সুইসাইডাল অপারেশন– কিলো ফ্লাইট ও জ্যাকপট

কিলো ফ্লাইট নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধাভিযানের ইতিহাস। দুঃসাহসিক ওই অভিযানের এক অগ্রসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম বীর উত্তম। জীবনদ্দশায় কথা হয় তার সঙ্গে।
একাত্তরে কিলো ফ্লাইট গ্রুপের ট্রেনিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন যেভাবে, “আমি তখন কলকাতায়, ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকার আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিমানে ওঠেন। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন? বললেন না।
আমরা নামলাম একটি পরিত্যক্ত রানওয়েতে। চারপাশে জঙ্গল ও পাহাড়। ওখানে এয়ারফোর্সের আরও দুজন বৈমানিককে পাই। তারা হলেন, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম। আরও ছিলেন পিআইএরও বৈমানিক ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকি, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন সাহা, ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন সফরুদ্দিন।
ওই জায়গাটার নাম ডিমাপুর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি ওটা। কিন্তু সেখানে কেন আসলাম? তখনও কিছুই জানি না। পরদিন সকালে খন্দকার সাহেব বললেন, আজকে একজন গুরুত্বপূর্ণ গেস্ট আসবেন। তখন সবকিছু জানতে পারবে।
সকাল ১০টার দিকে একটা ডাকোটায় আসলেন একজন। কে জানেন? এয়ার ভাইস মার্শাল পিসি লাল, চিফ অব এয়ার স্টাফ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স।
তাকে একটা ছোট্ট গার্ড অব অনারও দিলাম আমরা। তিনি বললেন, ‘আমরা তিনটা এয়ার ক্রাফট জোগাড় করেছি। এ তিনটা আপনারা যেভাবে ব্যবহার করতে চান করতে পারবেন।’
তারা দিয়েছিল একটা ডাকোটা ডিসি থ্রি পরিবহন বিমান, একটি অর্টার বিমান এবং আরেকটি অ্যালুয়েড হেলিকপ্টার। কিন্তু কোনোটিই যুদ্ধ বিমান ছিল না। সবগুলো ছিল সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট। যা দিয়ে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব।
আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্টারের। হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। আর ডাকোটা ডিসি থ্রি বিমানটি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন খালেদকে। সবাই অভিজ্ঞ পাইলট। তবুও তৃতীয় দিন থেকেই বিমানগুলো নিয়ে ফ্লাইং শুরু করি।
ছিলাম টিম লিডার ফর অর্টার। আমার নম্বর টু। সঙ্গে দুজন- ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ট্রেনিং আমাদের। এরপর হয় নেভিগেশন। মানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। আমরা নয় ঘণ্টার নেভিগেশনও করেছি। জানতে চাইতাম এত লম্বা ফ্লাইং কেন করাচ্ছেন? ওরা শুধু বলতো, ‘হাই কমান্ডের নির্দেশ’।”
আব্দুল ওয়াহেদ তালুকদার ও শামসুন নাহার বেগমের প্রথম সন্তান শামসুল আলম। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার পাতিলাপাড়ায়। তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে জয়েন করেন ১৯৬৪ সালের জুন মাসে। পরে পাইলট অফিসার হিসেবে পোস্টিং হয় করাচিতে।
আলাপচারিতায় ফিরি একাত্তরে। প্রশ্ন রাখি ভারতীয় ওই বিমানগুলো দিয়ে কীভাবে অপারেশন করলেন?
