মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১: ইতিহাসে বিস্মৃত অন্যরকম মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযুদ্ধ পুরোপুরি ছিল একটি জনযুদ্ধ। যেখানে নানাজন নানানভাবে কাজ করে ত্বরান্বিত করেছিল স্বাধীনতা অর্জনকে। কারণেই পদযাত্রী দলের কামরুল আমান, বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লা যুদ্ধআলোকচিত্রী হামিদ রায়হান একেকজন অন্যরকম মুক্তিযোদ্ধা

শুধু অস্ত্র হাতেই নয়, একাত্তরে নানাজন নানানভাবে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, ত্বরান্বিত করেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনকে। ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত তেমন কিছু যোদ্ধার কথা তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা।

মুক্তিযুদ্ধ তখন চলছে। নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের ভয়ে জীবন নিয়ে দলে দলে মানুষ আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। খোলা হয় শরণার্থী শিবির। প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ওপর। ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়। শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে তারা সরকারকে চাপ দিতে থাকে।

ঠিক ওই সময়েই পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ আয়োজনের। এতে অংশ নেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বাংলাদেশের ৩৮ জন শিক্ষিত যুবক। ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।

পদযাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জনসভা করতেন। গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহ্বান জানাতেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে। তাদের সকলের হাতে হাতে শোভা পেত— ‘আমাদের এক কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘মুজিবের মুক্তি চাই’ সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা। ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি চলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর। ওই খবর ব্যাপক আলোড়নও তোলে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

পদযাত্রী দলের ডেপুটি লিডার-০২ ছিলেন কামরুল আমান। বর্তমানে থাকেন ঢাকার মিরপুরে। বাবার চাকরির সুবাদে একাত্তরে ছিলেন নারায়ণগঞ্জে। পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা আর বর্বরতা তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। পাকিস্তানি আর্মিরা নারায়ণগঞ্জ দখলে নিলে কামরুল চলে যান কলকাতায়। পরে কাজ শুরু করেন যশোরের বেনাপোলে, বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরে। তাদের মাধ্যমেই তিনি রিক্রুট হন ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’র দলে।

তার ভাষায়, “বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডল’ নামের একটি সংগঠন। এটি গঠিত হয় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আটটি সংগঠনের সম্মিলনে। এদের সহযোগিতা করে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন। পদযাত্রার মূল উদ্যোক্তা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং আহ্বায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জি।

কামরুল আমান, ১৯৭১-এ বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রীদের ডিপুটি লিডার-০২

বনগ্রাম থেকে ১৪ অক্টোবর ১৯৭১-এ আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে পৌঁছি। সেখানে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরের মাটি ছুঁয়ে স্বাধীনতার জন্য শপথ নিই।”

পদযাত্রীদের নাম জানালেন কামরুল, “লিডার আবদুল খালেক। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের ছাত্র। ডেপুটি লিডার-০১ খুলনার একরামুল ইসলাম। আমি ছিলাম ডেপুটি লিডার-০২। বাকিরা হলেন— রফিকুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, মুরারী মোহন সরকার, বিনয় কুমার বিশ্বাস, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ আবু বকর, পরিতোষ কুমার মণ্ডল, আবদুল লতিফ (১), আবদুল লতিফ (২), সৈয়দ রবিউল হক, দুলাল মণ্ডল, ওহিদুজ্জামান চাকলাদার, তুষার কান্তি সুর, শেখ আনোয়ার কামাল, সুভাষ চন্দ্র বসু, অমিত দেব, ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডল, আনন্দ মোহন রায়, প্রদীপ কুমার শীল, আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল কাদির, পরিতোষ কান্তি কবিরাজ, দেলোয়ার হোসেন, অনিল কুমার বিশ্বাস, মইন উদ্দিন, সহিদুল ইসলাম, বিশ্বনাথ সাহা, সমীর কুমার বসু, ওমেদ আলী, আবু বকর সিদ্দিকী, শামসুল হক, মতিলাল দাস, অহিভূষণ চক্রবর্তী, সনৎ কুমার বিশ্বাস, আশরাফ হোসেন ও দিলীপ কুমার নাগ।”

