মুক্তিযুদ্ধ

২৫ মার্চ কালরাতে যা দেখেছেন তারা

একাত্তরের পঁচিশ মার্চে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল ইতিহাসের কলঙ্কজনক এক অধ্যায়ের জঘন্যতম সূচনামাত্র

একাত্তরের পঁচিশ মার্চ। মধ্যরাত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইট নামে তারা শুরু করে গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, পুরান ঢাকার শাঁখারীপট্টি, পিলখানাসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। আবার ওই রাতেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

গণহত্যার প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠান তিনি। কী ঘটেছিল ওই কালরাত্রিতে?

তার ভাষায়, “২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট। খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যে কোনো সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করবে। খবরটা আসতেই সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আগেই পালিয়ে যায় অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা।

থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি নিয়ে দু-তিনশ সদস্য পুলিশ লাইনসের ব্যারাক, প্রশাসন ভবনের ছাদ, পুকুর পাড়, রোডের পাশে এবং মানুষের বাড়ির ছাদে পজিশনে চলে যান। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তারা ব্যারিকেড দেন মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর ও চামেলীবাগের ডন স্কুলের সামনে। ওই স্কুলের ছাদেও পজিশন নেন ২০ থেকে ২৫ জন পুলিশ সদস্য।

দুটি রাইফেল নিয়ে আমি আর মনির ওয়্যারলেস বেইস স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি প্রশাসন ভবনের নিচতলায়। ওয়্যারলেস সার্কিটে বসে অপেক্ষায় আছি ওয়্যারলেসে কোনো মেসেজ আসে কিনা।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটা মেসেজ পাই। তেজগাঁও এলাকায় প্যাট্রলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল মেসেজ দেন।

আমিরুল বলেন, ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, হাউ ডু ইউ হিয়ার মি, ওভার।’

প্রত্যুত্তরে আমি বলি, ‘বেইস ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইউর মেসেজ, ওভার।’

তখন তিনি বলেন, ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দ্য ক্যান্টনমেন্ট।’

ওরা আসছে— এটা নিশ্চিত হয়ে যাই। ছয়-সাতশ লোক ছিল রাজারবাগে। একজন গিয়ে পাগলা ঘণ্টি বাজান। ফলে বাকি পুলিশ সদস্যরাও অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে পজিশনে চলে যান।

রাত তখন সাড়ে ১১টা। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি চালান। প্রথম টার্গেটেই পাকিস্তানি সেনাদের দু-জন মারা যায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ, যা শুরু করেছিল পুলিশ সদস্যরাই। ওরা তখন ব্রাশফায়ার শুরু করে। এলএমজি, এইচএমজি মর্টারগুলোও গর্জে ওঠে।

মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। ছবি: সালেক খোকন

গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে কামানের একটা গোলা পড়ে। ফলে বিদ্যুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা। নানা চিন্তা ভর করে মনে। কী করা যায়? আক্রান্ত হওয়ার খবরটা সারা দেশের সবাইকে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে— এ চিন্তা থেকেই নিজ উদ্যোগে একটা ওয়্যারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।

রাত ১২টা বাজার তখনো তিন-চার মিনিট বাকি আছে। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস বার্তায় আমি বলি: ‘বেইস ফর অল স্টেশন অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট মেসেজ ফর ইউ, কিপ নোট, কিপ লিসেনিং, ওয়াচ। উই আর অলরেডি আন্ডার অ্যাটাক বাই পাক আর্মি, ট্রাই টু সেইভ ইউরসেলফ, ওভার অ্যান্ড আউট।’

পরে আমরা প্রশাসন ভবনের চারতলার ছাদে অবস্থান নিই। সেখানে ছিল আরও ৪০ থেকে ৫০ জন। মূল ভবনের ওপর থেকে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে পজিশনে থাকি। রাত তখন ৩টা হবে। ট্যাংকের সাহায্যে ওরা রাজারবাগের মেইন দুটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেই টিনের ব্যারাকে আগুন দেয়। বের হতে না পেরে অনেকেই সেখানে পুড়ে মারা যান। ছাদ থেকে আমরা গুলি চালালে ওরা ব্রাশফায়ার করতে থাকে। দেখলাম পুলিশের শত শত লাশ পড়ে আছে। রাত ৪টার পর ৮-১০টি ট্রাক এনে ওরা লাশগুলো তুলে নিয়ে যায়। ফজরের আজানের পর পাকিস্তানি সেনারা ছাদে আসে। ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের বের করে আনে। শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। বন্দি ছিলেন দেড়শর মতো।”