তিনি বলেন, “হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট দুটোকে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স বেইস জোড়হাটে। ওখানে ওগুলোকে পুরোপুরি যুদ্ধ বিমানের রূপ দেওয়া হয়েছিল।
অর্টারের দুইদিকে দুটি উইংয়ে রকেট লাগানো। ডান দিকে সাতটা, বাঁ দিকে সাতটা। ডানদিকের দরজাটা খোলা। সেখানে একটা টুইন ব্যারেল ব্রাউনিং গান ফিট করা। ভেতরে পেটটা কেটে সেখানে সেট করা তিনটা বোম র্যাক। একেকটা বোম র্যাকে ৪টা করে মোট বারোটা বোম লাগানো। ২৫ পাউন্ডের একেকটা বোম, যা বিশেষ ধরনের এবং মূলত আগুন জ্বালাতে সাহায্য করবে।”
এরপরই যুদ্ধের কায়দায় ট্রেনিং শুরু হয়। একাত্তরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয় সব ট্রেনিং। কিন্তু টার্গেট কী? তারা তখনও জানেন না। হঠাৎ জোড়হাটে যাওয়ার একটা মেসেজ আসে। সেখানে গিয়েই কিলো ফ্লাইট অপারেশনের নির্দেশ পান সবাই।
তার ভাষায়, “আমাকে বলল, ‘ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলম। তোমার টার্গেট হলো টু ডিসট্রয়েড চিটাগাং অয়েল রিফাইনারি। টার্গেট ডেট ২৮ নভেম্বর।’
তারা আরও জানাল, ‘চিটাগং বিমানবন্দরের রানওয়ের ঠিক পাশেই ওটা। রানওয়েতে ওদের কাছে কোনো এ কে গান(যা দিয়ে এয়ারক্রাফটে ফায়ার করা হয়) নেই। ফলে খুব নির্ভয়েই অপারেশন করা যাবে।’
সুলতান মাহমুদের টার্গেট দিল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেন, ইউএসএসও’র তেলের ডিপো ধ্বংস করা।
নির্দেশনা নিয়ে ডিমাপুরে ফিরে আসলাম। সাতদিন পর আবার ডাকলো। এবার টার্গেট টাইম ঠিক করে দিল। সবার টার্গেট টাইমটা ছিল একই, রাত বারোটা এক মিনিটে।
আমরা ছিলাম সুইসাইডাল গ্রুপ। ফিরে আসব কিনা জানি না। আমি ক্যাপ্টেন, কো পাইলট হলেন ক্যাপ্টেন আকরাম। বোম ফেলবেন সার্জেন্ট হক আর এয়ার গানার ছিলেন রুস্তম আলী। মোট চারজন। সঙ্গে নিলাম আরও দুজন টেকনিশিয়ানকে।
২৬ নভেম্বর ডিমাপুর ছেড়ে কৈলাশহর চলে যাই। মিলিটারি ভাষায় এটাকে বলে ফরোয়ার্ড এয়ার বেইস। সেখানে একটা তিনহাজার ফিট ছোট্ট রানওয়ে আছে। ওখানেই যাই অর্টারটা নিয়ে। পাশেই তেলিয়ামোড়া। ওখান থেকে হেলিকপ্টারে টেকওভার করবেন সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম।
২৮ নভেম্বর। আমরা প্রস্তুত। বিকেল ৪টা বা সাড়ের ৪টার দিকে একটা মোটর সাইকেলে আসেন ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের এক ফ্লাইং অফিসার। বললেন, একটা মেসেজ আছে। এটা পড়ে ফেরত দিতে হবে।
খুলে দেখলাম লেখা- ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট ক্রু, ইউর কিলো ফ্লাইট মিশন ইজ সাসপেন্টেড টুডে। উই শ্যাল ইনফর্ম ইউ আওয়ার নেক্সট বুলেটিন।’
মনটা খারাপ হলো। কিন্তু তবুও অপেক্ষায় থাকলাম। ৩ ডিসেম্বর বিকেল তখন ৫টা। মোটরসাইকেলে ওই অফিসার আবার আসলেন। এবার তার সিগন্যাল ম্যাসেজে লেখা এমন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, কনগ্রাচুলেশন। ইউর ওয়েটিং ডেজ আর ওভার। টু ডেইস ইজ দা ডে ফর ইউর ফাইনাল অ্যাটাক। অল আদারস ব্রিফিং উইল এজ বিফোর।’
সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের বললাম, এয়ারক্রাফট তৈরি করো। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চারজন ঢুকলাম প্লেনে। সবাই সবার সাথে হাত মেলালাম। রাত পৌনে আটটার দিকে আমরা টেকঅফ করি।”
কীভাবে অ্যাটক করেন? কোন বাধার মুখে কি পড়েছিলেন?
