মুক্তিযুদ্ধ

ভাটপিয়ারীর যুদ্ধ

ভাটপিয়ারী অপারেশনে জয় লাভ করলেও মারাত্মক আহত হন আমিনুল ইসলাম। কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনে?

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরী গোপনে চলে যান ভারতের কলকাতায়। দেখা করেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে। তিনি তাকে নিয়ে যান তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। ছাত্রলীগ করেন শুনতেই বললেন, ‘ওরা বিএলএফে যাক’। তাকে রিক্রুট করেন সিরাজুল আলম খান। পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেরাদুন ট্রেনিং একাডেমিতে।

বাকি ইতিহাস শুনি এই বীরের জবানিতে। তিনি বলেন, “ট্রেনিং শুরু হলে ক্যাম্পে এসে নেতারা বললেন, ‘শর্ট ট্রেনিং দেন। ওকে আগেই ভেতরে পাঠাব।’ ফলে ১৫ দিন ট্রেনিং হয় আমার। এলএমজি, এসএলআর, গ্রেনেড, মর্টার ও আরসিএল গান চালানো ছাড়াও এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার কৌশলটাই বেশি শিখেছিলাম। ট্রেনিং শেষে হিলি বর্ডার দিয়ে গোপন পথে আসি নিজের এলাকায় সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি ইউনিয়নে। সঙ্গে অস্ত্র ছিল একটা রিভলভার ও ২৫টি গুলি। ট্রেনিং শেষে বিভিন্ন ব্যাচ ঢুকবে। তাদের দেখাশোনা, শেল্টার, সহযোগিতা ও আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখতেই আগে পাঠানো হয় আমাকে।”

মুক্তিযোদ্ধা এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, ছবি: সালেক খোকন।

এলাকায় মুক্তিবাহিনীর লোকাল একটি গ্রুপকে পান আমিনুল। স্থানীয়ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে ওই গ্রুপটি বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছিল। তিনি তাদের মোটিভেট করে দলে রাখেন। ২০ দিন পর ভারত থেকে ট্রেনিং শেষে ৮ জনের গ্রুপ নিয়ে ভেতরে ঢোকেন মোজাফফর। সব মিলিয়ে তৈরি হয় তাদের ১৫ জনের একটি গেরিলা দল। কমান্ডে ছিলেন মোজাফফর।

ট্রেনিংয়ে নির্দেশ ছিল, ‘পরিচয় দেবে না, গোপনীয়তা রাখবে, অপারেশনে জয়লাভ করলেও প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করা যাবে না।’ সেভাবেই গেরিলা অপারেশন শুরু করেন তারা। প্রথম অপারেশন ছিল বগুড়ার ধুনট থানায়। ওই অপারেশনে জয় পাননি। এরপর সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানায় আক্রমণ করেন। কয়েক পুলিশকে আত্মসমর্পণ করানোর পর সেখানে মিলে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ৬-৭ বাক্সভর্তি গুলি। পরবর্তী অপারেশনগুলোতে সেসব কাজে লেগেছিল। বিএলএফের সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে এভাবেই আমিনুলরা গেরিলা আক্রমণ করেন বিভিন্ন এলাকায়।

ভাটপিয়ারী অপারেশনে জয় লাভ করলেও মারাত্মক আহত হন আমিনুল ইসলাম। কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনে? তিনি অকপটে বলেন অপারেশনের কথা, “ভাটপিয়ারীতে পাকিস্তানিদের একটা শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল, একটি স্কুলের ভেতর। পাকিস্তানি আর্মি, রাজাকার ও মিলিশিয়া মিলে সেখানে ছিল প্রায় ৯০ জন। আমরা ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র ছিল ২টি এলএমজি, ৫টি এসএলআর আর অগণিত গ্রেনেড। ক্যাম্পে আক্রমণের আগে প্রতিজ্ঞা করি ‘লাশ হয়ে যাব, তবু জয় না নিয়ে ফিরব না।’