ইকবাল হলের মাঠে ডেডবডির নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ছিল

কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা নাজমা শাহীন বেবীর সঙ্গে। একাত্তরে তিনি ছিলেন আজিমপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাবা আবু জায়েদ শিকদার তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষানিয়ন্ত্রক। থাকতেন ফুলার রোডের ১৭ নম্বর বাড়ির একতলায়। তৎকালীন ইকবাল হলের সামনেই ছিল বাড়িটি।

ওই সময় ছাত্রলীগের ২০-২৫ জন মেয়েকে ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করানো হয় কলাভবনের ভেতর। ট্রেনিং করান পিয়ারো ও দুদু ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সঙ্গে নাজমা ও তার বড় বোন রোজীও ট্রেনিং নেন। ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে ওই ট্রেনিং।

এরপর কী ঘটল? নাজমা শাহীন বললেন যেভাবে, “রাত ১০টার দিকে পাড়ায় মা খালারা একসাথে হন। বান্ধবী ফ্লোরার সঙ্গে বাড়ির সামনে আমিও তখন দোলনা আর স্লিপারে খেলছি। দেখলাম ইকবাল হলের ক্যান্টিনটায় কিছু ছাত্র জড়ো হয়েছে। আবার ওরা দৌড়াদৌড়ি করে চলে গেল। এর মধ্যে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমদ শরীফ দৌঁড়ে এসে বাবাকে ডাকলেন। বাবা তখন ফুলার রোড পাড়ার সেক্রেটারি ছিলেন। কী যেন কথা হলো তাদের।

ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের মুনিম সাহেবের ছেলেকে তারা পাঠালেন ইকবাল হলে। কোনো ছাত্র যদি হলে থেকে থাকে তাহলে তারা যেন তক্ষুণি হল ছেড়ে চলে যায়। এটা জানাতে।

বাবা একটা কাগজে কিছু লিখে দারোয়ানকে দিয়ে প্রতিটি বাড়িতে পাঠান। লেখা ছিল— গোলাগুলি শুরু হলে কেউ যেন উঁকি না দেয়। বাতিও যেন না জ্বালে।

মুক্তিযোদ্ধা নাজমা শাহীন বেবী। ছবি: সালেক খোকন

রেললাইনের পাশের বস্তিতে থাকত দারোয়ান চাচার পরিবার। বাসায় বাসায় খবরটা না দিয়েই তিনি সেখানে চলে যান। ফলে অনেকেই আর্মি নামার খবরটা পাননি।

পরে শুনেছি আহমদ শরীফের ভায়রা ছিলেন ঢাকার তৎকালীন ডিসি। উনাকে দুপুর বেলায় ক্যান্টনমেন্টে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি থাকতেন ইস্কাটনে। রাতে সেখান থেকেই দেখেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে এবং সেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছে। এ কারণেই ফোন করে তিনি আহমদ শরীফকে সর্তক থাকতে বলেন।

বাবা আমাদের বললেন, ‘গুলি শুরু হলে বাতি জ্বালাবে না, জানালা দিয়ে উঁকিও দিবে না কেউ।’ কেননা আমাদের দুটি বেডরুমের জানালাই ছিল ইকবাল হলের দিকে। মধ্যরাতে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। গুলির শব্দে লাফিয়ে উঠি।

সবাই তখন ক্রলিং করে মাঝখানের ড্রইং রুমটাতে চলে আসি। সময় দেখার জন্য বাবা একটা ঘড়ি এনে রাখে। গোলাগুলি তখন বেড়ে যায়। আবার একটু কমে আসে। এভাবেই চলছিল। পুরো ঘরে এমন নিস্তব্ধতা বাবা যে ঘড়িটা এনে রেখেছে তার টিকটিক আওয়াজটাও আমাদের বুকের মধ্যে এসে লাগছিল।

থেমে থেমে গোলাগুলি তখনও চলছে। ট্রেসার গান দিয়ে ওরা ফায়ার করে। আকাশে বিভিন্ন রঙের আলো দেখা যায়। চারপাশে মানুষের আর্তচিৎকার শুনি আমরা।

এক সময় ফজরের আজান হয়। বাবা বললেন, এখন হয়তো ওরা চলে যাবে। কিন্তু না, দেখা গেল আজানের পর গোলাগুলির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। দু-একটা বাসায় বাতি জ্বালিয়েছিল কেউ কেউ। তা দেখে আর্মিরা বিল্ডিংয়ের দিকে গুলি ছোড়ে।

