আলমডাঙ্গার রক্তাক্ত অপারেশন
পুরনো একটি কবরে সারা রাত নিজেকে লুকিয়ে রাখেন দুলাল। মৃত মানুষই নয়, একাত্তরে জীবিত মানুষেরও ঠাঁই হয়েছিল কবরে!
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল। বাড়ি বরিশালের হিজলার হরিনাথপুরে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে তার বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন আলমডাঙ্গা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
৩০ মার্চ, ১৯৭১। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা দখলে নেয় কুষ্টিয়া। এপ্রিলের ৭ তারিখে তারা পজিশন নেয় আলমডাঙ্গা থানায়। ওই দিনই আবুল হোসেনসহ ৮-১০ জনকে ওরা ধরে নিয়ে যায় হাটবলিয়া ফেরিঘাটের সামনে। গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। আলমডাঙ্গায় ওটাই প্রথম গণহত্যা।
এরপরই দুলালরা প্রশিক্ষণে চলে যান। তাদের প্রশিক্ষণ হয় বিহারের চাকুলিয়ায়। প্রশিক্ষণ শেষে আট নম্বর সেক্টরের আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন তিনি।
আলমডাঙ্গা অপারেশনের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন আদ্যোপান্ত, রোজার মাস তখন। আমরা বৃহত্তর কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা, মেহেরপুর এলাকায়। আলমডাঙ্গায় ছিল পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী। তারা সবাই পাঞ্জাবি। ছিল কালো পোশাক পরা রাজাকাররাও। বিহারির সংখ্যাও ছিল অনেক।
পাকিস্তানি সেনারা আসত মাঝেমধ্যে। ঈদের দিনে আমরা আলমডাঙ্গা শহর অ্যাটাক করার পরিকল্পনা করি। তখন ঈদগাহে সবাইকে এক জায়গায় পাওয়া যাবে। আমাদের চারটা গ্রুপের সঙ্গে মরফত, কামাল ও আবদার ভাইয়ের দলসহ কয়েকটা গ্রুপ যোগ দেয়।
১১ নভেম্বর, ১৯৭১। সন্ধ্যাবেলা। কুমার নদের ওপারে কুঠিবাড়ির কাছে পাওয়ার স্টেশনটি আমরা উড়িয়ে দিই। চুয়াডাঙ্গার দক্ষিণে যেন সেনা আসতে না পারে সেজন্য সেখানকার রেললাইন ধ্বংস করা হয়। পরিকল্পনা করে কুষ্টিয়া থেকে আলমডাঙ্গাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমরা পজিশনে থাকি আলমডাঙ্গার চারদিকে।
শহরের ভেতরটা রেকি করতে হবে। ১২ নভেম্বর ভোরে চারজনকে নিয়ে নান্নু ভাই শহরে ঢুকলেন। আমরা তার অপেক্ষায় থাকি। সময় সকাল ৯টা। হঠাৎ গুলির শব্দ। ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। নান্নু ভাইকে উদ্ধার করতে হবে। আমরা কুমার নদ দিয়ে আলমডাঙ্গা শহরে ঢুকি। চারদিক থেকে অন্যরাও এগোতে থাকে। সোনালী ব্যাংকের পাশ থেকে চাঁদতারার (একটি জায়গার নাম) দিকে ফায়ার করি আমরা। ওখানে রাজাকাররা ছিল।
খানিক এগোতেই নান্নু ভাইকে পাওয়া গেল। তার গ্রুপটি আগেই এক রাজাকারকে গুলি করে মেরেছে। চারদিকের আক্রমণে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা আশ্রয় নেয় আলমডাঙ্গা থানায়। সেখানকার বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে তারা বার্স্ট ফায়ার চালাতে থাকে।
হান্নান ভাইসহ আমরা তিনজন ছিলাম অ্যাডভান্স পার্টিতে। একটা বাড়িতে পজিশন নিয়ে থানার দিকে ফায়ার করছি। তখন মধ্য দুপুর। নান্নু ভাই গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু একটি গুলি এসে লাগে তার মাথায়। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়েই তার শরীরটা নিথর হয়ে যায়। একইভাবে গুলিতে মারা যায় বজলু ডাক্তারও।
হাসু ভাই ঢুকছিলেন ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে। ওখানে মিলিশিয়ারা মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ধরে ছিল। মুক্তিযোদ্ধা ভেবে তিনি কাছে যেতেই বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে ওরা। আনসার ভাই গুলি খান চাঁদতারার ওখানে। ওটা ছিল একটা আরবান ফাইট।
