তেলিয়াপাড়া চা বাগান ও শাহবাজপুর অপারেশন

“সৎ লোকের মূল্যায়ন হয় না এদেশে। নীতিভ্রষ্ট লোকই স্বাধীন দেশ বেশি পেয়েছে। রাজনীতিবিদদের সৎ থাকা জরুরি ছিল।”
বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত নায়েক সুবেদার হায়দার আলী। তার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার শ্রীপুর মাইজহাটিতে। লেখাপড়া করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। প্রথমে চুরখাই প্রাইমারি স্কুলে এবং পরে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন চুরখাই হাইস্কুলে।
তারপরই তিনি সিপাহি হিসেবে ইপিআর-এ যোগ দেন ১৯৬৪ সালে। প্রশিক্ষণ শেষে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিলেটের তেলিয়াপাড়া সীমান্তে। সীমান্ত এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ আর চোরাচালান রোধ করা ছিল মূল কাজ। পাকিস্তানি অফিসাররা থাকত কমান্ডে।
ওই সময়ের কথা তিনি বললেন যেভাবে, বাঙালি সিপাহিদেরকে পাঠান, পাঞ্জাবি, বেলুচরা নানারকম কটূক্তি করত। হায়দারদের সংঘবদ্ধ হতে দিত না তারা। ছোট ছোট গ্রুপগুলোতে পাঁচজনই থাকত পাঠান বা পাঞ্জাবি আর দুইজন ছিল বাঙালি। এভাবেই ওরা দায়িত্ব ভাগ করে দিত।
একাত্তরের ২৫ মার্চে আমরা ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা বিওপিতে। হাতিয়ার নিয়ে আগেই প্রস্তুত ছিলাম। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল একজন পাঠান ও একজন হাবিলদার। এরশাদ, খোরশেদ, বারী ও সুলতান আহমেদসহ আমরা ২৪ জন বাঙালি সিপাহি বের হয়ে আসি। কসবা থেকে শালবন হয়ে চলে যাই ভারতে, বিএসএফ ক্যাম্পে।
তারা আমাদের উন্নত অস্ত্র দেয়। ওখান থেকে পাই এসএমজি, এলএমজি, স্টেনগান ও রকেট লঞ্চার। তারপরই ১০ জন করে গ্রুপ করি। আমার গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন আবদুল রহিম। আমরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর ঢুকে অপারেশন করতাম। পাকিস্তানিরা তখন শেল মারত। এক ফুট ওপরে উঠে শেলগুলো মারাত্মক বার্স্ট হয়। জীবন বাঁচাতে তখন সরে আসি ভারতের ভেতর। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের কোম্পানি করে দেওয়া হয়।
৩ নম্বর সেক্টর ছিল ওটা। মেজর কে এম শফিউল্লাহ সাহেব ছিলেন কমান্ডে। ছোট ছোট দল করে একেক দিকে অপারেশন করি। কসবা ভুরুঙ্গামারী ক্যাম্পে ছিলাম আমরা। অপারেশন চলত মুখোমুখি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নায়েক সুবেদার হই, তখন নম্বর ছিল-২৬৫১। সম্মুখযুদ্ধ করেছি আখাউড়া, শাহবাজপুর ব্রিজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তেলিয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।
একটি অপারেশনের কথা শুনি এই বীরবিক্রমের মুখে। তার ভাষায়, ১৪ অগাস্ট ১৯৭১। শেষ রাতের ঘটনা। তেলিয়াপাড়ার চা বাগানে অন্ধকারে খালি চোখে দূরের কিছু দেখা যায় না। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চা বাগানের ভেতর আমাদের ক্যাম্প। সবাই পরিশ্রান্ত, ক্যাম্পে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকজন সহযোদ্ধা পাহারা দিচ্ছেন।
এমন সময় গোলাগুলির শব্দ। পাকিস্তানি সেনারা আকস্মিক আক্রমণ করে। সবাই হতচকিত। যে যেভাবে পারে দ্রুত অবস্থান নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। কিন্তু পাকিস্তানিরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। তখন আমরা পেছনে সরে যাই। কিন্তু তার আগেই আমাদের ১৪ জন সহযোদ্ধা শহীদ হন।
নিরাপদ অবস্থানে সরে যাওয়ার পরে সেখানে আসেন আমাদের অধিনায়ক শফিউল্লাহ সাহেব। তিনি নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আমাদের ১৪ জনকে মেরেছে, আমি ওদের চারগুণ মৃত্যু দেখতে চাই’। অধিনায়কের কথা শুনে আমরাও উদ্দীপ্ত হই। আরও শক্তি সঞ্চয় করে পরদিন ভোরেই পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাই। চা বাগানের বিভিন্ন জায়গায় ওরা ছিল তিন ব্যাটেলিয়ন। আমরা ছিলাম দুই ব্যাটেলিয়ন। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আমি চালাতাম এলএমজি। সঙ্গে ছিলেন হাবিলদার কুদরত আলী, নায়েক বরকত আলী ও নায়েক সুবেদার ফরিদ উদ্দিন প্রমুখ।