ভোরে দেখতে পাই ইকবাল হলের বিভিন্ন রুমে আগুন জ্বলছে। পাকিস্তানি আর্মিরাও হাঁটাচলা করছে। বুঝে গেলাম একটা ভয়াবহ সময় পার করছি আমরা।

সকালবেলা দেখলাম আইন বিভাগের কামরুদ্দিন হোসাইনকে আর্মি বাড়ি থেকে ইকবাল হলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওনাকে নিয়ে কী করে দেখছি। হঠাৎ হল থেকে চিৎকার করে ওঠে চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি আর্মি। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট, আজাদ পত্রিকায় কাজও করতেন। ভোরে পত্রিকা অফিস থেকে হলে আসতেই আর্মির হাতে ধরা পড়েন।

চিৎকার করে বলেন, ‘রোজী-বেবি আমাকে বাঁচাও’। কিছুই করার ছিল না তখন। পরে চিশতী ভাইয়ের আর কোনো খবর পাইনি। শুনেছি অনেকগুলো ডেডবডি নীলক্ষেত পেট্রল পাম্পের কাছে আর্মিরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। চিশতী ভাইয়ের কথা মনে হলে এখনও খুব কষ্ট পাই।

এদিকে আর্মিরা জিপ নিয়ে এসে ডা. মোর্তজাকে তুলে নিয়ে যায়। বুঝলাম এখন বাসা থেকেই ধরে ধরে নিয়ে যাবে ওরা। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় ব্রিটিশ কাউন্সিলে আগুন ধরিয়ে দেয়। গোলাগুলিও চলছে থেমে থেমে। ধরেই নিলাম একসময় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে। ওই রাতটা কাটে নানা শঙ্কায়। পরদিন সকালে কারফিউ ব্রেক হয়। বাবা বললেন, এখানে আর থাকা যাবে না।

এসএম হল ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাঝ বরাবর একটা রাস্তা ছিল তখন। যেটা দিয়ে ইকবাল হলেও যাওয়া যেত। রাস্তাটি চলে গেছে পলাশীর দিকে। আমরা ফুলার রোডের বাসা থেকে বের হয়ে ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময় আতকে উঠি। দেখি অনেকগুলো ডেডবডি স্তূপ করে মাঠের ভেতর ফেলে রাখা হয়েছে। কতগুলো ডেডবডির নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। বেয়নেট চার্জ করে মারা হয়েছিল তাদের। একটা রিকশায় আমরা তখন শেখ সাহেব বাজারের দিকে চলে যাই।”

জগন্নাথ হলের পরিস্থিতি ছিল বিভীষিকাময়

রবীন্দ্র মোহন দাস ছিলেন জগন্নাথ হলের সাবেক সিনিয়র অফিস অ্যাটেনটেন্ড। কথা হয় তার সঙ্গে। বীভৎস ওই রাতের কথা তিনি বললেন এভাবে, “রাতে ঘুমাতে গেলে শুনতে পাই পাথরের ওপর দিয়ে খচখচ করে কারও হাঁটার শব্দ। দেয়ালের ওপরে উঠে একটু মাথা তুলে দেখলাম জগন্নাথ হল চারদিক থেকে ঘেরাও করছে পাকিস্তানি আর্মিরা। হলের মাঠের পাশের দেয়াল ভাঙা ছিল। ওই পাশ দিয়েও আর্মি ঢুকল। পরে ওপরের দিকে সার্চলাইট জ্বালায়। অতঃপর ব্ল্যাকআউট করে শুরু করল গুলি। এরপরই মা…রে… বাবা…রে, বাঁচা… রে বাঁচা…রে বলে মানুষ আর্তনাদ করতে লাগল। সে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।

আমাদের টিনের যে ঘর ছিল সেখানে আর্মিরা আগুন লাগিয়ে দেয়। সকালবেলা ওরা আমাকেসহ আরও ৩০ জনকে আটক করে হলেরই একটা গোয়ালঘরে রাখল। গোয়ালঘরের দরজায় রাইফেল দিয়ে দাগ দিয়ে বলল, ‘বাইনচোদ লোক, ইসকো বাহার যায়ে গা তো শ্যুট করকে ফ্যাক দুনগা’।