প্রথমদিন তারা বাংলাদেশের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ বহরমপুর থেকে গোকর্ণর দিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা। প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হতো। বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হতো জনসভার। উঠোন-বৈঠকও হয় অগণিত। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলে মতবিনিময়। এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তিনিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লখনৌ, আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে।

৩০ জানুয়ারি ছিল গান্ধীপ্রয়াণ দিবস। ওইদিন দিল্লির রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হবে— এমনটিই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগেই বিজয় লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তরপ্রদেশে এসে পদযাত্রাটি শেষ হয়।

এ নিয়ে ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? কামরুল আমান বলেন, “পদযাত্রায় স্থানীয় জনগণই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত। পাটনাতে যখন গেলাম ওখানকার চিফ আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পল্টনের মতো বিশাল একটি মাঠে মিটিং হয়। বক্তৃতায় বললাম নিজের অভিজ্ঞতার কথা, গলাকাটা লাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশের মাটিচাপা, পুরান ঢাকার মানুষ পোড়ানো, মানুষের চর্বি গলানো মেঝেতে নিজের পায়ের ছাপ। লিডার খালেক বললেন রাজশাহীতে গণহত্যার বর্বরতার কথা। বর্ণনাগুলো যখন হিন্দিতে অনুবাদ করে বলা হচ্ছিল তখনই দেখলাম ওখানকার মানুষ হুহু করে কাঁদছে।

লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বক্তব্য শুনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কণ্ঠ মেলায় ছাত্রছাত্রীরা। মুজিবের মুক্তিতে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারও করে তারা। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় জনগণ একাট্টা ছিল। তাদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমর্থনটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় শক্তি। আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদটা মানুষের মনের ভেতরই গাঁথা থাকে। কে কোন দেশের, সেটা বড় কথা নয়। মানুষের মুক্তির, মানুষের স্বাধীনতার জন্য মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়।”

ভিন্ন অভিজ্ঞতাও ছিল কামরুলদের। তিনি বললেন যেভাবে, “মুর্শিদাবাদে এক উঠোন-বৈঠকে ভারতীয় একদল মুসলমান আমাদের ওপর বেশ রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান ছিল একটা মুসলমানের দেশ। তোমরা সেটা ভেঙে দিতেছ। এক কোটি লোক আইসা আমগো ওপর খাইতাছ। আমগো ভারতও ধ্বংস করবা তোমরা। যুদ্ধ তোমাদের, কিন্তু সৈন্য মরে আমগো। এই যুদ্ধ আমাদের দরকার নাই। বিদায় হও তোমরা।’

আমরা ধৈর্য্য হারাই না। পাকিস্তানে মুসলমান যে মুসলমানকে তেইশ বছর ধরে কীভাবে নির্যাতন করেছে, মুসলমান মুসলমানের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কীভাবে পদদলিত করেছে— এটা আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি। বলি, মুসলমান ব্যাপার না, আসল বিষয় শোষণ আর নির্যাতনের।”

বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার দলটি স্বাধীনতার জন্য ভারতে হেঁটেছিল ১৪০০ মাইল। মুক্তিযুদ্ধটা কেন ন্যায় যুদ্ধ— সেটি ভারতীয়সহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল তাদের কাজ। পদযাত্রীদের কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছরেও পদযাত্রায় অংশ নেওয়া ৩৮ জনকে কণ্ঠযোদ্ধা বা ফুটবলযোদ্ধাদের মতো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি, যা প্রত্যাশিত ছিল।

ঈশ্বরদীর বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লা ছিলেন অন্যরকম আরেক যোদ্ধা। একবার তার খোঁজে গিয়েছিলাম ঈশ্বরদীতে।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসায় পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই রূপপুর গ্রাম। ওই গ্রামের রাস্তার পাশের এক কড়ইতলায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান চালাতেন তিনি। সবার কাছে সেটি মোল্লার দোকান হিসেবে পরিচিত ছিল।

দশ গ্রামের মধ্যে শুধু কাশেম মোল্লারই ছিল একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে তিনি শর্টওয়েভে সবাইকে বিবিসির খবর শোনাতেন। বিবিসিতে দেশের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনতে চায়ের দোকানে ভিড় লেগে যেত। ক্রমে ভিড় বাড়তে থাকল। চায়ের দোকানের পাশে গড়ে উঠল আরও বেশ কয়েকটি দোকান। এভাবে তৈরি হয় একটি গ্রাম্যবাজার।

