সেপ্টেম্বর ১৯৭১: আঞ্চলিক বাহিনী, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ ও নারীদের যুদ্ধ
অস্ট্রেলিয়ার হার্ব ফিথ ছিলেন মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। এবিসির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ‘রেডিও অস্ট্রেলিয়া’ই প্রথম বিদেশি মিডিয়া, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাসহ গণহত্যার নানা খবর প্রচারিত হতো। সে খবরগুলোই স্পর্শ করে হার্ব ফিথ ও তার বন্ধুদের। তারা ফিথকে প্রধান করে গঠন করে ‘ভিক্টোরিয়ান কমিটি টু সাপোর্ট বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন। এর সদস্যরা বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য লিফলেট, পোস্টার ও সেমিনারের মাধ্যমে প্রচার করে এবং বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে চাপ দিতে থাকে। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে `Asia’s Flashpoint, 1971: Bangladesh’ শিরোনামে একটি বক্তব্যও প্রদান করেন হার্ব ফিথ। সেখানে বাংলাদেশে পঁচিশে মার্চ রাতের গণহত্যাকে ১৫৭২ সালের সেন্ট বার্থোলেমিড গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন নিন্দা জানান তিনি।
এছাড়া ওই সময় বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জনমত গড়ে তুলেছিলেন একদল অ্যাক্টিভিস্ট। গণহত্যার প্রতিবাদে তারা মেলবোর্ন থেকে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শ’ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে প্রতিবাদ
জানিয়েছিলেন। সেই পদযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডেভিড এলিস, মাইক ক্রেমার, ডক্টর অ্যালেক্স রস প্রমুখ।
বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে ও স্বাধীনতার পক্ষে এভাবেই বিদেশের মাটির বিভিন্ন কর্মসূচি বিশ্বজনমত তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল।
এদিকে দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। সুরকার ও সংগীত পরিচালক শহীদ আলতাফ মাহমুদ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর সুরে অনেক দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হয়। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
একাত্তরে তাঁর ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড রাজারবাগের বাসাটি ছিল ঢাকার গেরিলাদের অন্যতম গোপন ক্যাম্প। সেখানে লুকিয়ে রাখা হয় বেশ কিছু অস্ত্র ও গ্রেনেডভর্তি দুটো ট্রাংক।
৩০ আগস্ট ভোরে পাকিস্তানি সেনারা ওই বাসা থেকে আলতাফ মাহমুদসহ তাঁর চার শ্যালক লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহ ও শিল্পী আবুল বারাক আলভীকে আটক করে। অতঃপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলে, মিলিটারি টর্চার সেলে। তাদের ওপর চলে পৈশাচিক নির্যাতন। এরপরও আলতাফ মাহমুদ সবাইকে বাঁচাতে অস্ত্র রাখার সমস্ত দায় নিজের ওপর নিয়ে নেন। ফলে সেপ্টেম্বরের এক তারিখে তিনি ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওইদিনের পর আলতাফ মাহমুদসহ ঢাকার গেরিলা রুমী, আজাদ, বকর, জুয়েল, বদী, হাফিজের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তাদের মেরে ফেলা হয়েছে।(তথ্যসূত্র: একাত্তরের দিনগুলো-জাহানারা ইমাম, আলতাফ মাহমুদ এক ঝড়ের পাখি-মতিউর রহমান)
তিরিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে প্রিয় স্বাধীনতা। সেই রক্তে মিশে আছে আলতাফ মাহমুদের রক্তও।
সেপ্টেম্বর থেকেই পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ বাড়ছিল। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক বাহিনীগুলোও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এসব বাহিনীর মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী, সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জা বাহিনী, ঝিনাইদহের আকবর হোসেন বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, বরিশালের কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী ও গফুর বাহিনী এবং ময়মনসিংহের আফসার বাহিনী ও আফতাব বাহিনী উল্লেখযোগ্য।
কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। ‘বঙ্গবীর’ নামে অধিক পরিচিত এবং একাত্তরে সাহসিকতার জন্য পরে বীরউত্তম খেতাব পাওয়া কাদের সিদ্দিকী ১৮ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আর ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে তৈরি করেন বাহিনীটি।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় ছিল কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর সদর দপ্তর, আন্ধি গ্রামে ছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। এ বাহিনী পরিচালিত হতো সামরিক কায়দায়। সেখানে অর্থ বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ, রেডিও-টেলিফোন-যোগাযোগ বিভাগ, খাদ্য বিভাগ এবং বিচার ও কারা বিভাগও ছিল।
কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা দেশের ভেতরেই প্রশিক্ষণ নেন। গেরিলা যুদ্ধ সাধারণত ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। কিন্তু এ বাহিনী ‘হঠাৎ আঘাত, অবস্থান এবং অগ্রসর’ পদ্ধতি অনুসরণ করে গেরিলা যুদ্ধের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। টাঙ্গাইলের পাশাপাশি ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় অসংখ্য অপারেশন পরিচালনা করে এ বাহিনীটি। (তথ্যসূত্র: স্বাধীনতা’৭১-বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম)
পাকিস্তানি সেনাদের ওপর এয়ার অ্যাটাকের জন্য ট্রেনিংয়ের পরিকল্পনা করে মুজিবনগর সরকার। ২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর ডিপুটি চিফ অফ স্টাফ এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ৯ জন পাইলট ও ৪৭ জন গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের সমন্বয়ে গঠন করা হয় মুক্তিবাহিনীর এয়ার উইং, যা ‘কিলো ফ্লাইট গ্রুপ’ নামে অধিক পরিচিত।
ভারত সরকার যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশকে ৩টি বিমান দিলে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে ভারতীয় প্রশিক্ষক স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ট্রেনিং।
কিলো ফ্লাইট গ্রুপে যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী বীরপ্রতীক।
ওই ট্রেনিং সম্পর্কে তিনি ধারণা দিয়েছেন এভাবে, ‘‘আমি তখন আগরতলায়, হোল্ডিং ক্যাম্পে। সঙ্গে খন্দকার আর সার্জেন্ট মনির। ক্যাম্প থেকেই বাছাই করে নেওয়া হয় আমাদের। অতঃপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ডিমাপুরে, আসামের নাগাল্যান্ডে। চারিদিকে পাহাড়। মাঝখানে একটি ব্রিটিশ আমলের রানওয়ে। সেখানেই কয়েক মাস চলে ট্রেনিং।”
যুদ্ধে ব্যবহৃত বিমানগুলো নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন এভাবে, ‘আমাদের একটা এলইউট আর ছিল একটা অর্টার। এলইউট হলো হেলিকপ্টার। আর অর্টার হচ্ছে বিমান। একটি বিমানে রকেট, বোমবিং, গানারিং—এই তিনটা সেট করা থাকত। আমি ছিলাম এয়ার গানার। বিমানবাহিনীর তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শামসুল আলম বীরউত্তম ছিলেন পাইলট। কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম। আমি এয়ার গানার আর সার্জেন্ট হক ছিলেন বোম ড্রপিংয়ের দায়িত্বে।
ট্রেনিংয়ের সময় পাহাড়ের মধ্যে আমাদের টার্গেট দেওয়া হতো। সেটি ধ্বংস করতাম। এলইউট বা হেলিকপ্টারের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ আর ফ্লাইট লেফটেনেন্ট বদরুল আলম। আরেকটা বিমান ছিল ডাকোটা। সেটার পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেক। সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন ও আব্দুল মুহিতও। সবাই ছিলাম সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। এ কিলো ফ্লাইট গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন সুলতান মাহমুদ।’
এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র্র হাতে রনাঙ্গণে যুদ্ধ করেছেন কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা প্রমুখ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্পটি শুধুমাত্র
নারীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যই চালু করা হয়। ওই ক্যাম্পটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী। সেখানে সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষক ছিলেন শিপ্রা সরকার ও সেবা চৌধুরী। নার্সিং শেখাতেন ডা. মীরালার ও ডা. দেবী ঘোষ। অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ শেখাতেন ক্যাপ্টেন এস এম তারেক ও মেজর জয়দীপ সিং।
সেপ্টেম্বরে শুরু হয় নয় নম্বর সেক্টরে নারীদের একটি গ্রুপের ট্রেনিং। বরিশালের গৌরনদীর গৈইলা গ্রাম থেকে এসে ট্রেনিংয়ে অংশ নেন রমা রানী দাস।
কীভাবে যুক্ত হলেন তিনি?
