মুক্তিযুদ্ধ

অপারেশন কিলো ফ্লাইট

ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ মিলিটারি অপারেশন। প্রথম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও কেউ ঘণ্টা ফ্লাই করে টার্গেট ডেসট্রয় করেনি।

আমি তখন কলকাতায় ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকার। আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একটি বিমানে ওঠেন। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন? বললেন না।

নামলাম একটি পরিত্যক্ত রানওয়েতে। চারপাশে জঙ্গল ও পাহাড়। ওখানে এয়ারফোর্সের আরও দুজন বৈমানিককে পাই। তারা হলেন, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম। আরও ছিলেন পিআইএরও বৈমানিক ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকি, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন সাহা, ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন সফরুদ্দিন।

জায়গাটার নাম ডিমাপুর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি ওটা। কিন্তু সেখানে কেন আসলাম? তখনও কিছুই জানি না। পরদিন সকালে খন্দকার সাহেব বললেন, আজকে একজন গুরুত্বপূর্ণ গেস্ট আসবেন। তখন সবকিছু জানতে পারবে।” সকাল ১০টার দিকে একটা ডাকোটায় আসলেন একজন। কে জানেন? এয়ার ভাইস মার্শাল পিসি লাল, চিফ অব এয়ার স্টাফ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স।

তাকে একটা ছোট্ট গার্ড অব অনার দিলাম আমরা। তিনি বললেন, “আমরা তিনটা এয়ার ক্রাফট জোগাড় করেছি। এ তিনটা আপনারা যেভাবে ব্যবহার করতে চান করতে পারবেন।” তারা দিয়েছিল একটা ডাকোটা ডিসি থ্রি পরিবহন বিমান, একটি অর্টার বিমান এবং আরেকটি অ্যালুয়েড হেলিকপ্টার। কিন্তু কোনোটিই যুদ্ধ বিমান ছিল না। সবগুলো ছিল সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট। যা দিয়ে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব।

আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্টারের। হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। আর ডাকোটা ডিসি থ্রি বিমানটি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন খালেদকে। সবাই অভিজ্ঞ পাইলট। তবুও তৃতীয়দিন থেকেই বিমানগুলো নিয়ে ফ্লাইং শুরু করি।

ছিলাম টিম লিডার ফর অর্টার। আমার নম্বর টু। সঙ্গে দুজন– ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ট্রেনিং। এরপর হয় নেভিগেশন। মানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। আমরা নয় ঘণ্টার নেভিগেশনও করেছি। জানতে চাইতাম এত লম্বা ফ্লাইং কেন করাচ্ছেন? ওরা শুধু বলত, “হাই কমান্ডের নির্দেশ”।

মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (বীর উত্তম), ছবি: সংগৃহীত

কিলো ফ্লাইট গ্রুপের ট্রেনিং প্রসঙ্গে এভাবেই বলছিলেন বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পাতিলাপাড়ায়। তিনি পাকিস্তান এয়ারফোর্সে জয়েন করেন ১৯৬৪ সালের জুন মাসে। একাত্তরে পালিয়ে এসে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

আলাপচারিতায় ফিরি একাত্তরে। প্রশ্ন রাখি ভারতীয় ওই বিমানগুলো দিয়ে কীভাবে অপারেশন করলেন? তিনি বলেন, “হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট দুটোকে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স বেইস জোড়হাটে। ওখানে ওগুলোকে পুরোপুরি যুদ্ধ বিমানের রূপ দেওয়া হয়েছিল।

অর্টারের দুইদিকে দুটি উইংয়ে রকেট লাগানো। ডান দিকে সাতটা, বাঁ দিকে সাতটা। ডানদিকের দরজাটা খোলা। সেখানে একটা টুইন ব্যারেল ব্রাউনিং গান ফিট করা। ভেতরে পেটটা কেটে সেখানে সেট করা তিনটা বোম র‍্যাক। একেকটা বোম র‍্যাকে ৪টা করে মোট বারোটা বোম লাগানো। ২৫ পাউন্ডের একেকটা বোম, যা বিশেষ ধরনের এবং মূলত আগুন জ্বালাতে সাহায্য করবে।”