সন্ধ্যা হলেই রূপপুর গ্রামে হাঁকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যকে বলত, ‘চলো, বিবিসি শুনতে যাই।’ এভাবে মোল্লার দোকানে বিবিসির খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাজারের নাম প্রথমে ‘বিবিসি শোনার বাজার’ এবং পরে তা হয় ‘বিবিসি বাজার’।

বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লা

কাশেম মোল্লার ভাঙাচোরা দোকানের এক কোণে ঝুলছিল বড় একটি ছবি। ছবিতে তার সঙ্গে সাংবাদিক আতাউস সামাদসহ বেশ কয়েকজন। জানা গেল, বিবিসি নামে একটি বাজারের নামকরণের কথা শুনে বিবিসির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে এখানে এসেছিলেন বিবিসির তৎকালীন ‘ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন’-এর প্রধান ব্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা সার্ভিসের উপপ্রধান সিরাজুল ইসলাম, প্রযোজক ও প্রেজেন্টার দীপঙ্কর ঘোষ এবং সংবাদদাতা আতাউস সামাদ।

একাত্তরের কথা উঠলে কাশেম মোল্লা বললেন এভাবে, “একাত্তরের ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানি আর্মি কয়েকটি বাজার পুড়িয়ে দিলে চলে যাই নিজ গ্রাম রূপপুরে। নিজের হাতে লাগানো কড়ইতলীতে বসাই ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।

বিয়ের পরে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম একটি রেডিও কেনার আবদার করেছিল। রেডিও শোনার প্রতি এক ধরনের ঝোঁক ছিল আমরাও। তাই টাকা জমিয়ে কিনে আনি একটি থ্রি ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। ওই রেডিওই হয়ে যায় ইতিহাস।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চায়ের দোকানে রেডিওতে বাংলা খবর শোনাতাম। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ নিয়মিত ভিড় জমাত চায়ের দোকানে। গোপনে মাঝেমধ্যেই দলবেঁধে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নানা খবর জেনে যেতেন আমার কাছ থেকে।

দেশ স্বাধীনের কয়েকদিন আগে রাজাকারদের তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি আর্মি হানা দেয় আমার চায়ের দোকানে। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আঁতকে উঠি।”

বিবিসি’র একটি দলের সাথে কাশেম মোল্লা

তিনি বলতে থাকেন, “পাকিস্তানি আর্মি এসে হুংকার আর গালি দিয়ে বলে, ‘মাদারচোদ, তোম ইধার আঁও, তোমহারা দোকান মে রেডিও বাজতা হ্যায়, শালে, তুমকো খতম কারদেগা, তুম রেডিও নিকালো।’ সেনাদের কথায় আমার জানে তো পানি নাই। ভেবেছিলাম মেরে ফেলবি। আমি বললাম, ‘ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে শুনালকে লেকে চলে যাতা হে।’ কথা শুনে পাকিস্তানি সেনারা আমাকে মাটিতে ফেলেই মারতে শুরু করে। সেনাদের এই নির্যাতনে আমার ডান পা বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এরপর থেকেই ওই পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারি না।”

কাশেম মোল্লার চায়ের দোকান ছিল খুবই ঝুঁকির জায়গা। পাশেই ছিল আর্মি ক্যাম্প আর চারপাশে রাজাকারদের পদচারণা। এরই মধ্যে তিনি রেডিওতে বিবিসির খবর শোনাতেন আর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা খবর দিতেন গোপনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু তবুও পাননি কোনো স্বীকৃতি।

২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই বীর। কিন্তু কাশেম মোল্লার জীবনেতিহাস মিশে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে।

আরেক মুক্তিযোদ্ধা হামিদ রায়হান। গিয়েছিলেন যুদ্ধ করতে। যুদ্ধ করেছেন ঠিকই, তবে অস্ত্র নয়, ক্যামেরা হাতে। একাত্তরের কুষ্টিয়ার তরুণ হামিদ রায়হানের বয়স এখন নব্বই ছুঁইছুঁই। বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের ৫২ মসজিদ বাড়ি লেনে (বর্তমানে সেটি ১১ নম্বর খলিলুর রহমান সড়ক)।