রবীন্দ্র মোহন দাস ছিলেন জগন্নাথ হলের সাবেক সিনিয়র অফিস অ্যাটেনটেন্ড

তখন এমন অবস্থায় ছিলাম যে বেঁচে আছি না মরে গেছি তা-ই বুঝতে পারছিলাম না। কিছু সময় পর আর্মি এসে তাগড়া তাগড়া জোয়ান এমন ১৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের দিয়ে হলের বিভিন্ন প্রান্তে পড়ে থাকা লাশ জড়ো করাল, বর্তমানে হলের শহীদ মিনারের পেছনের গণকবরে। অতঃপর ওই ১৫ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলল।

আমরা আর ১৬ জন বাকি ছিলাম। এর মধ্যে আমি সবার ছোট। সবার পেছনে একজনের শার্টের পেছন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি আর কাঁপছি। এক আর্মি এসে গণনার পর ১৫ জনকে সামনে এগিয়ে দিয়ে আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে দূরে ফেলে দেয়, বুট দিয়ে লাথিও দেয়। এরপর ওই ১৫ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে তারা ওখান থেকে ইউটিসির গেট দিয়ে চলে যায়।

একটা লোক তখন লাশের ভেতর থেকে উঠে হাতের ইশারায় ডাকছে। আমি দেখতে পেয়ে লোকটির কাছে দৌড়ে গেলাম। সে বলে, ‘ভাই, আমাকে একটু জল খাওয়াও।’ আমি হাতের তালুতে জল নিয়ে আসলাম। কিন্তু আসতে আসতেই সব জল আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে গেল। এরপর একটা ছোট্ট টিনের কৌটা পেলাম। সেটায় পানি নিয়ে লোকটির মুখে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি ঢলে পড়ে মারা গেল।

ড. জিসি দেব ও মধুদার লাশও আনা হয়েছিল ওখানে। সব আমার চোখের সামনে দেখা। এসএমলি হাউসের মধ্যে একজন হোম টিউটর থাকতেন। তার নাম অনদ্যপান স্যার। তাকে গেটের ওখানে মেরেছে। আমরা তার রক্তের ওপর দিয়েই হেঁটে বের হয়েছি।

এরপর বকশীবাজার গেলাম। ওখানেও গিয়ে দেখি একই অবস্থা। দু-তিনটি লাশ পড়ে আছে। সোয়ারীঘাটে গেলাম, দেখি নদীর কিনারে শত শত লাশ পড়ে আছে।”

শাঁখারীপট্টিতে মানুষ পুড়ে চর্বি গলে পড়ে ছিল

একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য ‘বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা’য় অংশ নিয়েছিলেন কামরুল আমান। বাবা চাকরি করতেন ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। ওই সুবাদে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ছিলেন তোলারাম কলেজের ছাত্র।

কামরুল আমান। ছবি: সালেক খোকন

তার ভাষ্যে, “২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতের মধ্যেই ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কারফিউ চলছিল। তা শিথিল হতেই কাউকে কিছু না জানিয়েই রওনা হলাম ঢাকার দিকে। ডেমরার ডিএনডি মাটির বাঁধ। ওই পথেই শত শত লোক পালিয়ে আসছে ঢাকা থেকে। সবার মুখে লোক মরার খবর। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে সাত-আটজনের গলা কাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানে না। দেহ তখনো কই মাছের মতো নড়ছিল। এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কবজি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। কার লাশ এটা? কেউ জানে না। খবর পেয়ে ছুটে যাই শাঁখারীপট্টিতে। আহা রে! কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পোড়াইছে। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারীপট্টির প্রবেশমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনো আগুন জ্বলছিল। একটি বাড়িতে পা রাখতেই গা শিউরে ওঠে। মানুষ পুড়ে চর্বি গলে মেঝেতে পড়ে আছে, তাতে পড়েছে আমার পা। এর চেয়ে ভয়াবহ আর মর্মান্তিক দৃশ্য কী হতে পারে!”

রক্তের গন্ধ তখনো ছড়াচ্ছিল

ঢাকার গেরিলা তৌফিকুর রহমান। ছবি: সালেক খোকন

২৫ মার্চ নিয়ে কথা হয় ঢাকার গেরিলা তৌফিকুর রহমানের সঙ্গে। বাবার চাকরির সুবাদে তারা থাকতেন সরকারি কোয়ার্টারে, চানখারপুলের রশিদ বিল্ডিংয়ে। ওই রাতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সারারাত গোলাগুলির শব্দ। ওরা যে গণহত্যা চালিয়েছে এটা ক্লিয়ার হই ভোরের দিকে। গেটের বাইরে গিয়েই থ বনে যাই। রাস্তা সুনসান। হঠাৎ কার্জন হলের দিক থেকে একটা আর্মি জিপ আসে। জিপে এলএমজি ফিট করা। ওরা ফায়ার করতে করতে আসছে। স্যান্ডেল ফেলে দৌড়ে দেয়াল টপকে কোনোরকমে বাসায় চলে আসি। বাসার সামনে টং দোকানে একটা ছেলে সিগারেট বিক্রি করত, বরিশাল বাড়ি। দোকানের ভেতর থেকে সে বের হতে গেলে তাকেও গুলি করে হত্যা করে ওরা।