রমা রানী দাস যেভাবে বলেছেন, “এক মাসিকে সঙ্গে নিয়ে যাই নয় নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার, হাসনাবাদে। বাস থেকে নামতেই দেখা হয় ক্যাপ্টেন বেগের সঙ্গে। ঝালকাঠির ভীমরুলির পেয়ারা বাগানে যিনি আগেই অস্ত্র চালানো শিখিয়েছিলেন। উনি সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখে মেজর জলিল খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘আরও বিশ-পঁচিশটা মেয়ে আছে। এই গ্রুপটির দায়িত্ব আপনি নেন।’ তখনই রাজি হয়ে গেলাম। ক্যাম্পের ভেতর এক বাড়ির দোতলাতে থাকতাম। নিচে সেন্ট্রি থাকত। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারত না। শুধু সেক্টর কমান্ডার পনের দিন পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যেতেন।”
আরো কয়েকজন নারী যোদ্ধার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিথিকা বিশ্বাস, হাসি, মিনতি, কনক প্রভা মণ্ডল, সমিরন, হরিমন বিশ্বাস, রুনু দাস প্রমুখ ছিলেন।ট্রেনিং চলে টাকিতে, ইছামতি নদীর পাড়ে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের সুবেদার মেজর মাজেদুল হক সাহেব ছিলেন ট্রেনার। রাইফেল, গ্রেনেড, অ্যাক্সপ্লোসিভ, স্পাইং– এগুলো ছিল ট্রেনিংয়ের মূল বিষয়।’
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ কী ছিল?
‘স্পাইং করা ছিল মূল কাজ। নানা খবর নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে যেতাম। সাতক্ষীরা, ভোমরা, আশাশুনিতে যারা আওয়ামী লীগার ছিলেন তাদের ওখানে যেতাম ছদ্মবেশে। পথে পাঞ্জাবীদের গতিবিধি, কোন রাস্তায় তারা থাকে, কীভাবে থাকে, কয়জন গাড়ি
থামিয়ে সার্চ করে, কি অস্ত্র, কয়টা অস্ত্র আছে– এমন খবর নিয়ে হেডকোয়ার্টারে দিতাম।’
মুক্তিযুদ্ধে বীরনারীদের ইতিহাস উপেক্ষিত বলে আক্ষেপও প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা রমা।অকপটে বলেন– ‘সমাজ তখন বিশ্বাসই করেনি নারীরা যুদ্ধ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে কনক প্রভা মণ্ডল। এ কারণে সমাজ তাকে পরিত্যাগ করেছিল। নারী হওয়ায় পাছে লোকেরা তাকে চরিত্রহীন বলবে। তাই ডিসচার্জ লেটারটাও স্বামী ছিড়ে ফেলে। এ কারণে আজ পর্যন্ত কনক মুক্তিযোদ্ধার সনদও পায়নি।’
একাত্তরে ট্রেনিংয়ের কথা বলেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। বড় ভাই ও এগার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল তাহেরের(তখন মেজর ছিলেন)হাত ধরেই যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে।
তার ভাষায়, “আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মাহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে। সঙ্গে ট্রেনিং করেছেন ব্যারিস্টার শওকত আলী এমএনএ।এক সপ্তাহের মতো ট্রেনিং চলে। প্রথম শিখানো হলো কী করে ক্রলিং করে যেতে হয়। সবচেয়ে ছোট অস্ত্র ছিল এসএমসি।নিশানা আমার খুব ভাল ছিল। সবাই বলতো– ‘বাহ! টার্গেট তো ভাল’। এমএমজি সেট করেও চালানো শিখেছি। তবে রাইফেলগুলোতে খুব ধাক্কা খেতাম। ট্রেন্ড মুক্তিযোদ্ধা ও ইন্ডিয়ান কিছু অফিসার ট্রেনিং করায়। একটা মেয়ে ট্রেনিং নিতে এসেছে– এটা দেখতেই আসত অনেকেই।”
একাত্তরে নারীদের অবদান প্রসঙ্গে এই বীর অকপটে বলেন– ‘একাত্তরে নারীরা যে কত রকমভাবে সাহায্য করেছে চিন্তা করা যাবে না। আম্মা রাতভর রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিতেন। এরকম সাহায্য তো ঘরে ঘরে মা-বোনেরা করেছেন। দেশ থেকে সবাইতো যুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু মায়েরা, বোনেরা এই অবরুদ্ধ বাংলায় চরম নিরাশ্রয় অবস্থায় ছিল। হানাদারদের কাছ থেকে নিজেদের ও শিশুদের বাঁচানোটাই ছিল তখন আরেকটা যুদ্ধ। সে ইতিহাসের কথা কিন্তু তেমন তুলে ধরা হয়নি। নারী মুক্তিযোদ্ধার আলাদা করে কোন লিস্ট করা হয়নি। অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাও এটাকে বড় করে দেখতে চায় না।একাত্তরের নারীদের নিয়ে গবেষণাও কম হয়েছে।এই কাজগুলো না হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হবে না।’