তার কাছে শুরুতেই জানতে চাই ফটোগ্রাফিতে নেশা হওয়ার কারণ। হামিদ রায়হান বললেন যেভাবে, “ফটো তোলার ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। একটা কমদামী ক্যামেরা ছিল, লুবিডর ক্যামেরা। ওটা দিয়েই ফটো তুলতাম। ইয়াসিকা ক্যামেরা পোস্টালে অর্ডার করা যেত তখন। টাকা জমিয়ে একবার ৫০০ টাকায় ইয়াসিকা সিক্স-থার্টিফাইভ ক্যামেরা করাচি থেকে আনাই পোস্টালের মাধ্যমে। ওই ক্যামেরাটাই ইউজ করেছি একাত্তরে।”

২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতেই সারাদেশে শুরু হয় গণহত্যা। তখন কী করলেন হামিদ রায়হান?

“পরিবারসহ চলে যাই ভায়রার বাড়িতে, দৌলতপুরের কামালপুরে। পরে সেখান থেকে যাই ভারতের করিমপুরে। থাকি জামশেদপুরের এক ভাড়াবাড়িতে। কুমারখালীর এমপিএ গোলাম কিবরিয়া সাহেবসহ নেতারা একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প খোলার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন সেখানে। ফলে তার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে ক্যাম্পে নানা কাজ শুরু করি।”

যুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে রায়হান বলেন, “ট্রেনিং থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শুরু করেছে। যুদ্ধ চলছিল পুরোদমে। ওই সময় ক্যাম্প থেকে হায়ার ট্রেনিংয়ে লোক নেওয়াও কমে যাচ্ছিল। তখনই মনে হলো, তাহলে ফটোগ্রাফিটাকে কাজে লাগাই।

যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান

বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর তখন কাজ করছিল বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে। ওরা ভলান্টিয়ার নিয়োগ দিত। শরণার্থী ক্যাম্পের যুবক-যুবতীদের সংগঠিত করে লেফট-রাইট করানোসহ নানা কাজে যুক্ত রাখত ভলান্টিয়াররা, যাতে তারা বিপথগামী হয়ে না যায়। ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের উদ্যোক্তা ছিলেন বাল্যবন্ধু ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। লন্ডনের ওয়ার অন ওয়ান্ট তাদের ফান্ড দিত। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ ছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান।

একদিন ব্যারিস্টারকে (আমীর-উল ইসলাম) বললাম, ‘তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমি ফটোগ্রাফিটা করি।’ তাদেরও প্রয়োজন ছিল ডকুমেন্টেশনের জন্য একজন লোক। ফলে তার মাধ্যমেই ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ পাই। এরপরই ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করি যুদ্ধদিনের নানা অধ্যায় ও ঘটনাপ্রবাহ।”

বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের দল যখন যে জায়গায় যেত, তাদের সঙ্গেই যেতে হতো হামিদ রায়হানকে। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়েও ছবি তুলতেন তিনি। পাটগ্রামের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। ১৯৭১ সালের পহেলা অক্টোবর তারিখে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থসহ পাটগ্রামের কোর্ট-কাছারি, হাসপাতাল ও বিভিন্ন জায়গায় ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। এছাড়া তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চলগুলোতে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংস করা ব্রিজ, কালভার্ট ও ভবনের ছবিও উঠে এসেছে তার ক্যামেরায়, যা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ছবি, ১১ ডিসেম্বর যশোরের পিকনিক কর্নার এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া তাজা রকেট বোমার পাশে দুই শিশুর ছবি, ঝিকরগাছায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ, ২২ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়া রাজাকারের ছবিও ক্যামেরাবন্দি করেন এ-আলোকচিত্রী।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুশীলন। ছবি: আবদুল হামিদ রায়হান

পাকিস্তান সেনাদের বেয়নেটের টর্চারে আহত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিএসবি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার ছবি, ২ ডিসেম্বর মুক্ত কালিগঞ্জে (সাতক্ষীরা) পরিদর্শনে আসা এএইচএম কামরুজ্জামান, মেজর জলিল, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মেজর হায়দার প্রমুখের ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। ১১ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভা হয় টাউন হল ময়দানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। রায়হানের তোলা সেদিনের ছবিতে দেখা যায় এম আর আক্তার মুকুল, উপেন তরফদার, জহির রায়হান ও যশোরের রওশনসহ অনেককে।