প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। আমাদের দৃষ্টি থানার দিকে। ডানে পোস্ট অফিসের কাছে যে একটা বাঙ্কার আছে সেটা বুঝতে পারিনি। ওরা ওৎ পেতে ছিল। আমাকে টার্গেট করে ওরা গুলি ছোড়ে। আমিও পালটা জবাব দেব। হঠাৎ মনে হলো ধাক্কা খেলাম। হাত থেকে এসএলআরটা পড়ে গেল। গুলি আমার মুখে লাগার কথা। কিন্তু তখন ম্যাগজিনটা কাট করছিলাম।
এসএলআরটা মাঝখানে থাকায় গুলিটা প্রথম লাগে এসএলআরের বডিতে। স্প্লিন্টার ঢুকে যায় ডানহাতের কবজিতে। ফলে হাড় ভেঙে মাংস বেরিয়ে যায়। চামড়া ঝলসে গিয়ে রগগুলো গাছের শেকড়ের মতো ঝুলতে থাকে। রক্তে ভিজে যায় গোটা হাত।
তখনো জ্ঞান ছিল মুক্তিযোদ্ধা দুলালের। জীবন বাঁচানোর প্রাণান্ত সংগ্রাম তখনো শেষ হয়ে যায়নি। নিজেকে বাঁচানোর সে কাহিনি বড় করুণ, বড় কষ্টের। সেসময়ই চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকিস্তানি সেনারা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে ছুড়তে আলমডাঙ্গার দিকে আসে। গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত দুলাল আশ্রয় নেন আলমডাঙ্গার এক কবরস্থানে। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে পুরনো একটি কবরে সারা রাত লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। মৃত মানুষই নয়, একাত্তরে জীবিত মানুষেরও ঠাঁই হয়েছিল কবরে!
স্মৃতির সেই কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি আসে দুলালের। বলেন, হাতের ব্যথায় আমি গোঙাচ্ছিলাম। নওশের আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যায় এরশাদপুর গ্রামে। সেখানেও ডাক্তার নেই। আমার হাত গামছা দিয়ে বাঁধা। সহযোদ্ধারা মসজিদের খাটিয়ায় তুলে নেয় আমাকে। সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে খাটিয়াটি, যেন লাশ আমি। বেলগাছির ওহাব মেম্বারের বাড়িতে মেলে গ্রাম্য চিকিৎসা। তাতেও কাজ হয় না।
পরে গরুর গাড়িতে করে নেওয়া হয় পাচুরিয়া গ্রামের বিলে। আমার হাত তখন পচতে শুরু করেছে। গন্ধে কেউ কাছে আসে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন লালচান আর শহীদুল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পালকিতে করে আমাকে সীমান্ত পার করেন। চিকিৎসা হয় করিমপুর ফিল্ড হাসপাতালে। আমার হাতে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসা হলেও এখনো ডান হাতের আঙুলগুলো পুরোপুরি সোজা করতে পারি না। তিনটি আঙুল অবশ। চামড়ায় ব্যথা হয় মাঝেমধ্যেই। কষ্ট হয় অনেক।
হাতের দিকে চোখ পড়লে এখনো একাত্তর মনে পড়ে যায়। ওইদিন দুলালরা আলমডাঙ্গা দখলে নিলেও ধরে রাখতে পারেননি। তবে ওই অপারেশন আলমডাঙ্গায় পাকিস্তানিদের শক্ত ভিতকে দুর্বল করে দেয়। মিলিশিয়া ও অনেক রাজাকার মারা যায়। পরে ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা থেকে আলমডাঙ্গার দিকে পাকিস্তানি সেনাবহর অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পরে ৮ ডিসেম্বর সকালে আলমডাঙ্গা পুরোপুরি হানাদারমুক্ত হয়।
আলমডাঙ্গায় রক্তাক্ত হওয়া মুক্তিযোদ্ধা দুলালের কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন ছিল যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সে দেশ কী পেয়েছেন? তিনি বলেন, স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। কিন্তু চেয়েছিলাম একটা সমাজব্যবস্থা, যেখানে শোষিত-শাসক থাকবে না। সবাই মৌলিক অধিকার পাবে। দেশ অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্যটাও অনেক বেড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ জিজ্ঞেস করেনি, আমার পাশে কে হিন্দু, কে মুসলমান। ধর্মটা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতিতেও। স্বাধীন দেশে মানুষ দেখি না ভাই। দেখি কিছু হিন্দু আর মুসলমান। মানুষ কই?
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.