শামসুল আলম আদ্যোপান্ত বলেন যান।
“প্রথমে এক হাজার ফিট উঁচুতে ফ্লাই করি। এরপর ৫০০ ফিট, এভাবে ২০০ ফিটে নেমে আসি। আস্তে আস্তে উচ্চতা কমাচ্ছিলাম যাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার ধরতে না পারে। বে অব বেঙ্গল দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন চাঁদ উঠেছে। আমি বলবো, শুক্লা সপ্তমীর চন্দ্র। নিচে চকচকা পানি দেখা যাচ্ছে। প্লেনটা তখন ৫০ ফিট নিচ দিয়ে চলছে।
তখন রাত ১২টা পার হয়ে যাচ্ছে। এয়ার ক্রাফটটা আস্তে আস্তে উঁচুতে ওঠালাম। নিচে দেখলাম চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়। পাশেই ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারি। সারি সারি আলো জ্বলছে সেখানে। প্লেনটাকে একটা চক্কর দিয়েই ফার্স্ট টার্গেটে দুটো রকেট ফায়ার করি। দুই জায়গাতে হিট করল। কিন্তু কোনও এক্সপ্লোশন হলো না।
দ্বিতীয় আরেকটা হিট করলাম। কিন্তু এবারও এক্সপ্লোশন নেই। বেশ অবাক হলাম। তৃতীয় হিটটি করতে যাবো তখনই এয়ারপোর্ট থেকে এ কে গান দিয়ে পাকিস্তানিরা সমানে ফায়ার শুরু করে। বুঝে যাই ইনফরমেশন ভুল ছিল। ওদের কাছে এ কে গানও আছে।
তখনও আমি টার্গেটে অটল। দুটো রকেট হিট করে টার্ন করছি অমনি বিশাল শব্দে রিফাইনারির একটা ট্যাংক এক্সপ্লোশন হলো। আরও ৪ থেকে ৬টি রকেট ফায়ার করি। দেখলাম নিচে শুধু আগুন আর আগুন। আনন্দে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠি। অনেক দূর থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহানি শিখা।
প্রায় পৌনে নয় ঘণ্টা ফ্লাইংয়ে ছিলাম আমরা। ইতিহাসে এটা ছিল সব থেকে দীর্ঘ মিলিটারি অপারেশন। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও কেউ নয় ঘণ্টা ফ্লাই করে টার্গেট ডে সট্রয় করে নাই। ওটা আমরাই রচনা করেছিলাম। যা ঘটেছিল কিলো ফ্লাইট অপারেশনে।
হিট করে ফিরে ল্যান্ড করি কুমরিগ্রামে। সাড়ে চারটা বাজে তখন। যখন নামি তখন দেখি গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের রিসিভ করার জন্য। মানুষটি ৬ ফিটের মতো লম্বা। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুলে বললেন, ‘বয় ওহ বয়, ইউ হ্যাভ ডান ইট’।”
ওই অপারেশনের ইমপ্যাক্ট কতটা ছিল? এ বীর উত্তম অকপটে বলেন, “অ্যাটাকের খবরটি বিবিসিসহ বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হতে থাকে। কিলো ফ্লাইট অপারেশনের ফলেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তেল সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে তেল সরবরাহেরও সুযোগ ছিল না তাদের। পরে আরও বিশটির মতো বিমান অপারেশন করি আমরা। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়ে।”
১৯৭১ সালে নৌ-কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে অ্যাটাক করে। যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’। কেমন ছিল তাদের ট্রেনিং? কীভাবে তারা এতগুলো বন্দরে একই সময়ে অ্যাটাক করলেন? এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীরপ্রতীক)-এর মুখোমুখি হই। তিনি যুক্ত ছিলেন চাঁদপুর নদীবন্দর অ্যাটাকে। আলাপচারিতার শুরুতেই অপারেশন জ্যাকপটের ট্রেনিং বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
তার ভাষায়, ‘আটজন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে চলে আসেন দিল্লিতে। প্রবাসী সরকার তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ। তাই নেভাল ইউনিট প্রয়োজন। এ কারণে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্দেশ্যেই ইন্ডিয়ান নেভির তিনজন অফিসারসহ সাবমেরিনার রহমত উল্লাহ (বীরপ্রতীক) আসেন আমাদের হাতিমারা ক্যাম্পে।