একটি টিলার ওপর পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগান পোস্ট। তারা সেখান থেকে গুলি করছে। ফলে আমরা এগোতে পারি না। তখন পাহাড়ি নালার মধ্য দিয়ে ক্রল করে একাই ওদিকে এগোই। সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মেশিনগান পোস্টে দুটি গ্রেনেড চার্জ করি। ফলে সেখান থেকে গুলি বন্ধ হয়ে যায়। চার পাকিস্তানি সেনা সেখানেই আহত অবস্থায় পড়েছিল। পরে এসএমজির গুলিতে তাদের শেষ করে দিই। এর ফলে আমরা খুব সহজে ক্যাম্পটিকে পুনর্দখল করি।

আরেকটি অপারেশনের কথা তিনি বললেন এভাবে, আমি ছিলাম ডিফেন্স গ্রুপে, দুই নম্বর প্ল্যাটুনে। কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন। তার কমান্ডে অগ্রসর হই। তখন আমাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনা ছিল ২০ জন। আমরা ছিলাম ২০ জন। অপারেশনে ৪০ জনই একসঙ্গে বের হতাম।
তেলিয়াপাড়ায় ঢুকছি। সবার ফ্রন্টে আমি। দেখি দূরে ওত পেতে আছে পাঞ্জাবিরা। ওদের দেখে ফেলি। তখনই ছোট্ট একটা পুকুরের পাশ থেকে এলএমজি ফায়ার করে ওদের তিনটা এলএমজি উড়িয়ে দিই। আমাদের সবাই তখন বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। সংকেত না দিলে হয়তো কেউ বাঁচত না। এমন সাহসিকতার জন্য ভারতীয় সেনার লোকজন আমাকে জড়িয়ে ধরে, পুরস্কার হিসেবে একদিন ছুটিও পাই। খুব আনন্দ লেগেছে ওইদিন।
অগাস্ট মাসের আরেকটি ঘটনা। শাহবাজপুর ব্রিজে পাকিস্তানিরা দক্ষিণ প্রান্তে, আমরা ছিলাম পশ্চিম প্রান্তে। ওরা ব্রিজের ওপর দিয়ে এপারে আসতে চায়। আমরা তখন অ্যান্টি ট্যাংক মাইন দিয়ে ব্রিজটা উড়িয়ে দিই। ফলে ওরা আসতে পারে না এবং অনেক হতাহতও হয়। সহযোদ্ধাসহ সবার গলায় একটা টোকেন ঝোলানো থাকত। হিন্দু হলে লেখা থাকত ‘এইচ’ আর মুসলমান হলে ‘এম’। আর ছিল বডি নম্বর। ওগুলো দিয়েই নিহত সহযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতাম আমরা।
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মন খারাপের অনুভূতি প্রকাশ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী। বলেন, “সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিক, কিন্তু মানুষ তো স্বাধীন হয় নাই। মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, হামলা, লুটতরাজ চলছেই। এসব তো আমরা চাইনি। সৎ লোকের মূল্যায়ন হয় না এদেশে। নীতিভ্রষ্ট লোকই স্বাধীন দেশ বেশি পেয়েছে। রাজনীতিবিদদের সৎ থাকা জরুরি ছিল।”
কী করলে দেশটা আরও এগোবে? তিনি বলেন এভাবে, “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠান করতে হবে। সৎভাবে কাজ করলে দেশ উন্নত হবে। এ যুগে অসৎ লোক সমাজে সম্মানিত হচ্ছে। ফলে কেউ তো সৎ থাকতে চাইবে না। এর ফলে অবৈধ কাজকর্ম বাড়ছে। টাকাপয়সা ছাড়া তো চাকরিও হয় না। এগুলো বন্ধ করতে হবে।”
দেশের উন্নয়ন ও সৎ মানুষ দেখলে ভালো লাগে এবং তৃপ্ত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী বীরবিক্রম। দেশটা আরও এগিয়ে যাবে এবং সঠিক পথেই থাকবে বলে মনে করেন তিনি। কেননা লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন এই দেশ।
এই বীরবিক্রমের সব আশা আগামী প্রজন্মকে ঘিরে। তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন শেষ কথাগুলো, “তোমরা কথা ও কাজে সৎ থেকো, দেশের উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখো, আর ক্ষমতাশালী হলে দেশের দু-চারটা গরিব মানুষকে সাহায্য করো। দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.