এরই মধ্যে ভিড় লেগেছে শত শত মানুষের। ছুটির দিনে সেই ভিড় হয় হাজারেরও ওপরে। পাকা একটি রাস্তা চলে গেছে গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের দিকে। কিন্তু গোটা রাস্তা পানির নিচে। সেখানে গা ভিজিয়েই আনন্দ করছে সবাই। দূরে বড় একটি ব্রিজ। হাওরের দৃশ্য দেখা যায় ওই ব্রিজ থেকেই। এ ছাড়া রাস্তার পাশে পানির ওপর সরকারিভাবে নির্মিত হয়েছে পর্যটনকেন্দ্র-কাম-রেস্টহাউস। অনেক ভ্রমণপ্রেমী সেখানে বসেই উপভোগ করে হাওরের অপার সৌন্দর্য।
উচিতপুর ঘাটের ডুবো রাস্তার দুই পাশে বড় বড় ট্রলার বাঁধা। ট্রলারের নামগুলোও বেশ—স্বাধীন পরিবহন, ভাই ভাই পরিবহন, আশিক পরিবহন প্রভৃতি। এখান থেকেই যাওয়া যায় মাগান, জয় বাংলা, গোবিন্দশ্রী, কদমশ্রী, জগন্নাথপুর, খালিয়াজুরী, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও টাঙ্গুয়ার হাওর অঞ্চলে।
স্থানীয় যুবক আলমকে সঙ্গে নিয়ে একটি নৌকা ভাসাই আমরা। হঠাৎ ভাটি বাংলার গানের সুর বাতাসে ভেসে আসে—‘মাটিরও পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে, তোমারে পুষিলাম কত আদরে।’ মানুষভর্তি একটি ট্রলার ছুটে আসছে। মুচকি হেসে মাঝি বলল, ‘বিয়ের ট্রলার।’ দূরের গ্রাম থেকে কনে নিয়ে ফিরছে বরপক্ষ। যুবক-যুবতীরা হাত নেড়ে ইশারাও করে। একসময় ট্রলারটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় দূর হাওরে। তখন বিভোর হই হাওরে সূর্য ডোবার দৃশ্যে।
পর্যটনশিল্পের বিকাশে নতুন নতুন স্থানকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং ভ্রমণপ্রেমীদের আসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার উদাহরণ উচিতপুর, পর্যটকদের পদচারণে যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকেও গতিশীল করছে।
তবে প্রতিবন্ধকতাও আছে। আলম অকপটে বললেন, ‘উপজেলা থেকে উচিতপুর ঘাটে যাওয়ার রাস্তাটি প্রশস্ত করা, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ আর হাওরের পরিবেশ ঠিক রেখে স্থাপনা গড়া বিশেষ প্রয়োজন।’ ভ্রমণপ্রেমীদের প্রতি অনুরোধও জানান আলম। বলেন, ‘সাঁতার না জানলে হাওরে না নামাই ভালো। ট্রলারে ঘুরতে সতর্কতা অবলম্বন করা, হাওরে ও ঘাটে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, খাবার, বিস্কুট ও চানাচুরের প্যাকেট, পলিথিন প্রভৃতি ফেলে পরিবেশের বিপন্নতা ঠেকাতে আন্তরিক হতে হবে সবাইকেই।’ তবেই মানুষ মনে করবে—যাওয়া উচিত উচিতপুরে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায়, প্রকাশকাল: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.