স্বাধীনতার লড়াইয়ে সাহস জুগিয়েছিল যে ভাষণ

রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে ৭ মার্চের ভাষণ যারা শুনেছেন তারা কী দেখেছেন, কতটা প্রভাবিত করেছিল ওইদিনের ভাষণ? বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে একটি প্ল্যাটফর্মে এনে স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে এ ভাষণ কতটা কার্যকরী ছিল? তৃণমূলে গবেষণা ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এ লেখার অবতারণা।
ওইদিন প্রায় দশ লক্ষাধিক মানুষের উত্তাল সমুদ্রে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ওইদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা। কিন্তু তা করলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লাখো নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ পেত।
ফলে খুবই বিচক্ষণ ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যেন দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করতে না পারে, তার জন্য তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি। কিন্তু ভিন্নভাবে বলে দিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কথা। পাশাপাশি পাকিস্তানিদের প্রতি ছুড়ে দেন ৪টি শর্ত আর দেশবাসীর জন্য জারি করেন ১০টি নির্দেশনা।
ডা. রোকাইয়া খাতুন একাত্তরে ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। ৭ মার্চ কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তাকে? অকপটে তিনি বললেন যেভাবে, ‘ছোটবোন হামিদাকে নিয়ে ওইদিন যাই রেসকোর্স ময়দানে। আর্ট কলেজের উল্টো দিকের গেট দিয়ে ঢুকি আমরা। মঞ্চের খুব কাছে বসার আলাদা জায়গা ছিল মেয়েদের। গোটা মাঠে লোকে লোকারণ্য। সবার হাতে হাতে বাঁশের লাঠি। পাকিস্তানি একটা হেলিকপ্টারও ওপর দিয়ে চলে যায়। ওরা কি গুলি করবে? কিছুটা ভয়েও ছিলাম আমরা। পাকিস্তানি শোষণের পুরো প্রেক্ষাপট তিনি ভাষণে তুলে ধরেন। শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় কী করতে হবে!
এরপরই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। ডামি রাইফেলে ১০ দিনের ট্রেনিং হয়। ট্রেইনার ছিলেন মুজিবুর রহমান। রোকেয়া কবির, নেলী, রাকাসহ আমরা ২৯জন ছাত্রী সেখানে ট্রেনিং নিই।
পরে বলা হলো পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদেরও ট্রেনিং করাতে হবে। আমার দায়িত্ব পড়ে খিলগাঁও চৌধুরী পাড়া পলিমা সংসদের পাশের এলাকা। সেখানে ২৫ থেকে ৩০জন নারীকে একত্রিত করে ট্রেনিং করায় পলিমা সংসদের মাঠে। বাবা আব্দুল মৈধরও তখন এয়ারফোর্স থেকে সবেমাত্র রিটায়ার্ড করেছেন। তিনিও পশ্চিম মালিবাগ ডিআইটি মাঠে স্থানীয় অনেক লোককেই ট্রেনিং করিয়েছেন।
এই যে ট্রেনিং নিয়ে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়া—এর স্পিরিট ছিল মূলত ৭ মার্চের ভাষণ। এ কারণেই ইতিহাসে এ ভাষণটির গুরুত্ব অপরিসীম। গোটা দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল ওই ভাষণ।
ঢাকার বাইরের ছাত্রদেরও প্রভাবিত করেছিল সেটি। কথা হয় মির্জা জামাল পাশার সঙ্গে। তার বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার ডেকাপুর গ্রামে। একাত্তরে তিনি ছিলেন সিলেট এমসি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
তিনি বললেন যেভাবে, “ভাষণ শুনতে ওইদিন ভোরে নেতাদের সঙ্গে ট্রেনে চলে যাই ঢাকাতে। খুব কাছ থেকে শুনে মাথার ভেতর বিজলির মতো ঝিলিক দিচ্ছিল। তিনি বললেন—‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’ মনের মধ্যে তখন প্রশ্ন শত্রু কে? এরপর উনি পাকিস্তানি আর্মিদের উদ্দেশ্যে বললেন—‘তোমরা ব্যারাকে থাকো…..গুলি চালালে আর ভালো হবে না…।’ পরিষ্কার হয়ে গেলাম শত্রু আসলে কারা। শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মাথায় তখনই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি গেঁথে গেছে।
ফিরে গিয়ে বাবারে বলি, “বাবা, স্বাধীনতা কিতা? উনি বললেন, ‘পচ্চিম ফাকিস্তানি ইতায় আমরারে বউত লাখান চুইয়া খাইছে। অখন আমরা মুক্ত অওয়া উ লাগব অকটাউ স্বাধীনতা।’ ওই যে ভাষণে শুনেছি, ‘মুক্তির সংগ্রাম’। আমার ভেতর তখন থেকেই ‘মুক্তি’ আর ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটি খেলা করতে থাকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিই খুব তাড়াতাড়ি। ওই ভাষণই ছিল আমার প্রেরণা।”
