খটখট শব্দে লাঠিখেলা
সুস্থ মস্তিষ্ক, তীক্ষ দৃষ্টি আর দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন লাঠিখেলার মূলমন্ত্র। ফসল ঘরে তোলার পর আর মহররমের সময়টাতে বেশি হয় লাঠিখেলা। বাংলাদেশে লাঠিখেলার প্রচলন শুরু হয় ওস্তাদ সিরাজুল হক চৌধুরীর হাত ধরে। ১৯৩৩ সালে তিনি নিখিল বঙ্গ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন।
দেশভাগের পর একে পূর্ব পাকিস্তান লাঠিয়াল বাহিনী এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী নাম দেওয়া হয়। লাঠিয়ালদের সংগঠিত করা এবং ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ধরে রাখাই এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য
শীত এখন দরজায় কড়া নাড়ছে। এরই মধ্যে গ্রামে-গঞ্জে চলছে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী মেলা ও খেলার আয়োজন। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খেলার মধ্যে লাঠিখেলা অন্যতম।
তবে খেলাটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
একবার লাঠিখেলা দেখতে যাই রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে। সেখানে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে আসেন বেশ কয়েকজন লাঠিয়াল সরদার। যখন পৌঁছি, সকালের সূর্য তখনো তপ্ত আলো ছড়ায়নি।
পুলিশ লাইনস মাঠের এক কোণে লাঠিয়াল বাহিনীর লাঠিয়ালরা। পোশাক পাল্টে বিশেষ ধরনের পোশাক পরছেন তারা। কেউ কেউ হাতের লাঠিটি ঘুরিয়ে পরখ করে নিচ্ছেন। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ থেকে আছেন তরুণ বয়সী লাঠিয়াল। দু-একজন নারী লাঠিয়ালও এসেছেন।
চোখ যায় মাথায় গামছা বাঁধা তিন যুবকের দিকে। পরনে রঙিন লুঙ্গি ও ধবধবে সাদা গেঞ্জি। দুজনের গলায় ঝুলছে ঢোল ও টরবরি। একজনের হাতে কাঁশি। বাদ্যগুলোতে তাল তোলার চেষ্টা করছেন তারা।
লাঠিয়াল সরদার রবজেল ইসলাম। কুষ্টিয়ার মিরপুরের কবরবাড়িয়া গ্রামের লাঠিয়াল তিনি। কথায় কথায় জানালেন কী কী খেলা দেখানো হবে আজ।
তার ভাষায়, ‘একটা হলো নাটির আড়, একটা ছড়ির আড়, একটা জুড়া নাটি, নাটির ফাইটিং, নড়ির আড়, নাটি ঘুরানো, দুই নাটির বাটুল ঘুরানো, দড়ির বাটুল ঘুরানো, ছুড়ার খেলা, কুড়ুল খেলা, চরদখলের খেলা।’
কতজন শিষ্য আপনার?
‘শিষ্য নয়, আমার ছেইলে। নিজের হাতে তৈরি করা ৭০ জন।’
লাঠি তৈরি করেন কিভাবে?
‘নাটি অয় বাঁশের। নাটির যে জায়গাটা ব্যাঁকা, সেই জায়গাটা আগুনে ছ্যাঁক দিয়ে গরম করে চাপন দিতে অয়। এটা তো দশের খেলা। ১০ জনে দেখে। খেলতে আবার আমরা ১০ জন একত্র অই।’
ঢোলের ছন্দ চলে অবিরত। দর্শকদের বৃত্তাকার ভিড় জমে লাঠিখেলা ঘিরে। একেক দলের লাঠিখেলা একেক ধরনের। খেলার সঙ্গে ঢোলের তালও যায় পাল্টে।
লাঠিয়াল সরদার মুন্নাব আলী। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে। লাঠিখেলার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে।
কত দিন ধরে লাঠি খেলছেন? ভারী কণ্ঠে মুন্নাব বলেন, ‘আমার বয়স যখন পাঁচ, আর এখন বয়স ঊনসত্তর।’
লাঠিখেলা নিয়ে বলেন, ‘সুস্থ মস্তিষ্ক, তীক্ষ দৃষ্টি আর দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন লাঠিখেলার মূলমন্ত্র।’
লাঠিয়ালদের লাঠি অন্যায় কাজে যুক্ত থাকে কি?
তাঁর অকপট উত্তর, ‘ষোলো আনাই নিষেধ। প্রশিক্ষণ নেওয়ার শুরুতেই অগ্নিশপথ করেছি, আমাদের লাঠি কখনো কোনো সময় অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হবে না।’
লাঠিখেলা হারিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে এই লাঠি সরদার বলেন, ‘মানুষের মনের বিকাশ, বিদেশি আভিজাত্য ও অপসংস্কৃতিই এর মূল কারণ।’
ভালো লাগার অনুভূতিও প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘লাঠি খেলে আমরা কোটিপতি হতে চাই না। খেলা দেখে মানুষ আনন্দ পায়, ওস্তাদ বলে সম্মান করে—এতেই আমরা খুশি।’
কথা থামিয়ে মুন্নাব লাঠিয়াল মোটা একটি বাঁশের লাঠি নিয়ে মাঠে ঢোকেন। দুই হাতে তা নানা ঢঙে ঘোরান। অসাধারণ সেই লাঠিখেলার দৃশ্য। দর্শকরাও মুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করে।
এর পরই নামবেন আরেক লাঠিয়াল। গোঁফ তাঁর প্যাঁচানো। যেন কোনো গল্পের লাঠি সরদারের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। পরিচয় জানাতে বলেন, ‘আমি পদ্মার চরের অসমান সরদার।’
তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ার বারখাতা গ্রামে। বাবা ইব্রাহিম বিশ্বাস ও দাদা ইদু বিশ্বাসও ছিলেন নামকরা লাঠিয়াল সরদার। লাঠিখেলা তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।
কোন সময়টাতে লাঠিখেলা বেশি হয়?
তিনি বলেন, ‘ফসল ঘরে তোলার পর আর মহরমের সময়টাতে বেশি হয়। তখন তালে তালে চলে লাঠিখেলা। ফলে লাঠিয়াল ও দর্শকদের মনে আনন্দের দোলা লাগে।’
ডাক পড়তেই হুংকার দিয়ে মাঠে নামেন অসমান সরদার। তাঁকে আক্রমণ করেন ২০-২৫ জন লাঠিয়াল। শুরু হয় লাঠির লড়াই। খটখট শব্দে দর্শকদের মাঝেও নামে নীরবতা।
বাংলাদেশে লাঠিখেলার প্রচলন শুরু হয় ওস্তাদ সিরাজুল হক চৌধুরীর হাত ধরে। অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৩ সালে তিনি নিখিল বঙ্গ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। দেশভাগের পর একে পূর্ব পাকিস্তান লাঠিয়াল বাহিনী এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী নাম দেওয়া হয়। লাঠিয়ালদের সংগঠিত করা এবং ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ধরে রাখাই এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।
ইতিহাসের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে লাঠিয়ালদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও লাঠিখেলা রক্ষায় নেই কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। লাঠি সরদাররা চান ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি আগামী প্রজন্ম ধরে রাখুক।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠে, প্রকাশকাল: ২৭ নভেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.