ধানুয়া কামালপুরের বিজয়
“তোমাদের দেশ দ্রুতই স্বাধীন হবে। কারণ জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে।”
ক্যাম্পের ওপরে পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই আক্রমণ করত। একদিন ভোর ৫টার দিকে সব বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যালার্ট করে দিই। কারণ ওই সময়টাই ছিল আক্রমণের সময়। এরপর ৪ নম্বর বাঙ্কারে চলে আসি। ওটা ছিল কামালপুরের মুখোমুখি।
অপেক্ষা করছিলাম। বেশ ঘন কুয়াশা। দেখলাম পাকিস্তানি সেনারা অ্যাডভান্স হচ্ছে লেলিং পজিশনে। বাঙ্কারে হেলালুজ্জামানসহ ৪-৫ জন। পাকিস্তানিরা দশ বারোজন। রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ারিং শুরু করে দিই। ডানে ৫ নম্বর বাঙ্কারসহ অন্যান্য বাঙ্কারে ছিল এলএমজি। সবগুলো গর্জে ওঠে। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে।
মাঝেমধ্যে ভারতীয় সেনার পরিকল্পনায় সামনে গিয়েও আক্রমণ করেছি। পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আক্রমণ করলে পেছন দিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ওদের রিইনফোর্সমেন্ট আসত। তাই একদিন ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে গোপনে কামালপুরের পেছনের দিকে অ্যাম্বুশ করি। ভারতীয় সেনা প্রায়ই অপারেশনে নিয়ে যেত। এয়ারফোর্সে ছিলাম। উর্দু ও ইংরেজি বলতে পারতাম। আবার উর্দু-ইংরেজি মিশিয়ে যেটা ফৌজি ভাষা সেটাও বলতে পারতাম। এ কারণেই তারা আমাকে চাইত। মেজর সলো সিং ও ক্যাপ্টেন গোখলে আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
সাধারণত রাস্তার একপাশে অ্যাম্বুশ করতে হয়। কিন্তু ওইদিন আমরা করলাম দুপাশে। ভারতীয় সেনার প্রায় প্রত্যেকের কাছে বেলচা থাকত। তারা যেখানে যেত সেটা দিয়ে গর্ত করে পজিশন নিত। গর্তের ভেতর সাপ যেমন তেমনি গর্তের ভেতর যোদ্ধাও বিপজ্জনক। আমাদের একটি কোম্পানি কামালপুর আক্রমণ করে উত্তর দিক থেকে।
আমরা দক্ষিণ দিকে কামালপুর-বকশিগঞ্জ রোডে অ্যাম্বুশ করে অপেক্ষায় আছি। ওদের রিইনফোর্সমেন্ট আসবে বকশিগঞ্জ থেকে, এ পথ দিয়েই। ওরা রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার শুরু হয়। ওদের তখন পালানোরও পথ ছিল না। কারণ রাস্তার ডানেও আমরা, বামেও। অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা যায় ওইদিন।
আর একবার বর্ডার থেকে অনেক ভেতরের দিকে গেলাম, দিনের বেলায়। ভারতীয় এক মেজরও ছিলেন সঙ্গে। পাকিস্তানিরা কামালাপুর ক্যাম্প থেকে বের হতো না। কিন্তু অস্ত্র নিয়ে আমরা বেরোতাম। দেশ তো আমাদের, জনগণও। ওই মেজর পানি খেতে চাইলেন। এক বাড়িতে গেলাম। পানি চাইতেই ওরা সঙ্গে সঙ্গে খেতে দিল মুড়ির মোয়া।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি খুব আন্তরিক ছিল সবাই। সাধারণ মানুষের এমন মনোভাব দেখে ওই ভারতীয় মেজর বেশ অবাক হন। তারপর বলেন, “তোমাদের দেশ দ্রুতই স্বাধীন হবে। কারণ তোমাদের জনগণ তোমাদের সঙ্গে আছে।”
রণাঙ্গনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীরপ্রতীক জয়নাল আবেদীন। কাজী মোহাম্মদ আনিস ও আছিয়া খাতুনের ছোট সন্তান জয়নাল আবেদীন। বাড়ি নোয়াখালি জেলার সেনবাগ উপজেলার দেবীসেনপুর গ্রামে।
কামালপুর ক্যাম্প অপারেশনে বিজয় লাভ করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। ওইদিনের কথা তিনি বললেন যেভাবে, “ওটা ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি। নভেম্বরের শেষ দিকেই আমরা কামালপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্পটার পেছনের দিক ঘিরে রাখি। সেক্টর কমান্ডার তখন ক্যাপ্টেন আজিজ। কিন্তু অপারেশনটি আমরা করি ভারতীয় সেনাদের নির্দেশে। ওখানে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের সার্পোট আসতে পারে না। রেশন আসাও বন্ধ হয়ে যায়। গোলাবারুদ কমতে থাকে। তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আমরা তাদের ওপর গুলি করছি। কিন্তু ওরা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে না। ভারতীয় সেনারা শেলিংও করল। কিন্তু ওদের কোনো সাড়া নেই।”
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ওদের ক্যাম্পে একটা চিঠি পাঠানো হলো। লেখা ছিল এমন, ‘তোমাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালানোর পথ নাই। সারেন্ডার করো।’ মুক্তিযোদ্ধা বশিরকে দিয়ে ওই চিঠিটি পাঠান ব্রিগেডিয়ার ক্লিয়ার। কিন্তু বশির গিয়ে আর ফিরে আসে না। সবার মধ্যে তখন উত্তেজনা। মুক্তিযোদ্ধারা চাচ্ছে ভেতরে ঢুকতে। পরে আরও একটি চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় আনিসুল হক সজ্জুকে।
সন্ধ্যার দিকে সবাই বের হয়ে আসে। সঙ্গে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ও তার নেতৃত্বে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা। ওরা সারেন্ডার করে বান রোডের ওপরে, ভারতীয় সেনাদের কাছে।
বীরপ্রতীক জয়নাল আবেদীন এরপর এক কোম্পানি ফোর্স নিয়ে বাহাদুরবাদ ঘাট হয়ে দেওয়ানগঞ্জ এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখ জামালপুর মুক্ত করেন। সেখানে পিটিআই স্কুলে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ান এবং শত শত মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠ আকাশে তুলে গায়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’। পরে টাঙ্গাইল হয়ে তিনি চলে যান ময়মনসিংহে।
আগামী প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল আবেদীন বীরপ্রতীকের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “আমরা আগে বাঙালি পরে মুসলমান। এটা তোমরা অন্তরে ধারণ করো। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাঁচিয়ে রেখো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করো দেশটাকে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.