মুক্তিযুদ্ধ

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হিট অ্যান্ড রান

হঠাৎ সাইরেন বাজার শব্দ পাই। দেখি পুলিশের এসকর্ট গাড়ি ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে।

মে ১৯৭১। মাস তখনও শেষ হয়নি। আমরা মতিনগর ক্যাম্পে। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ স্যার ডেকে বললেন, “আলম, তোমাকে ঢাকায় যেতে হবে, একটা স্পেসিফিক কাজ নিয়ে। তুমিসহ ১৭ জনকে সিলেক্ট করে নাও।”

শুনে আমি তো এক্সাইটেড। বললাম, “স্যার কী কাজ?” বিস্তারিত কিছু বললেন না। এটুকু বললেন, “এটা একটি সিরিয়াস কাজ। কাজটা করেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে। হায়দার (ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার) তোমাকে ডিটেইল বলবে। তুমি বাদলকে (শহীদুল্লাহ খান বাদল) ১৭ জনের নাম দাও।”

চিন্তাভাবনা করে আমার দুই নম্বর ও মায়ার তিন নম্বর প্লাটুন থেকে বাছাই করে ১৭ জন ঠিক করলাম। আমিসহ ওই তালিকায় ছিল মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীন, মাহবুব আহমদ (শহীদ), শ্যামল, ভাষণ (অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে), আনোয়ার রহমান (আনু), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), ফতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাঈদ খান, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ, গাজী গোলাম দস্তগীর, তারেক এম আর চৌধুরী, নজিবুল হক, ধানমন্ডির রেজা, আড়াইহাজারের আব্দুস সামাদ, রূপগঞ্জের জব্বার ও ইফতেখার।

মূলত ঢাকার ভেতরে ওটাই ছিল সেক্টর টু-এর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম অপারেশন। বলা হলো, যারা অ্যাকশন করবে শুধু তারাই হিট করে দ্রুত হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসবে। বাকিরা ঢাকাতেই থেকে যাবে।

কোথায় অপারেশন করতে হবে, সেটা কি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল? হ্যাঁ। অপারেশনের নাম ছিল, ‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হিট অ্যান্ড রান।’ খবর ছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম ও ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান এসে সেখানে উঠবেন। পাকিস্তান সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে এবং তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। টার্গেট ছিল ওই ধারণাটাই পাল্টে দেওয়ার। পাশাপাশি জানানো যে, ঢাকা শান্ত নয় এবং পাকিস্তানি সেনাদেরও নিয়ন্ত্রণে নেই।

ঢাকায় এসে কয়েকটা জায়গায় ভাগ হয়ে থাকি। উঠলাম ইস্কাটনের দিলু রোড, সেগুনবাগিচায় বারীন মজুমদারের মিউজিক কলেজ ও ৩০ নম্বর হাটখোলায়। কিন্তু অপারেশন করতে এমন কাউকে লাগবে যে ভালো গাড়ি চালাতে পারে। তখন ভাষণ বলল তার এক মামা আছেন, নাম মুনির আলম মির্জা (বাদল), ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি কাজ করতেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে।

এছাড়া মতিনগর থেকে শহীদুল্লাহ খান বাদল বলে দিয়েছিল ঢাকার ছেলে কামরুল হক স্বপনের কথা। অপারেশনে দরকার হলে যেন তাকে নিই। ফাইনালি বাইরে থেকে এ দুজনকেই সঙ্গে নিলাম। প্রথমে ভাষণও সঙ্গে ছিল। পরে তাকেও বাদ দেওয়া হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুল আলম (বীরপ্রতীক),  ছবি: সালেক খোকন

৯ জুন, ১৯৭১। সিদ্ধেশ্বরীতে বাদল ভাইয়ের বাড়ি থেকে শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে যাব। রওনা দেই মাগরিবের ঠিক আগে। হোটেলের সামনে এখন যে ভাস্কর্যটা আছে সেখানে ছিল একটা বড় গাছ। প্রেসিডেন্ট ভবন (বর্তমান সুগন্ধা) পেছনে ফেলে ওই গাছটির সামনে আসি। কপালটা নেহায়েত ভালো ছিল। আমরা কিন্তু জানি না তারা কখন আসবে। তারা ভেতরে নাকি বাইরে তাও জানা নেই।

হঠাৎ সাইরেন বাজার শব্দ পাই। দেখি পুলিশের এসকর্ট গাড়ি ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে। পেছনে পুলিশের আরও দুই-তিনটি গাড়ি। শেষে একটি বা দুটো সাদা শেভ্রোলেট গাড়ি নজরে এলো। বুঝে যাই ওই গাড়িতেই রয়েছে বিশ্বব্যাংকের অতিথিরা। গাড়িগুলো আমাদের পাশ দিয়েই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢোকে।