পরে ভয়ে ভয়ে জগন্নাথ হলের দিকে যাই আমি। রাতে ওদিকেই গুলির শব্দ হচ্ছিল। দূর থেকে দেখলাম অনেক মানুষের গুলিবিদ্ধ ডেডবডি পড়ে আছে। কারও মাথায়, কারও বুকে, কারও পেটে গুলি লেগেছে। কয়েকজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েও মারা হয়েছে। রক্তের গন্ধ তখনো ছড়াচ্ছিল। এক রাতে ওরা ফুলবাড়িয়া রেললাইনের দুই পাশের বস্তিগুলোও পুড়িয়ে দেয়। তখন মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে ঢাকার বাতাস।”

ওরা এভাবে মানুষ মারবে, ভাবতেও পারিনি

পঁচিশ মার্চে নাখালপাড়াতেও ঘটেছিল হত্যাকাণ্ড। ওই ইতিহাস জানান প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদউল্লাহ্। তার ভাষায়, “আগেই খবর ছিল পাকিস্তানি সেনারা কিছু একটা করবে। রুহুল আমিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে কিছু বন্দুক আমরা সংগ্রহ করে রাখি। সন্ধ্যার দিকে গাছ কেটে ব্যারিকেড দিই নাখালপাড়ায়, লুকাসের মোড়ে। রাতে পাকিস্তানি আর্মিদের সাঁজোয়া যান বের হয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে। রাতভর শুনি গুলির শব্দ। বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখাও।

মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদউল্লাহ্। ছবি: সালেক খোকন

ওরা এভাবে মানুষ মারবে, ভাবতেও পারিনি। পাকিস্তানি সেনারা আগেই অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান বসিয়েছিল এখানকার কয়েকটি টিলাতে। শাহিনবাগে ছিল দুটি, প্রধান উপদেষ্টার বর্তমান কার্যালয়ের কাছে একটি ও পুরাতন বিমানবন্দরের ওখানে ছিল একটি। ওরা পুরাতন বিমানবন্দরের কাছে একজনকে গুলি করে মারে। পশ্চিম নাখালপাড়ার আট নম্বর রোডে থাকতেন এক সিইও, নাম মজিবুর রহমান। সেনারা তাকেও হত্যা করে ফেলে রাখে রাস্তায়। রেললাইনের পাশেও মিলিশিয়ারা গুলি করে মারে একজনকে। কারফিউ চলছিল তখন। লাশগুলো নেওয়ারও কেউ নেই। খবর পেয়ে আমি, জামাল, লতিফসহ কয়েকজন তিনটি লাশ ছাত্রলীগের অফিসে এনে রাখি। নাখালপাড়া কবরস্থানের পাশেই ছিল অফিসটি। এরপর বিকেলের দিকে কাফনের কাপড় সংগ্রহ করে মাটি দিই।

গণহত্যায় সহযোগিতা করে পিস কমিটির লোকেরা। নাখালপাড়ায় এর চেয়ারম্যান ছিল মাহবুবুর রহমান গোরহা। সে জামায়াতে ইসলামীরও বড় নেতা ছিল। আর পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর হেডকোয়ার্টারও ছিল নাখালপাড়ায়।”

একাত্তরের পঁচিশ মার্চে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল কলঙ্কজনক ইতিহাসে এক জঘন্যতম ঘটনার সূচনামাত্র। পরবর্তী নয় মাসে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষে ত্রিশ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল গণহত্যার ওই বর্বর ইতিহাসকে। এখন পর্যন্ত জঘন্যতম ওই গণহত্যার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চায়নি, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও। মেলেনি জেনোসাইড বা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও।

তাই এই সময়ে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ পাকিস্তানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে পারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এতকাল যা সম্ভব হয়নি, কিন্তু তা কি ঘটবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের এই সময়টাতে?

মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস, আমাদের শেকড়। ব্যক্তি ও দলের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। কিন্তু দেশের প্রশ্নে সকলের এক হওয়ার ভিত্তি হোক গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ মার্চ ২০২৫

© 2025, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button