নৌ-কমান্ডো হিসেবে কারা যোগ দিতে প্রস্তুত? অনেকে হাত তুললো। কিন্তু তারা বেছে নিলো পোর্ট এরিয়ায় ছেলেদের। সাঁতার জানতে হবে, বিদেশিরা ট্রেনিং দেবে তাই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হতে হবে-এমনটাই ছিল যোগ্যতা।
প্রাথমিকভাবে ৭০-৮০ জনকে বাছাই করা হয়। এরপরই বলা হলো এটা হবে সুইসাইডাল স্কোয়াড। অনেকেই তখন হাত নামিয়ে নিলো। অতঃপর ফিটনেস দেখে সিলেকশন করা হয় ৩০-৩২ জনকে। আমিসহ টিকে যাই চাঁদপুরের ১৩ জন।
আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল পলাশীতে, ভাগিরথী নদীর তীরে। ১৪ মে ১৯৭১ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হয়। সুইসাইডাল স্কোয়াড। তাই আগেই বন্ডে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
উল্টো বা চিৎ হয়ে সাঁতার কাটা, পায়ে ফিনস পড়ে শুধু চোখ-নাক ভাসিয়ে পানিতে মাছ বা সাপের মতো নিঃশব্দে চলা, জুডো-কারাতে ট্রেনিং, ম্যাপ রিডিং, মাইন বিস্ফোরণ প্রভৃতি শেখানো হয় ট্রেনিংয়ে। জাহাজ উড়ানোর ওয়াটার টাইট মাইনগুলো একেকটা ছিল ৫ থেকে ৬ কেজি। অপারেশনে সেগুলোই জাহাজে ফিট করতে হবে। তাই বুকে দুই-তিনটা ইট বেঁধে আমাদের সে কৌশলই শেখানো হয় ভাগিরথী নদীর জলে। বিশজন করে একেকটি গ্রুপ ছিল। এইচ গ্রুপে আমি, ওই গ্রুপের কমান্ডও করতাম। ট্রেনিং চলে ৩১ জুলাই ১৯৭১ পর্যন্ত।
ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার এম এন সামন্ত, লে. কমান্ডার জিএম মার্টিস, লে. কপিল, কে সিং ও ক্যাপ্টেন সমীর কুমার দাশের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং হয় নৌ-কমান্ডোদের। ট্রেনিং করান কে এম দাস, ভট্টাচার্জ, কফিল, সিসিং, নানাবুজ প্রমুখ। ধরেই নেওয়া হয়েছিল অপারেশনে আমরা ম্যাকসিমাম মারা যাব। মাইন ছাড়া অস্ত্র ছিল শুধুমাত্র একটি কমান্ডো নাইফ। কিন্তু বুকে ছিল দেশপ্রেম আর মাতৃভূমিকে মুক্ত করার তীব্র বাসনা।’
ট্রেনিং শেষে পরিকল্পনা হয় অপারেশন জ্যাকপটের। সেই ইতিহাস শুনি এই বীরপ্রতীকের মুখে। তিনি বললেন যেভাবে, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ (দাউদকান্দি ফেরিঘাটসহ) নদীবন্দরে একই ডেট ও টাইমে অপারেশন চালাতে হবে। তিনশোর মধ্য থেকে সিলেকশন করা হয় ১৬০ জনকে। চট্টগ্রামের জন্য ৬০ জন, মোংলার জন্য ৬০ জন, চাঁদপুরে ২০ জন ও নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জন করে নৌ-কমান্ডো গ্রুপ তৈরি করা হয়। ফ্রান্স ফেরত সাবমেরিনার এ ডাব্লিউ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীকে (বীরউত্তম ও বীরবিক্রম) চট্টগ্রাম, আহসান উল্লাহকে (বীরবিক্রম) মোংলায়, বদিউল আলমকে (বীরউত্তম) চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আবেদুর রহমানকে।
ছোটভাই শামসুলসহ আমাকে রাখা হয় চাঁদপুরের গ্রুপে। ৯ আগস্ট ১৯৭১। চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ-এই তিনটি গ্রুপকে সামরিক বিমানে আনা হয় আগরতলায়, শালবনের ভেতর নিউ ট্র্যানজিট ক্যাম্পে। একদিন পরেই দেওয়া হয় আর্মস অ্যামুনেশন-প্রত্যেকের জন্য একটা লিমপেড মাইন, একটা কমান্ডো নাইফ, একজোড়া ফিনস, থ্রি-নট-থ্রিসহ কিছু অস্ত্র এবং প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একটা টু ব্যান্ডের রেডিও।
বলা হলো ওই রেডিওর মাধ্যমেই সিগন্যাল পাঠানো হবে। কুমিল্লার ময়নামতি হয়ে আমরা চাঁদপুর আসি ১১ আগস্টে। প্রথমে উঠি নিজ বাড়ি দাশাদিতে, মেঘনা নদীর পাড়ে। কিন্তু যেতে হবে চাঁদপুরের দক্ষিণে, ডাকাতিয়া নদীর কাছাকাছি। ওই দিকটাতেই থাকে অধিকাংশ লঞ্চ ও স্টিমারগুলো। করিম খাঁ নামে এক মামার বাড়ি ছিল রঘুনাথপুরে। বাবার পরামর্শে পরদিন ইলিশ ধরার তিনটি নৌকায় ওখানে গিয়ে উঠি। অতঃপর রেডিওতে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকি।
