মে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি
২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ৷ এক বছর পর, অর্থাৎ, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ফিরে তাকানো শুরু করে ডয়চে ভেলে বাংলা৷ গৌরব ও বেদনার সেই নয় মাসে পর্যায়ক্রমে ফিরে তাকানোর এই পর্বে থাকছে মে ১৯৭১-এর কিছু ঘটনার কথা….
গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো খবর ছিলনা কোথাও৷ ফলে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রশ্ন ছিল- বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন? পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে থাকতে পারে- এমন শঙ্কাও ছিল তখন৷
৫ মে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার৷ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আকবর খান করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত ও সুস্থ আছেন৷ সামরিক আইন অনুসারে তার বিচারকাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলেও জানান তিনি৷
‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন’-এ খবর ওই সময় বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তির খবর৷ তবে প্রিয় নেতা ১১০০ মাইল দূরে বন্দি, যে কোনো সময় তাকে হত্যা করতে পারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী- তাই তার মুক্তি নিশ্চিত করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়ে গেল যুদ্ধ জয়ের সবচেয়ে বড় প্রেরণা৷
ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে৷ তাদের সহযোগিতা করে স্বাধীনতাবিরোধী শান্তিকমিটির লোকেরা৷ তাদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতা-সদস্য ও বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত বিহারিরা৷ তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ, মুজিব অনুসারী ও মুক্তিকামী বাঙালি নর-নারীকে নিশ্চিহ্ন করা৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন অনেক বেশি হলেও প্রকৃতপক্ষে কোনো ধর্মের স্বাধীনতাকামী মানুষই তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি৷
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে মে মাসেই, খুলনার ডুমুরিয়া থানার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে৷ সাতক্ষীরা-খুলনার মধ্যবর্তী জায়গায় একটি বড় বাজার ছিল এটি৷ সড়ক ও নদীপথে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ভালো৷ পাকিস্তানি সেনাদের আনাগোনাও সেখানে শুরু হয়নি তখন৷
এ কারণে ওই পথেই খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, ফরিদপুর, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনার হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছিল৷
চুকনগর বাজারে এসে মানুষ রান্নাবান্না, শেষ সদাইটুকু করে নেয়, কেউবা জিরিয়ে নেয়৷ এরপর তারা সীমান্তের দিকে যাত্রা শুরু করে৷ ১৯ মে পর্যন্ত ওখানে ছিল উপচেপড়া ভিড়৷
‘‘হিন্দুদের ঢল নেমেছে চুকনগরে-’’ এমন খবর পৌঁছে যায় সাতক্ষীরায় পাকিস্তান সেনাদের ক্যাম্পে৷ আটলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির সদস্য গোলাম হোসেন এবং ভদ্রা নদীর খেয়া ঘাটের ইজারাদার শামসুদ্দিন খাঁ নামের এক বিহারি গোপনে এমন খবর পৌঁছে দেয়৷
২০ মে তারিখ সকালে পাকিস্তানি আর্মিরা হানা দেয় চুকনগরে৷ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার৷ সেনাবাহিনী ১টি ট্রাক ও ১টি জিপে প্রথমে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলায় এসে থামে এবং মালতিয়া গ্রামের চিকন আলী মোড়ল ও সুরেন্দ্রনাথ কুন্ডুকে গুলি করে হত্যা করে৷ তারপর পাতখোলা বাজারে ঢুকে নিরীহ মানুষদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে গণহত্যা শুরু করে৷
পাক সেনাবাহিনীর একটি দল পাতখোলা বিল থেকে চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতিপাড়া, ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীর পাড়ে আগত মানুষের উপর গুলি চালায়৷ ওইদিন মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে চুকনগরের আকাশ বাতাস৷ ভদ্রা নদীর জলও রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল৷ লাশের কারণে নদীথও আটকে গিয়েছিল কোথাও কোথাও৷
সকাল থেকে শুরু হওয়া আর্মিদের গুলি থামে দুপুরে৷ চার মাইল এলাকা জুড়ে চলা এই নিষ্ঠুর গণহত্যায় শহিদদের প্রকৃত সংখ্যা আজও জানা যায়নি৷ তবে প্রত্যক্ষদর্শী ও গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, ওইদিন চুকনগরে প্রায় ১২ হাজারের মতো নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল পাক বাহিনী৷ (তথ্যসূত্র: চুকনগর গণহত্যা-মুনতাসীর মামুন, গণহত্যা ‘৭১- তপন কুমার দে, ৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ -ডা. এম এ হাসান)