আমরা বাইরে। মেইন রোডে হোটেলের ছোট গেটে এসে আমাদের গাড়ি থামে। দেখি দেওয়ালের ওপরে অনেক মানুষের ভিড়। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিচ্ছে তারা। কিন্তু কেউই আমাদের দিকে খেয়াল করল না।

বাদল ভাইকে বললাম আপনি গাড়ি স্টার্ট করেই রাখেন। স্বপন বের হলো, আমি বাঁ পাশ ও মায়া ডান পাশ থেকে বের হলাম। জিয়াও বের হয়ে আসে। জিয়া, মায়া ও আমার কাছে গ্রেনেড। পিস্তল ছিল স্বপনের কাছে। আমি গ্রেনেডের পিন খুলতেই দেখি জিয়া তার হাতের একটি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছে। সাদা শেভ্রোলেট গাড়িটি উল্টে গেল। আমি দ্বিতীয় গ্রেনেড আর মায়া ছুড়ল তৃতীয় গ্রেনেডটি। এর মধ্যে জিয়া তার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি সদরুদ্দিনের গাড়ির ওপরে ছুড়ে দেয়।

গ্রেনেডটি গাড়ির পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিস্ফোরিত হয়। দেখলাম গাড়ির পেছন দিকটা একটু ওপরে উঠেই আবার নিচে পড়ে গেল। মায়া আরেকটি গ্রেনেড ছোড়ে, কিন্তু সেটা হোটেলের প্রবেশ পথে গিয়ে পড়ে।

এরপর কি ঘটল– যদি জানতে চান, কিছুই বলতে পারব না। ভেতরে ছিল ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ ও আর্মি। এটুকু শুধু বলতে পারব বিপদের মধ্যে ছিলাম তখন। কারণ ফায়ারিং শুরু হবে।

এর আগেই দ্রুত গাড়িতে এসে সাকুরা মার্কেটের সামনে থেকে ঘুরে আবার ফেরত আসি। তখন দেখি দেওয়ালের ওপর থাকা পাবলিক একজনও নেই। টেনিস ক্লাব পর্যন্ত রাস্তায় অসংখ্য স্যান্ডেল, লুঙ্গি, টুপি পড়ে আছে।

আমরা দ্রুত কাকরাইল মসজিদ থেকে ডানদিক দিয়ে চলে যাই মর্নিং নিউজের অফিসে। সেখানেও একটি গ্রেনেড লপ করলাম। কারণ ওরা পাকিস্তানের পক্ষে উল্টাপাল্টা নিউজ ছাপাচ্ছিল। তারপর শেষ টার্গেট ছিল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের বাড়ি। রমনা থানার দিকে ছিল বাড়িটি। সেখানেও একটি গ্রেনেড ছুড়েই আত্মগোপনে চলে যাই। পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটেছে অপারেশনের ঘটনাগুলো।

বিবিসি ওইদিন রাত আটটার নিউজেই খবরটি প্রচার করে। এবিসি, অলইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকাও খবরটি সম্প্রচার করে। ওই অপারেশনের কারণেই প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান ও তার টিম ভয়ে দ্রুত করাচি ফিরে যায়। ফলে ঢাকার ভেতরে প্রথম ওই অপারেশনটিতে পুরোপুরি সফল হয়েছিলাম।

একাত্তরের একটি সফল অপারেশনের কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম (বীরপ্রতীক)। একাত্তরে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে, স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পরে প্রশিক্ষণ নেন ভারতের মতিনগর ক্যাম্পে, দুই নম্বর প্লাটুনে।

দেশ নিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন, “প্রথমত কাজে স্বচ্ছতা আনতে হবে। দ্বিতীয়ত চুরি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বুরোক্রেসিকে অনেক বড় বানানোও সঠিক হবে না।”

প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা তার। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “এখন তো দেশের ভেতরেই শুধু কম্পিটিশন না, বাইরের সঙ্গেও কম্পিটিশন। তাই পড়তে হবে, জানতে হবে। জানাটা বইয়ের ভেতরেই থাকে। আল্লাহ সবকিছুর বিকল্প দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিসেরই বিকল্প নেই। সেটা হচ্ছে ইলম বা পড়ালেখা। তাই তোমাদের প্রথম দায়িত্ব লেখাপড়া করা, দ্বিতীয় দায়িত্ব লেখাপড়া করা, তৃতীয় দায়িত্বও লেখাপড়া করা।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২ ডিসেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button