এরপরই যুদ্ধের কায়দায় ট্রেনিং শুরু হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয় সব ট্রেনিং। কিন্তু টার্গেট কী? তারা তখনও জানেন না। হঠাৎ জোড়হাটে যাওয়ার একটা মেসেজ আসে। সেখানে গিয়েই কিলো ফ্লাইট অপারেশনের নির্দেশ পান সবাই। তার ভাষায়, “আমাকে বলল, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলম। তোমার টার্গেট হলো টু ডিসট্রয়েড চিটাগাং অয়েল রিফাইনারি। টার্গেট ডেট ২৮ নভেম্বর।”

তারা আরও জানাল, চিটাগং বিমানবন্দরের রানওয়ের ঠিক পাশেই ওটা। রানওয়েতে ওদের কাছে কোনো এ কে গান (যা দিয়ে এয়ারক্রাফটে ফায়ার করা হয়) নেই। ফলে খুব নির্ভয়েই অপারেশন করা যাবে।

সুলতান মাহমুদকে টার্গেট দিল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেন, ইউএসএসও’র তেলের ডিপো ধ্বংস করা। নির্দেশনা নিয়ে ডিমাপুরে ফিরে আসলাম। সাতদিন পর আবার ডাকল। এবার টার্গেট টাইম ঠিক করে দিল। সবার টার্গেট টাইমটা ছিল একই, রাত বারোটা এক মিনিটে। আমরা ছিলাম সুইসাইডাল গ্রুপ। ফিরে আসব কিনা জানি না। আমি ক্যাপ্টেন, কো পাইলট হলেন ক্যাপ্টেন আকরাম। বোম ফেলবেন সার্জেন্ট হক আর এয়ার গানার ছিলেন রুস্তম আলী। মোট চারজন। সঙ্গে নিলাম আরও দুজন টেকনিশিয়ানকে।

২৬ নভেম্বর ডিমাপুর ছেড়ে কৈলাশহর চলে যাই। মিলিটারি ভাষায় এটাকে বলে ফরোয়ার্ড এয়ার বেইস। সেখানে একটা তিনহাজার ফিট ছোট্ট রানওয়ে আছে। ওখানেই যাই অর্টারটা নিয়ে। পাশেই তেলিয়ামোড়া। ওখান থেকে হেলিকপ্টারে টেকওভার করবেন সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম।

২৮ নভেম্বর। আমরা প্রস্তুত। বিকেল ৪টা বা সাড়ের ৪টার দিকে একটা মোটর সাইকেলে আসেন ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের এক ফ্লাইং অফিসার। বললেন, “একটা মেসেজ আছে। এটা পড়ে ফেরত দিতে হবে।” খুলে দেখলাম লেখা– ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট ক্রু, ইউর কিলো ফ্লাইট মিশন ইজ সাসপেন্টেড টুডে। উই শ্যাল ইনফর্ম ইউ আওয়ার নেক্সট বুলেটিন।’

অপেক্ষায় থাকলাম। ৩ ডিসেম্বর বিকেল তখন ৫টা। মোটরসাইকেলে ওই অফিসার আবার আসলেন। এবার তার সিগন্যাল ম্যাসেজে লেখা এমন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, কনগ্রাচুলেশন। ইয়োর ওয়েটিং ডেজ আর ওভার। টু ডেইস ইজ দা ডে ফর ইয়োর ফাইনাল অ্যাটাক। অল আদারস ব্রিফিং উইল এজ বিফোর।’

সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের বললাম, এয়ারক্রাফট তৈরি করো। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চারজন ঢুকলাম প্লেনে। সবাই সবার সঙ্গে হাত মেলালাম। রাত পৌনে আটটার দিকে আমরা টেকঅফ করি।