এছাড়া ৫ মে নাটোরের লালপুর থানার গোপালপুর চিনিকলের ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিমসহ ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিনিকলের ভেতরেই পুকুর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ওখানে এমন হত্যাযজ্ঞ চলে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ স্বাধীনের পর ওই পুকুরে অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যায়৷ এ কারণে ‘গোপাল সাগর’ নামের ওই পুকুরটির নামই হয়ে যায় ‘শহীদ সাগর’৷
মে মাসে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসররা বহু স্থানেই এমন হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ তার মধ্যে বরগুনার পিডাব্লিউডি ডাকবাংলো, জেলখানা, বিষখালী নদী ও পাথরঘাটায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায়, নড়াইলের ইতনা গ্রাম, রাজশাহীর জগীশ্বর গ্রাম, সিরাজগঞ্জের হরিণাগোপাল ও বাগবাটি গ্রাম, সিলেটের বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা, নাটোরের রামপুরা খাল, সুনামগঞ্জের সাগরদীঘি উল্লেখযোগ্য৷ (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৮ম খন্ড, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ‘৭১–এর গণহত্যা’-সম্পাদিত আবু সাঈদ; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর- সুকুমার বিশ্বাস)
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলোও ছিল একেকটি টর্চার সেল৷ সেখানে বাঙালি নারীদের ওপর কতটা অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গণা) লাইলী বেগমের সঙ্গে কথা বলে৷ একাত্তরে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে কাইয়ার গুদাম ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে৷ সে সময়ের কথা মনে হলে আজও আঁতকে ওঠেন লাইলী বেগম৷
পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন পিপিএম হাই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি৷ তখন যুদ্ধ চলছে৷ আর্মিরা ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে৷ তাদের সহযোগিতায় ছিল শান্তি কমিটির লোকেরা৷ ওরা চিনিয়ে দিতো মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের৷ বাবা ফেঞ্চুগঞ্জে ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন৷ ওই সময় তিনি পালিয়ে বেড়ান৷ ফলে চাচা কালা মিয়াই দেখভাল করতেন আমাদের৷’’
‘‘একদিন সন্ধ্যায় বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে পাঁচ-সাতজন৷ ফরিদপুর গ্রামের মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল৷ ওরা চাচারে ধইরা নিতে চায়৷ তারে উঠানে নিলে সাহস করে সামনে যাই৷ তখন ওরা আমারেও তুইলা নিয়া যায় কাইয়ার গুদামে৷’’
‘‘ওটা ছিল খুবই অন্ধকার জায়গা৷ মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম৷ আরো নারীরা ছিল৷ মাঝেমধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকার সহ্য করতে পারতাম না৷ সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার৷ সে নির্যাতন কোনো নারীই মুখে বলে বুঝাতে পারবে না৷’’
লাইলী বেগম আরো জানান, ‘‘প্রথম পাঁচ-ছয়দিন একটা রুমে রাখে ওরা৷ পরে আরেকটা রুমে শিফট করে দেয়৷ ওখানে রাখে এক মাস৷ তখনও পালাক্রমে চলে নির্যাতন৷ খাবার দিতো না ওরা৷ দুই তিন-দিন পর মন চাইলে এক বেলায় দিতো রুটির সঙ্গে একটু ডাল৷ একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই৷ ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজ গাঁও স্টেশনের পাশে৷ পরে দুই মাস চিকিৎসা চলে হাসপাতালে৷’’
‘‘কাইয়ার গুদামের বড় বড় বাঙ্কার ছিল৷ সেখানে শত শত নারীকে রাখা হতো ৷ স্বাধীনতার পর আড়াই থেকে তিন’শর মতো নারীকে বের করা হয়েছিল সেখান থেকে৷ পুরুষ কও আর নারী কও ওরা প্রথমে ঢুকাইতো কাইয়ার গুদামে৷’’
‘‘আমার মাথায় কাটার দাগ এখনো আছে৷ বাইশটা শিলাই পড়ছিল৷ দেখেন মুখে ক্ষত৷ বেওনেট দিয়া পাঞ্জাবিরা গুতা দিছে৷ ডান হাতটা ভাঙ্গা৷ পায়ের ক্ষতি করছে৷ রানের ভেতরও বেওনেটের খোচার দাগ আছে অগণিত৷
‘‘নতুন প্রজন্মের কাছে এখন তো টর্চারের কথা বলতে লজ্জা লাগে, ভয়ও লাগে৷ এখন তো কিছু মরা, কিছু জিন্দা হিসেবে বেঁচে আছি৷ সরকার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে, তাতে ভালো আছি৷ কিন্তু ওই কাইয়ার গুদামের পাশ দিয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা ধুক করে ওঠে৷’’
গণহত্যা যখন চলছে তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিরও দাবি উঠতে থাকে৷
একাত্তরের মে মাসেই জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘ভারতের রাজ্যগুলোতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবেতর জীবন যাপন করছে৷ সেখানে তারা স্থায়ী উদ্বাস্তুতে পরিণত হোক, সেটা কারো প্রত্যাশা নয়৷ পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আর কোনো শরণার্থী আর ভারতে না যায় এবং দেশত্যাগীরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে৷’’