সময়টা অক্টোবরের ১৬ তারিখ হবে। রাত ১১টার দিকে সাডেন অ্যাটাক করি। অ্যাটাকের ধরন দেখে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল ইন্ডিয়ান আর্মি আক্রমণ করেছে। ভেতর থেকে তারা চিৎকার করে বলে ‘জয় হিন্দ’। আমরা তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি।

স্কুলের ছাদে ছিল ওদের দুটি বাংকার। সেখান থেকে ওরা বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। আমরা কিছুতেই এগোতে পারি না। আমাদের সঙ্গে ছিল দুর্ধর্ষ চারজন গেরিলা। তোতা, ফরিদ, মমিন ও হালিম। ওরা ছাত্র ইউনিয়ন করত। তাদের দায়িত্ব দিই বাংকারে আক্রমণের। অস্ত্র রেখে তারা কোমরে লুঙ্গির ভাঁজে চারটা করে গ্রেনেড গুঁজে নেয়। ছাদের পাশেই ছিল বড় একটা বটগাছ। ওই গাছের একটা ডাল চলে গেছে ছাদের ওপর। ডাল বেয়ে ছাদের বাঙ্কারে গ্রেনেড ছোড়ে চার গেরিলা। দুজন করে দুই বাংকারে চারজন পাকিস্তানি সেনাই মারা পড়ে।

রাত তখন আনুমানিক দুটো। পাকিস্তানিদের বলি সারেন্ডার করতে। কিন্তু তা না করে তারা কয়েকটা রুমে অবস্থান নেয়। দূরে শত শত লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আরও সাহসী হয়ে উঠি। খুশিতে স্কুল বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ি। সঙ্গে ছিল মোতালেব। আমরা দুজন একটা বারান্দায় পৌঁছতেই পেছন দিকের একটা রুম থেকে পাকিস্তানিরা গুলি ছোড়ে। গুলিটি আমার নিতম্বের ডান পাশে বিদ্ধ হয়। গুলির ঝটকায় মোতালেবও ছিটকে পড়ে।

প্রথমে কিছু বুঝিনি। পেছনে ব্যথা শুরু হলে নিতম্বে হাত দিতেই অনুভব করি বড় একটা মাংস খণ্ড ঝুলছে। পিনপিন করে রক্ত বের হচ্ছিল। চিৎকার দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকি। সহযোদ্ধারা ছুটে আসে। রক্ত যাচ্ছিল খুব। ধরেই নিয়েছিলাম মারা যাব। আমাদের এ অবস্থা দেখে সহযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ‘আমাদের নেতাকে গুলি করছে! মার শালাদের’ বলেই গুলি করতে থাকে। কিছু পাকিস্তানি আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যায়। তার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মারা যায় প্রায় ৬০ জন।

চিকিৎসা নিলেন কোথায়? সহযোদ্ধারা কাঁধে করে নিয়ে যায় ইতালি গ্রামে। ওটা ছিল নিচু গ্রাম, সারাবছর পানি থাকত। নামকরা কম্পাউন্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম। মেছরা গ্রাম থেকে তাকে ডেকে আনে তারা। নিতম্বে ঝুলে থাকা মাংসখণ্ডটা সেলাই করে তিনি লাগিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদিন পরই ওই মাংসে পচন ধরে। কষ্টের মাত্রাও যায় বেড়ে। পরে মাংসখণ্ডটি কেটে ফেলা হয়। এক মাস বিছানায় ছিলাম। একেক রাতে থেকেছি একেক বাড়িতে। নিজে চলতে পারি না। সহযোদ্ধারা কাঁধে করে নিয়ে গেছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। তাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়।

স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছর পর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন দৈনিক ইত্তেফাকে। পরে স্টাফ রিপোর্টার এবং সর্বশেষ ব্যুরো প্রধান হন তিনি। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার বলা কথা প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়েই থাকবে।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা জরুরি বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরী। প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন শেষ কথাগুলো, এভাবে, “কত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা তোমরা সে ইতিহাস জেনে নিও। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিষয়ে সতর্ক থেকো। দেশটাকে ভালোবেসে এগিয়ে নিও। নিজের কাজ সততার সঙ্গে করার নামই দেশপ্রেম।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৯ ডিসেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button