মুক্তিযুদ্ধ

বাহাদুরাবাদ ঘাট ও রাধানগর অ্যাটাক

মেজর জিয়াউর রহমান ওই ব্রিগেডের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। শেষে ব্রিগেডের নাম দেওয়া হয়জেড ফোর্স

লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসআইএম নূরুন্নবী খান (বীরবিক্রম)। বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীধরপাড়া গ্রামে। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে, কোয়েটা স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসে।

পরে তিনি পালিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রুপস নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তারপর সীমান্ত পার হয়ে চলে যান কলকাতায়। আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে নূরুন্নবী চলে যান রণাঙ্গনে। যুদ্ধ করেন থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে।

মেজর শাফায়াত জামিল ছিলেন থার্ড বেঙ্গলের সিও (কমান্ডিং অফিসার)। জুন মাসের ১৫ তারিখে নির্দেশ আসে গারো পাহাড়ের তেলঢালায় চলে যাওয়ার। ফার্স্ট বেঙ্গল বনগাঁ থেকে আসে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে, এইটথ বেঙ্গল চট্টগ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে আর থার্ড বেঙ্গল আসে হিলি থেকে নূরুন্নবী খানের নেতৃত্বে। তিন বেঙ্গল মিলে একটি ব্রিগেড গঠন করা হয়।

জুলাই মাসের ৭ তারিখে মেজর জিয়াউর রহমান ওই ব্রিগেডের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। ব্রিগেডের নাম প্রথমে ছিল ‘ওয়ান ইবি (ইস্ট বেঙ্গল) ব্রিগেড’। তারপর নাম হয় ‘ওয়ান আর্টি (আর্টিলারি) ব্রিগেড’। শেষে নাম দেওয়া হয় ‘জেড ফোর্স’।

তিন বেঙ্গলের কয়েকদিন প্রশিক্ষণ চলে তেলঢালায়। তারপর অ্যাসিড টেস্ট হিসেবে তিন ব্যাটালিয়নকে তিনটি অপারেশনে পাঠানো হয়। ফার্স্ট বেঙ্গল কামালপুর বিওপি, থার্ড বেঙ্গল বাহাদুরাবাদ ঘাট আর এইটথ বেঙ্গল নকশি বিওপি অপারেশনের দায়িত্ব পায়। কামালপুর বিওপিতে ফার্স্ট বেঙ্গল ব্যর্থ হয়। সেখানে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীরউত্তমসহ শহীদ হন ৬৫ জন। নকশিতেও মারা পড়েন ৩৬ জন যোদ্ধা। একমাত্র বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে সফল হন নূরুন্নবীরা।

কীভাবে তা সম্ভব হলো? তিনি বললেন যেভাবে, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থলে বাহাদুরাবাদ ঘাট একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, দিনাজপুর ও রংপুর ফ্রন্টে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানি ও সামরিক যানবাহন রেলওয়ের মালবাহী ও যাত্রীবাহী ওয়াগনে করে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে যেত। তাই উত্তরবঙ্গে শত্রুকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট অচল করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল।

ঘাটটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সেনা, এক কোম্পানি প্যারামিলিটারি রেঞ্জার এবং ৫০ জন স্থানীয় বিহারি ও রাজাকার। পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাটে। ঘাটের ফেরিতে করে ট্রেনের ওয়াগন পারাপার হতো।

আগেই রেকি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় একটি গ্রুপ আমাদের সাহায্য করে। বড় ১৬টা পাটের নৌকায় ব্রহ্মপুত্র দিয়ে এগোই আমরা। ৩১ জুলাই, ১৯৭১। ভোর ৪টার মতো। মুক্তিযোদ্ধারা টর্চ মেরে সিগন্যাল দিতেই নৌকা ভেড়াই। ঘাটের পাশেই একটা মাদ্রাসা। নদীর মোহনায় প্রটেকশনে থাকে আলফা কোম্পানি। দায়িত্বে ক্যাপ্টেন আনোয়ার। পাকিস্তানি সেনারা গানবোট নিয়ে আক্রমণ করতে এলে ওরা তা প্রতিহত করবে। আমার ডি কোম্পানি সামনে এগিয়ে আক্রমণ চালাবে।

ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার কোম্পানি নিয়ে মাদ্রাসা ঘরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নিয়েছেন মেজর শাফায়াত জামিল স্যার। উনি আমার প্রটেকশনে থাকবেন। মর্টার বা কাভারিং ফায়ার দেবেন। লাগলে সেনাও পাঠাবেন। আমি অপারেশনে হিট করব। এটাই ছিল পরিকল্পনা।

ক্তিযোদ্ধা এসআইএম নূরুন্নবী খান (বীরবিক্রম), ছবি: সালেক খোকন

দিনের বেলায় পাকিস্তানি সেনাদের বড়খানা চলে দেওয়ানগঞ্জ সুগার মিলে। ফলে তারা ট্রেনের ওয়াগনে রেস্ট নিচ্ছিল। আমরা রকেট লঞ্চার দিয়ে ওয়াগনগুলো উড়িয়ে দিলাম। ওরা টিকতে পারে না। গানবোট ছিল। ভয়ে একদল সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। বহু সেনা পালিয়েছে নদীর পাড় দিয়ে। ফাইট করার কোনো সুযোগ আমরা ওদের দিইনি। ভোর ৪টা থেকে ৬টার মধ্যেই সব ক্লিয়ার করে ফেলি। ওই অপারেশনে সফল হলেও সুবেদার ভুলু মিয়া নামে এক প্লাটুন কমান্ডারকে আমরা হারাই ওইদিন।