নির্দেশ ছিল প্রত্যেকদিন তোমরা আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র ধইরা রাখবা। ওটার মাধ্যমে সিগন্যাল পাবা। কেমন সিগন্যাল? আকাশবাণীতে সকাল সাত বা সাড়ে সাতটায় বাজবে একটি গান ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান’। এ গান হলেই অপারেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর আরেকটা গান বাজবে ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি।’ এই গানটি হলেই বুঝতে হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং ওই দিন শেষে রাত বারোটার পর অবশ্যই অ্যাটাক করতে হবে।
১৩ আগস্ট সকালে বাজল প্রথম গানটি। আমি, নুরুল্লাহ পাটওয়ারী, বদিউল আলম সঙ্গে সঙ্গে পাটের ব্যাপারী সেজে রেইকি করতে বেরোই। ২৪ ঘণ্টা পর অর্থাৎ ১৪ আগস্ট চূড়ান্ত নির্দেশনার গানটি বাজার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন সেটি না বেজে বাজল ১৫ আগস্ট সকালে। ফলে রাত বারোটার পরই আমরা অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিই। লঞ্চ টার্মিনাল ও স্টিমার ঘাটসহ ছয়টা টার্গেট প্লেস ঠিক করে ফেলি। তিনটা মাইন লাগিয়ে ফাটাতে পারলে একটা জাহাজ হানড্রেড পারসেন্ট ডুবে যায়। সেটি করতে লাগবে তিনজন নৌ-কমান্ডো। তাই তিনজন করে ৬টা গ্রুপে টার্গেট ভাগ করে নিই। বাকি ২ জন থাকবে রেসকিউ টিমে।
আমার সঙ্গে থাকে খুলনার আফসার আর সাতক্ষীরার গফুর মাস্টার। টার্গেট প্লেস ছিল লন্ডনঘাট জেটি। ওখানে পাকিস্তানি সেনারা আর্মস অ্যামুনেশন আর মালামাল নামাত। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ডাকাতিয়া নদী দিয়ে নামি। পায়ে ফিনস, পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার। বুকে গামছা দিয়ে মাইন পেঁচিয়ে চিৎ সাঁতারে এগোই। কিছুক্ষণ পরপরই দেখে নিই দিকটা। এভাবে লন্ডনঘাটে এসেই জেটিতে মাইন সেট করে দিই। ৪৫ মিনিট পরই বিস্ফোরণ ঘটবে। তাই ওই সময়ের মধ্যেই সরে পড়তে হবে।
পুরো বর্ষা ছিল তখন। মুখার্জি ঘাটে পাহাড়ায় ছিল পাকিস্তানি সেনারা। নদী দিয়ে কী যায় বলেই ওরা পানিতে দুইটা ফায়ার করে। তখন ডুব দিয়ে দূরে গিয়ে উঠি আমরা। এর কিছুক্ষণ পরেই লন্ডনঘাটসহ বিভিন্ন জাহাজে লাগানো অন্যান্য গ্রুপের মাইনগুলো একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে।
কথা ছিল বহরিয়া গ্রামের মাঝামাঝিতে মাছ ধরার দুটি নৌকা নিয়ে থাকবে রেসকিউ টিমের দুজন। কিন্তু বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে গানবোট নিয়ে চারপাশে টহল দিতে থাকে। ওদের ভয়ে রেসকিউ টিমের দুজন নৌকা ছেড়ে গ্রামের ভেতর আত্মগোপন করে। ফলে ফিরে এসে আমরা নৌকা না পেয়ে বিপদে পড়ি। তখন যে যার মতো সরে পড়ি।’
মুক্তিযুদ্ধে সুইসাইডাল অপারেশন ছিল কিলো ফ্লাইট ও জ্যাকপট। এ দুটি অপারেশন আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। জীবনকে বাজি রেখে দেশকে মুক্ত করতে এ অপারেশনে যুক্ত ছিলেন যারা তারাই বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম ও বীরত্বে পাওয়া বাংলাদেশেই আজ আমরা দাঁড়িয়ে। আজকের সব বিষয় আগামী ইতিহাসের অংশ হবে না। কিন্তু কিলো ফ্লাইট ও জ্যাকপট অপারেশনের মতো বীরত্বের ইতিহাস অনাদিকাল পর্যন্ত প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাট্রিবিউনে, প্রকাশকাল:২৬ মার্চ ২০২৫
© 2025, https:.