কুষ্টিয়াতে রাজাকারদের ধরে আনার ছবি, ৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতির দিন কলকাতায় একটি মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবিও উঠে আসে তার ক্যামেরায়। এই ছবিগুলোই ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। একাত্তরে হামিদ রায়হানের তোলা ছবিগুলো বিশ্ব গণমাধ্যমে পাঠানো হতো। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

আলাপচারিতায় যুদ্ধদিনের স্মরণীয় কয়েকটি ঘটনার কথাও তুলে ধরেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান। তার ভাষায়, “খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অভুক্ত অবস্থায় মানুষ আসছে দেশ থেকে। তিন-চারদিন পর খাবার পেল। আবার কলেরা শুরু হয়ে গেল। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চোখের একটা অসুখ দেখা দেয় তখন। চোখের ওই রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল সব ক্যাম্পে। ফলে পশ্চিম বাংলার লোকেরা ওই রোগের নাম দেয় ‘জয় বাংলা রোগ’। এক শরণার্থী ক্যাম্পে দেখেছি মা মরে গেছে, বাচ্চা গিয়ে তার দুধ খাচ্ছে। এই ছবিটা তুলতে না পারায় খুব আফসোস হয়েছিল। হাজার হাজার লোক মরেছে ক্যাম্পে আসার আগেই, খাবারের অভাবে। খুলনার গল্লামারী বদ্ধভূমিতে মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলির স্তূপ ছিল। অধিকাংশকেই সেখানে বিহারি ও রাজাকাররা হত্যা করেছিল। ওই সময়ের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না একাত্তরে কী হয়েছিল!

কুষ্টিয়ায় কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। ছবি: আবদুল হামিদ রায়হান

একাত্তরে ক্যামেরাটাই ছিল আমার অস্ত্র। শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়াও ছবি তুলেছি বর্ডার এলাকার অ্যাকশন ক্যাম্পগুলোতে। আমার ক্যামেরায় তুলে আনি একাত্তরের ৫৪০টির মতো ছবি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ২৯২টি, দৃককে ১০০টি ও সামরিক জাদুঘর ‘বিজয় কেতনে’ দিয়েছি আরও বেশ কিছু ছবি।”

স্বাধীনতা লাভের পর কুষ্টিয়া শহরে রূপান্তর নামে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান। প্রজন্মের কাছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে সেখানে টানানো রয়েছে বেশকিছু ছবি। পরিসর ছোট হলেও রূপান্তর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার এক জীবন্ত মিউজিয়াম।

আবদুল হামিদ রায়হানকে অদ্যাবধি মুক্তিযুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে স্বাধীন দেশের সরকার কোনো স্বীকৃতি বা পুরস্কার প্রদান করেনি। এ নিয়ে আফসোসও নেই তার। শুধু বললেন, “কর্তব্য ছিল, করেছি। নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে। একাত্তরের ছবিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে রূপান্তর স্টুডিও দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ওই ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক। ভাবুক তারা, কত কষ্টে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি!”

মুক্তিযুদ্ধ পুরোপুরি ছিল একটি জনযুদ্ধ। যেখানে নানাজন নানাভাবে কাজ করে ত্বরান্বিত করেছিল স্বাধীনতা অর্জনকে। এ-কারণেই পদযাত্রী দলের কামরুল আমান, বিবিসি বাজারের কাশেম মোল্লা ও যুদ্ধ-আলোকচিত্রী হামিদ রায়হান অন্যরকম মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীন দেশে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই তাদের। একাত্তরকে কর্তব্যকর্ম ভেবেই তৃপ্ত হন তারা। তাই তাদের গৌরবের ইতিহাসটা প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে সবাই মিলে। তাদের অর্জনের ইতিহাসটুকু পাঠ করে এ-প্রজন্ম মাতৃভূমিকে ভালোবাসার তীব্র আনন্দটুকু অনুভব করতে শিখবে। তাদের কথা ভেবে একদিন তারা বলবে, তোমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলে ওই বাংলাদেশকে আমরা সত্যিই গড়ে তুলব।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৯ মার্চ ২০২৫

© 2025, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button