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সিনেটরের কাছে পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ডেভিড অ্যাবশায়ারের লেখা একটি চিঠি ওয়াশিংটনে প্রকাশ করা হয়৷ ওই সিনেটরেরা পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তরে চিঠিও লিখেছিলেন৷ অ্যাবশায়ার সিনেটরদের জানান, চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিমান ও ট্যাংক পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তান সরকার সেসব অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবহার করছে৷ পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এম ২৪ ট্যাংক ও এফ ৮৬ বিমান ব্যবহার করা হয়েছে৷ এসব অস্ত্র ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷
আবার ২৭ মে মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ এই সমস্যা সমাধানে বিশ্বের সকল দেশের এগিয়ে আসা উচিত৷’’ (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৩ম খণ্ড)
এমন বিবৃতি ও প্রতিবাদ উত্থাপিত হতে থাকে দেশে দেশে৷ এদিকে ভারতের সহযোগিতায় বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে তখন অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়াও শুরু হয়ে যায়৷
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা শেখ সানোয়ার উদ্দিন রিন্টুর সঙ্গে৷
তার ভাষায়, ‘‘অনেকে বলেন একাত্তরে আওয়ামী লীগ নেতারা ইন্ডিয়ায় গিয়ে বসে ছিলেন৷ নেতারা ওখানে না গেলে কাদের সাথে যোগাযোগ করতাম, হাতিয়ার কীভাবে আসত, প্রশিক্ষণ কোথা থেকে নিতাম৷নেতাদের উদ্যোগেই করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্প চালু হয়৷ সেখানে আমাদের বাছাই করে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বিহার চাকুলিয়া ক্যাম্পে৷
ট্রেনিং খুব সহজ ছিল না৷ আমাদের ছয়টা ছেলের কবর আছে ওখানে৷ সাপে কেটে মেরে ফেলেছিল ওদের৷ আমার উইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন আহসানুল হক বাবলা, আব্দুর রহমান প্লাটুন কমান্ডার৷ পুরো চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল চ্যাটার্জি৷ ট্রেনার সুখদেব সিং ও মেজর ফাটকার কথা এখনও মনে আছে৷ আপন ভাইয়ের মতোই আন্তরিক ছিলেন তারা৷’’
শুধু স্থলযুদ্ধই নয়, একাত্তরের মে মাসেই শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপটের নৌকমান্ডোদের ট্রেনিং৷ নৌকমান্ডো মো. শাহজাহান কবির বীরপ্রতীক এর মুখোমুখি হলে তিনি জানান তার আদ্যোপান্ত৷
‘‘আটজন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে চলে আসেন দিল্লিতে৷ প্রবাসী সরকার তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে৷ বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ৷ তাই নেভাল ইউনিট প্রয়োজন৷ এ কারণে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ সে উদ্দেশ্যেই ইন্ডিয়ান নেভির তিনজন অফিসারসহ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের হাতিমারা ক্যাম্পে আসেন বাঙালি সাবমেরিনারদের একজন, রহমত উল্লাহ (বীরপ্রতীক)৷’’
‘‘নৌ কমান্ডো হিসেবে কারা যোগ দিতে প্রস্তুত?’ প্রশ্ন করতেই অনেকে হাত তুলে৷ কিন্তু তারা বেছে নিলো যাদের বাড়ি চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায়৷’’
মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল- সাঁতার জানতে হবে, বিদেশিরা ট্রেনিং দেবেন, তাই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হতে হবে৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে ৭০-৮০ জনকে বাছাই করা হয়৷ এরপরই জানানো হয়, ‘‘এটা হবে সুইসাইডাল স্কোয়াড৷”
‘‘অনেকেই তখন সরে যান৷ তারপর ফিটনেস দেখে সিলেকশন করা হয় ৩০-৩২জনকে৷ এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে সর্বমোট ৩০০জন সিলেক্ট করা হয়৷ ধর্মনগর হয়ে ট্রেনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের মুর্শিদাবাদে৷’’
‘‘ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল পলাশীতে, ভাগিরথী নদীর তীরে৷ ১৪ মে তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হয়৷ উল্টো বা চিত হয়ে সাঁতার কাটা, পায়ে ফিনস পড়ে শুধু চোখ-নাক ভাসিয়ে পানিতে মাছ বা সাপের মতো নিঃশব্দে চলা, অপারেশনে পাহারাদারদের মারতে জুডো-কেরাতে ট্রেনিং, দিক চেনার জন্য ম্যাপ রিডিং, মাইন বিস্ফোরণ প্রভৃতি৷ একেকটা মাইনের ওজন ছিল ৫ থেকে ৬ কেজি৷ অপারেশনে সেগুলোই জাহাজে ফিট করে উড়াতে হবে৷ বুকে দুই-তিনটা ইট বেঁধে সে কৌশলই শেখানো হয় ভাগিরথী নদীর জলে৷প্রতিদিন ১৮ঘন্টা ট্রেনিং হতো, তা চলে ৩১ জুলাই পর্যন্ত৷ ভারতীয় নৌ-বাহিনীর কমান্ডার এমএন সামন্ত, লে. কমান্ডার জিএম মার্টিস, লে. কপিল, কে সিং ও ক্যাপ্টেন সমীর কুমার দাশের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং হয় নৌ-কমান্ডোদের৷ ট্রেনিং করান কে এম দাস, ভট্টাচার্য, কফিল, সিসিং, নানাবুজ প্রমুখ৷’’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে জার্মানির ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগে, প্রকাশকাল: ২৬ মে ২০২৩
© 2023, https:.