এছাড়া ভারতের শরনার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন অসংখ্য নারী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবেও অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। অনেকেই গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে তা জমা দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে।
আবার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও নানা খবর দিয়ে স্বাধীনতাকে তরান্বিতও করেছিলেন নারীরা।রণাঙ্গনে বিশেষ ভূমিকার জন্য তারামন বিবি ও ডাক্তার সিতারা বেগম বীরপ্রতীক খেতাব লাভ করেছেন। যা একাত্তরে নারীদের সাহসী ভূমিকাকেই স্পষ্ট করে।
ওই সময়ে নয় নম্বর সেক্টরে গঠন করা হয় কিশোরদের একটি গ্রুপও।এ নিয়ে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের সঙ্গে। একাত্তরে শমসেরনগর সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তিনি।
তাঁর ভাষায়, ‘তাদের বয়স ছিল ১১-১৪ বছরের মতো। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশালের কিশোররা ছিল সংখ্যায় চল্লিশের মতো। গ্রুপটির নাম দিই ‘হার্ড কর্পস অব সার্জেন্টস’। আসলে ওরা বিচ্ছুবাহিনী। ওদের এসএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেডের ওপর ট্রেনিং দেওয়া হয়। নৌকা চালানোর ওপর ছিল বিশেষ ট্রেনিং। ওদের মূল কাজ ছিল অ্যামুনেশন ক্যারি, ইন্টেলিজেন্সের কাজ করা। ওরা গল্প বলে আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করত। পরে ক্যাম্পে ঢুকে ওদের ঠ্যাং টিপে ফিরে এসে বয়ান করত ক্যাম্পের কোথায় কী আছে। তাদের কাজে ঝুঁকি ছিল অনেক। যেখানে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারাও যেতে চাইত না, সেখানে ওরা বলত, ‘স্যার, আমি যাব।’
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের যুদ্ধটা কেমন ছিল?
এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে ছয় নম্বর সেক্টরের চিলাহাটি সাবসেক্টরের কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদের কাছে। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অকপটে তিনি বলেন, ‘এ নয় মাসে যারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন, তাদের কথাই কেউ বলি না। যারা সৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আমাদেরকে পাকিস্তানি সেনারা অ্যাটাক করলে ইন্ডিয়াতে সরে যেতে পারতাম। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা গ্রাম বা শহরে ছিলেন তারা কোথায় যাবে? তারাই সরাসরি ওদের অত্যাচার ফেইস করেছে। গ্রামে
মুক্তিযোদ্ধা আসছে এই অপরাধে গ্রামের বাড়িগুলো ওরা জ্বালিয়ে দিত। এভাবে নির্যাতিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ।
চিলাহাটি থেকে যখন দুটো কোম্পানি নিয়ে মার্চ করি, রাস্তায় দেখি শত শত লোক মুড়ি আর গুড় হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক জায়গায় অচেনা লোকেরাই রান্না করে খাবার দিয়েছেন। এটা যে কত বছর সাপোর্ট আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন এবং অ্যামুনেশন ক্যারি করার জন্য লোক লাগত। গ্রামের মানুষই ভলান্টিয়ার করেছে। সৈয়দপুরে ধরে ধরে বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, রংপুরের অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে, বুড়িমারীতে রেইপ করে মেরে ফেলা হয় বহু নারীকে।’
তিনি আক্ষেপ নিয়ে আরও বলেন, “পাকিস্তানি আর্মিরা কোথায় লুকিয়ে আছে তা আগেই এসে আমাদের বলে যেত সাধারণ মানুষ। কারণ তারা আমাদের সাথে ছিলেন। পাকিস্তানি আর্মিই বলেছে- ‘যেদিকে দেখি সেদিকেই শত্রু। উই ক্যান নট ট্রাস্ট আ সিঙ্গেল বেঙ্গলি।’ তারা তো কোনো অংশেই কম ছিল না। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সাথে ছিলেন না। বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল এটা। তাই একাত্তরে সবচেয়ে বড় কন্ট্রিবিউশন ছিল সাধারণ মানুষের। উই মাস্ট স্যালুট দেম।”
মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। সেপ্টেম্বর থেকেই মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ, সাহসী নারী ও কিশোরদের ঐক্যবদ্ধ আক্রমণেই দিশেহারা হতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা৷
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে, প্রকাশকাল: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
© 2024, https:.