কীভাবে অ্যাটক করেন? কোন বাধার মুখে কি পড়েছিলেন? শামসুল আলম আদ্যোপান্ত বলেন যান, “প্রথমে এক হাজার ফিট উঁচুতে ফ্লাই করি। এরপর ৫০০ ফিট, এভাবে ২০০ ফিটে নেমে আসি। আস্তে আস্তে উচ্চতা কমাচ্ছিলাম যাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার ধরতে না পারে। বে অব বেঙ্গল দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন চাঁদ উঠেছে। আমি বলব, শুক্লা সপ্তমীর চন্দ্র। নিচে চকচকা পানি দেখা যাচ্ছে। প্লেনটা তখন ৫০ ফিট নিচ দিয়ে চলছে।”

“তখন রাত ১২টা পার হয়ে যাচ্ছে। এয়ার ক্রাফটটা আস্তে আস্তে উঁচুতে ওঠালাম। নিচে দেখলাম চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়। পাশেই ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারি। সারি সারি আলো জ্বলছে সেখানে। প্লেনটাকে একটা চক্কর দিয়েই ফার্স্ট টার্গেটে দুটো রকেট ফায়ার করি। দুই জায়গাতে হিট করল। কিন্তু কোনো এক্সপ্লোশন হলো না। দ্বিতীয় আরেকটা হিট করলাম। কিন্তু এবারও এক্সপ্লোশন নেই। বেশ অবাক হলাম। তৃতীয় হিটটি করতে যাবো তখনই এয়ারপোর্ট থেকে এ কে গান দিয়ে পাকিস্তানিরা সমানে ফায়ার শুরু করে। বুঝে যাই ইনফরমেশন ভুল ছিল। ওদের কাছে এ কে গানও আছে।

তখনও আমি টার্গেটে অটল। দুটো রকেট হিট করে টার্ন করছি অমনি বিশাল শব্দে রিফাইনারির একটা ট্যাংক এক্সপ্লোশন হলো। আরও ৪ থেকে ৬টি রকেট ফায়ার করি। দেখলাম নিচে শুধু আগুন আর আগুন। আনন্দে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠি। অনেক দূর থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহানি শিখা।

প্রায় পৌনে ৯ ঘণ্টা ফ্লাইংয়ে ছিলাম আমরা। ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ মিলিটারি অপারেশন। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও কেউ ৯ ঘণ্টা ফ্লাই করে টার্গেট ডেসট্রয় করেনি। ওটা আমরাই রচনা করেছিলাম। যা ঘটেছিল কিলো ফ্লাইট অপারেশনে।

হিট করে ফিরে ল্যান্ড করি কুমরিগ্রামে। সাড়ে চারটা বাজে তখন। যখন নামি তখন দেখি গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের রিসিভ করার জন্য। মানুষটি ৬ ফিটের মতো লম্বা। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুলে বললেন, ‘বয় ওহ বয়, ইউ হ্যাভ ডান ইট’।

মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম এখন প্রয়াত। কিন্তু তার বলা সব কথাই ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিলো ফ্লাইট নামকরণের অন্তর্নিহিত কারণ তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন এভাবে, “অন্যান্য গ্রুপগুলো তার কমান্ডারের নামে হয়েছে। আমরাও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার সাহেবের নামেই এর নামকরণ করতে চেয়েছি। ‘কে’ দিয়ে যেহেতু খন্দকার হয় তখন এর নাম দেওয়া হলো কিলো ফ্লাইট। ‘কে’ ফর কিলো। আর ‘ফ্লাইট’ হচ্ছে বিমানের ভাষায় স্কোয়াড্রন থেকে ছোট একটা বহর।”

একাত্তরের এই এয়ার অ্যাটাকের খবরটি বিবিসিসহ বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হতে থাকে। কিলো ফ্লাইট অপারেশনের ফলেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তেল সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে তেল সরবরাহেরও সুযোগ ছিল না তাদের। পরে আরও বিশটির মতো বিমান অপারেশন হয়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়ে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button