এত জ্ঞান নিয়ে এই লোক ঘুমান কীভাবে
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কাছে খুব একটা ভিড়তাম না। দূরে দূরেই থাকতাম। তবে তার বক্তৃতা শুনেছি আগ্রহ নিয়ে, মনমুগ্ধ হয়ে।একজন মানুষ কীভাবে এত চমৎকারভাবে সম্মোহনী কথা বলতে পারেন, অবাকই হতাম। যুক্তি, রস, উৎসাহ আর দায়িত্ববোধ- সবই থাকতো স্যারের বক্তৃতায়। আজও তা আছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের নানা ঘটনার উদাহরণ তিনি টেনে আনেন অনায়াসে। যেন চোখের সামনেই ঘটছে সব। এত জ্ঞান নিয়ে এই লোক ঘুমান কীভাবে? সে চিন্তায় কয়েকদিন নিজেরই ঘুম হলো না।
নানা প্রশ্ন ঘোরে মগজে। মূলত স্যারের বক্তৃতাই আমাকে আন্দোলিত করেছে প্রবলভাবে। ভাল-মন্দের প্রভেদ বোঝা, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিকে একত্রিত করে এগিয়ে চলা, নিজে বড় হওয়ার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখা, ভাল কাজে যুক্ত থাকা- এইসব ভাবনা আমাদের মনে অঙ্কুরিত হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকেই।
কেন্দ্রের ছাদটা ছিল সবচেয়ে আপন। কারও জন্মদিন উদযাপন, কবিতা বা লেখা নিয়ে আলোচনা, বন্ধুদের মান-অভিমান, প্রেমিক যুগলের আড্ডা, প্রেমে ব্যর্থ বন্ধুর ঝিমুনি, দেশ ও সমাজ পাল্টে ফেলার স্বপ্ন দেখা- আরও কতকিছুই না ঘটছে ওই ছাদে।
আড্ডার ফাঁকে কিছু লেখালেখির কাজ শুরু হয় তখনই। এক সময় যুক্ত হই কেন্দ্রের বই পড়া কার্যক্রমের সঙ্গে। স্কুল সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করি জাতীয় ভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমে। সামান্য কিছু সম্মানী মিলত তখন। একবার সম্মানী একশ টাকা বৃদ্ধির কারণে আমাদের সেকি আনন্দ! লক্ষ টাকা পেলেও এখন কেন জানি ওই আনন্দটা পাই না।
কেন আমরা কেন্দ্রকে সবচেয়ে আপন করে ফেলেছিলাম? উত্তর কিন্তু মিলে, সায়ীদ স্যারের প্রতি একটা অদৃশ্য টান বা তার প্রভাব ছিল ও আছে ওখানে। আমাদের কাছে সুরঞ্জনা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল জায়গা। সেখানে ছোট্ট একটা রুমে বসতেন মনির ভাই আর ফারুক ভাই। জাতীয় ভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের কাজে নানা জটিলতা তৈরি করে কতইনা যন্ত্রণা করেছি তাদের।
তবে একথা নিঃসংকোচে বলতে পারি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মনির ভাই, মেসবাহ উদ্দিন সুমন, কামাল ভাই প্রমুখের মতো নিবেদিত মানুষরা যুক্ত ছিল আর আছে বলেই কেন্দ্র হাজার হাজার কিশোর-তরুণদের মনে আলো ছড়াচ্ছে। স্যার হয়তো কোন কাজের আওয়াজ তুলেছেন, সে কাজটিকে বাস্তবায়নের মূল কর্মী আজও এরাই।
আমার সময়ে বইপড়া কার্যক্রম চালু হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের আওতাধীন স্কুলগুলোতে। তবে সায়ীদ স্যারের পরিচিতির কারণেই সেটি সহজ হয়েছিল। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের প্রধান কার্যনির্বাহী তখন ছিলেন শফিক আলম মেহেদী ভাই (সাবেক সচিব)। তিনি নিজেই বই পড়ুয়া মানুষ, একজন কবিও। সায়ীদ স্যারকে পছন্দ করতেন। ফলে শুধু অনুমতিই মিলল না, তিনি নিজেই টেলিফোন করে সব স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলেও দিলেন। এভাবে সায়ীদ স্যারের আলোয় অনেক জটিল কাজও সহজ হয়ে গিয়েছিল।
স্কুল সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলাম প্রায় তিন বছর। বিদ্যালয়ের ভেতরে ধর্ম শিক্ষকদের বিরূপ মনোভাবকে এড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটা ছিল সত্যি অন্যরকম। তাছাড়া শত শত মানুষের সামনে কথা বলার চমৎকার একটা ট্রেনিংও হয়ে যায় ওই সময়। এসব কাজ জীবন চলার পথে নিজের জন্য অন্যরকম একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে, যা ঘটেছে প্রায় নিঃশব্দে। তাই সায়ীদ স্যার আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজও আমাদের কাছে আস্থার জায়গা।
কেন্দ্রে আমাদের স্মৃতিময় সেই ভবন আজ নেই। প্রজন্মের কথা ভেবে আরও বড় ভবন তৈরি হয়েছে। কাজের পরিধিও বেড়েছে অনেক। নিয়মিত কর্মসূচির পাশাপাশি চলছে সরকারের সঙ্গে কিছু প্রকল্পও। লাখো শিশু, কিশোর আর তরুণেরা আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে আলোকিত হচ্ছে। আমাদের প্রিয় মানুষ সায়ীদ স্যারের বয়স বেড়েছে। কিন্তু তার জ্যোতিও বেড়েছে বহুগুণ। একজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এখন প্রজন্মের কাছে অন্যরকম এক পরশ পাথর।
নানা সমস্যা কাটিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে। বিশ্বের মাঝে আমরাও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছি। উন্নত ও বৈষম্যহীন দেশ গড়তে প্রয়োজন বহু সংখ্যক আলোকিত মানুষ। সেই স্বপ্নবান মানুষ গড়তে অনন্য ভূমিকা রাখছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সায়ীদ স্যারের আলোই আমাদের পথ দেখিয়েছে, প্রজন্মকেও পথ দেখাবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৬ অক্টোবর ২০২৪
© 2024, https:.