নূরুন্নবীর মুখেই শুনি সিলেটের রাধানগর অপারেশনের কথা। তার ভাষায়, ২৮ অক্টোবর অর্ডার আসে তামাবিল যাওয়ার। আমি তখন চারটা কোম্পানির দায়িত্বে আলফা, ডেলটা, ইকো আর ‘ই’ কোম্পানি। রাধানগর এলাকায় পাকিস্তানিদের একটা বড় ডিফেন্স ছিল। ওটা দখল করতে হবে। আমাকে দিল জাফলং চা বাগানের পশ্চিম পাশের এলাকায়। ডিফেন্সটার প্রায় সবদিকে আমরা পজিশনে। শুধু দক্ষিণের গোয়াইনঘাটের দিকটা খোলা রাখা ছিল। যুদ্ধ চলে রাতদিন, ২৮ অক্টোবর থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত। কোনোদিন চারবারও অ্যাটাক হয়। ঈদের দিনেও ওরা অ্যাটাক করে।

২১ নভেম্বর, ১৯৭১। ভারতের সঙ্গে যৌথ বাহিনী গঠিত হয়। ওরা সাপোর্টিং ফোর্স। মেইন ফোর্সে আমরা, সামনে থাকব। কর্নেল রাজ সিং আসলেন। ২৬ নভেম্বর আসে ফাইভ ফাইভ গুরখা রেজিমেন্টও। ওরা অ্যাটাক করবে রাধানগরের ওপর। আমাদের দিতে হবে গ্রাউন্ড সাপোর্ট।

রাধানগর-গোয়াইনঘাট রাস্তায় পাকিস্তানিদের এলএমজি আর মেশিনগান পজিশনে ছিল। আক্রমণের সময় ওরা বলত ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’। আমরা বলতাম ‘জয় বাংলা’। আর ‘আয়ো গুরখালি’ বলে গুরখা রেজিমেন্টের সেনারা সামনে এগোত। ওরা সামনে যেতেই পাকিস্তানি সেনাদের এলএমজি আর মেশিনগানের গুলির মুখে পড়ে। ফলে চারজন অফিসারসহ প্রায় ৭৫ জন গুরখা সৈন্য মারা যায়।

পরদিন ২৭ নভেম্বর। রাজ সিং ২৮ তারিখ ভোররাতে আবার অ্যাটাকে যেতে বললেন। সিদ্ধান্ত নিই সারপ্রাইজ অ্যাটাক করব। আমার দুটো কোম্পানিতে ১৬০ জন। চারটা প্লাটুন নিয়ে যাব ফ্রন্টাল অ্যাটাকে। ছোটখেল গ্রামের এক সাইড দিয়ে এগোব। প্রত্যেককে দিলাম থার্টি সিক্স হ্যান্ডগ্রেনেড। অ্যাটাকটা হবে সুইসাইডাল। শহীদ হওয়ার জন্য সবাইকে শপথও করালাম। কোন প্লাটুন কোথায়, কীভাবে অ্যাটাক করবে সব বুঝিয়ে দিই। দৌড়ে ওদের বাংকারগুলোতে উঠে যাব। ওদের পজিশনের সামান্য আগেই গ্রেনেড থ্রো করব। একসঙ্গে বিস্ফোরিত হবে ১৪০টা গ্রেনেড।

শাফায়াত জামিল স্যার এসে প্রথমে রাজি হলেন না। বললেন, একদিন আগেই গুরখারা মরেছে, তোমরা কেউ জীবিত ফিরবে না। সবাই তখন হাত তুলে বলে, স্যার, শহীদ হতেও রাজি আছি। সবার সাহস দেখে উনি দৃঢ়তার সঙ্গে ট্রুপসকে বললেন, আমিও তোমাদের সঙ্গে শহীদ হতে চাই। তোমাদের সঙ্গেই অপারেশনে যাব।

শাফায়াত স্যারকে দিলাম সবচেয়ে বাঁদিকের প্লাটুনে। আমি মাঝখানে। বাঁয়ে অন্যরা। এভাবে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানিদের ২০০ গজের ভেতর চলে যাই। খুব ভোর তখন। আল্লাহর রহমতে এত কুয়াশা পড়েছে, খুব কাছেও কিছু দেখা যায় না। আমার নির্দেশে সবাই ওদের সীমানায় ঢুকে পড়ে নিঃশব্দে। দেখি রাইফেল পজিশনে ঘুমাচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালাম, ট্রুপস খড়ের আগুন বাংকারে দিতেই জীবিত পাকিস্তানি সেনারা দৌড়ে পাশের কাশবনে আশ্রয় নেয়।

খুব সহজেই ওদের ক্যাম্প দখলে নিই আমরা। ওই অপারেশনে আমাদের আটজন শহীদ হয়েছিল। শাফায়েত জামিল স্যারও গুলিবিদ্ধ হন। কাশবনে থাকা পাকিস্তানি সেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিটি তার লুঙ্গির গোছায় থাকা ম্যাগজিনে লাগায় উনি বেঁচে যান।

নূরুন্নবী খান এখন প্রয়াত। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি বীরবিক্রম খেতাব লাভ করেন। রক্তের বিনিময়ে মানচিত্র আনা এ যোদ্ধার কণ্ঠ আমৃত্যু সরব ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। সুবিধা লাভের আসায় তিনি আপস করেননি, সত্য বলতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। স্বাধীন দেশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন এভাবে, “যুদ্ধ করেই দেশ পেয়েছি। রক্ত দিয়ে এই মানচিত্র তৈরি করেছি। আমাদের মানচিত্র রক্তের মানচিত্র, ত্রিশ লাখ শহীদের মানচিত্র। দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ের মানচিত্র। এটা ভিন্ন জাতি। ভিন্ন দেশ।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button