এ নিয়ে রুহুল আহম্মদ বাবু বললেন ভিন্নভাবে। তার কাছে এ ভাষণই স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা। তার বাসা ঢাকার গ্রিন রোডে। তিনি ওইদিনের স্মৃতিচারণ করলেন এভাবে—“বাঙালিরা লিড দেবে—এটা পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে নির্বাচনে হেরে গিয়েও ওরা পাওয়ার (ক্ষমতা) দিচ্ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় মানুষ আন্দোলনে নামে তখন। পুলিশও রোজ গুলি করে মানুষ মারে। দেশ তখন উত্তাল। খেয়াল করবেন তিনি ভাষণে বলেছিলেন—‘আর যদি একটা গুলি চলে।’ এর মানে কী? গুলি চলছিল। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল। কী অনুরোধ? সেই কথাও তিনি বলেছিলেন। পরিষ্কারভাবে বললেন—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি সবকথাই বলে দিলেন ভিন্নভাবে। ফলে এরপর থেকেই আমরা সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকি।”
বাবুর মতো মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরীও একই মত দেন। তিনি থাকতেন শান্তিনগরের ২২ নম্বর চামেলিবাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সার্কেলেরই ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। পরে তিনি কাজে করেন মুজিবনগর সরকারে।
ওইদিন ভাষণ শুনতে বন্ধু ড. সেলিমুজ্জামানসহ তিনিও গিয়েছিলেন রেসকোর্সে। কী দেখলেন সেখানে? তার ভাষায়, ‘সাধারণ মানুষের হাতে হাতে ছিল বাঁশের লাঠি। রেসকোর্স মাঠের চারপাশে পজিশনে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক। রিউমার ছিল এ ট্যাংক দিয়েই ওরা বাঙালিদের গুড়িয়ে দেবে। কিন্তু তবুও সেদিন আগত জনতা তা টলারেটই করেনি।’
মনিরুজ্জামান আরও বলেন, “সামরিক বাহিনীতে যারা ছিলেন তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার ভাই’। নরমালি এটা বলার কথা নয়। তার মানে একটা সহিষ্ণু মনোভাব তার তখনও ছিল। শেষে বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি… যার যা কিছু আছে…।’ এতে পরিষ্কার হয়ে যাই, তিনি গেরিলা ওয়ারের কথাই বলে দিচ্ছেন। ফলে আর কিছু বলার বাকি থাকে না।”
একাত্তরে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ ছিলেন ছয় নম্বর সেক্টরের চিলাহাটি সাবসেক্টরের কমান্ডার। মার্চে পাইলট অফিসার হিসেবে তার পোস্টিং ছিল পাকিস্তানে, পিএ বেইজ বাদিনে। ওখানে তারা শোনেন ৭ মার্চের ভাষণ। কীভাবে? তিনি বলেন, “এক আর্মি বন্ধু ছুটিতে গিয়েছিল দেশে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রেকর্ডিং করা একটা ক্যাসেট সংগ্রহ করে সে। ক্যাসেটের ভেতরের টেপটা পেন্সিলে রোল করে লুকিয়ে নিয়ে আসে এখানে। ওটা সেট করে সবাই মিলে শুনলাম। ভাষণের নির্দেশগুলো আমাদের প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। তখনই বুঝে যাই—এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা। যুদ্ধ অনিবার্য। ফলে পরে কৌশলে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই।”
পুলিশে কর্মরত ছিলেন কনস্টেবল মো. আবু শামা। ৭ মার্চ রাজারবাগ থেকে তাদের টহলে পাঠানো হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে। তিনি বললেন এভাবে, “ভাষণে তিনি বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে। আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়……..প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে….।’ আমাদের কাছে ওটাই ছিল যুদ্ধের নির্দেশনা।
এরপর থেকেই পুলিশ ব্যারাকের অবস্থা বদলে যেতে থাকে। ওখানে অবাঙালি পুলিশ সদস্য যেমন ছিল, আবার বাঙালি হয়েও স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকও ছিল। খেতে বসলেই ওরা অহেতুক আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। আগে এটা আমরা সহ্য করতাম। কিন্তু ভাষণের পর হাতাহাতি হতে থাকল। প্রতিরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুকুর পাড়ে আমরা আলোচনায় বসতাম। সিদ্ধান্ত হয় যা-ই ঘটুক আমরা প্রতিহত করব। ২৫ মার্চে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের প্রতিরোধের সাহসও আমরা পেয়েছিলাম ওই ভাষণ থেকেই।”
রেসকোর্স ময়দানে খুব কাছ থেকে ভাষণটি শোনেন ঢাকার গেরিলা আবদুল মান্নান (বীরপ্রতীক)। তিনি বললেন যেভাবে—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—এই কথাটাতেই আবেগটা আবদ্ধ হয়। হোয়াট ডাজ ইট মিন। আমি মনে করি, এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু বললেন—‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি..’ তার মানে এটাই ফাইনাল হুকুম। এটাই স্বাধীনতার ফাইনাল অর্ডার।”
৭ মার্চের ভাষণ গোটা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছিল। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকে জাগ্রত রাখতেও ঐতিহাসিক এ ভাষণটির শক্তি ছিল প্রবল। এ ভাষণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে স্বাধীনতার মূল সঞ্জীবনী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও নিয়মিত ভাষণটি সম্প্রচার করা হতো। ফলে এ ভাষণটিই হয়ে উঠেছিল রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকাপোস্ট ডটকমে, প্রকাশকাল: ৭ মার্চ ২০২৫
© 2025, https:.