কলাম

৩২ নম্বরে যা দেখেছিলেন ইকবাল রশীদ

বাড়িতে ঢুকে সিঁড়িতেই দেখলাম বঙ্গবন্ধু পড়ে আছেন গোটা সিঁড়ি রক্তে ভেজা বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে অবাক হই তখন ওরা সত্যিই বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেললো!

যাঁর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধুকেই যখন ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হল, ঢাকা তখন এক অস্থির নগরী। ওইদিন সকালে ইকবাল রশীদ গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে। সেখানে কী দেখেছিলেন তিনি? আলাপচারিতার শুরুতেই উঠে আসে সে প্রসঙ্গ। খুব বেশি দেখার সুযোগ পাননি তিনি। কেননা, বাড়িটি তখনও ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়ন্ত্রণে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট ইকবাল রশীদ। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলট অফিসার ছিলেন। একাত্তরে করাচি থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ছয় নম্বর সেক্টরের চিলাহাটি সাবসেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তিনি।

সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবছিলেন, তাদেরই একটি অংশ ৩ নভেম্বর ভোরে ঘটনাপ্রবাহের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। বিমান বাহিনীর অফিসারদের একটি অংশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেখানে। এয়ারফোর্স থেকে সেদিন হেলিকপ্টার সার্পোট গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট ইকবাল রশীদ। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অন্যতম এই অফিসারকে ৭ নভেম্বরের পর কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয়, ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টে’ তাঁকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন। পরে কারাগার থেকে মুক্তি মিললেও চাকরি ফেরত পাননি, দেওয়া হয়নি তাঁর প্রাপ্য সুবিধাও।

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ইকবাল রশীদ প্রথমে এপিএম (অ্যাসিস্টেন্ট প্রভোস্ট মার্শাল) হিসেবে যোগ দেন। ইংল্যান্ডের রানি সে সময় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে দুটো হেলিকপ্টার উপহার দেন। ওই দুটোর ওপর প্রশিক্ষণ নিতে ১৯৭৩ সালে তিনিসহ এবিএম বাশার, উইং কমান্ডার মঞ্জুর, এয়ার কমোডর শমসের আলী চলে যান ইংল্যান্ডে। ফিরে এসে এপিএম পদে আর থাকেননি, ফ্লাইং করা শুরু করেন। ইকবাল রশীদ মূলত ছিলেন হেলিকপ্টার পাইলট।

১৫ আগস্টের কথা বলছেন ইকবাল রশীদ

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ইকবাল রশীদ গত সেপ্টেম্বর মাসে এসেছিলেন ঢাকাতে। মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষণা কাজের অংশ হিসেবে দুই দফায় তার মুখোমুখি হই। একাত্তর ও একাত্তর-পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহ উঠে আসে তাঁর আলাপচারিতায়।

আলাপচারিতার শুরুতেই তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ডিফেন্সের ভেতরে থেকে এই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে আগে থেকে কি কিছু অনুমান করতে পেরেছিলেন কিনা? প্রশ্নের উত্তরে ইকবাল রশীদ অকপটে বলেন, ‘একেবারেই না। বঙ্গবন্ধুকে টাচ করবে কে? এটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে আমরা আলোচনা করতাম যে তার সিকিউরিটি প্রোপার ছিল না।’

হত্যাকাণ্ডের দিনের ঘটনা তিনি তুলে ধরেন এভাবে, ‘ওইদিন কোয়ার্টারেই ছিলাম, ২১ নম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। পোস্টঅফিসের উল্টো দিকের বাড়ি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আমাদের সবাইকে তেজগাঁওয়ে এয়ারফোর্সের অফিসার্স মেসে যেতে বলা হয়। সবাই গেলাম। তখনও জানি না কী ঘটেছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। এয়ার চিফ তখন এ কে খন্দকার; তিনিও নিশ্চিত নন কী ঘটেছে।

এয়ার চিফ আমাকে বললেন, ‘ইকবাল, তুমি গিয়ে দেখে এসো ৩২ নম্বরে সত্যি সত্যি কী ঘটেছে।’ আমি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফরিদুজ্জামান আর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম একটা গাড়িতে করে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই।

আমাদের প্রথমে ঢুকতে দিল না। প্রবেশ দ্বারেই আটকালো। এক অফিসার বলল, ‘স্যার আপনারা যেতে পারবেন না। উই হ্যাভ ফিনিশড দ্য জব।’

বললাম, ‘হোয়াট জব! আই ওয়ান্ট টু গো ইনসাইড।’

সে বলে, ‘নো নো, ইউ কান্ট গো।’

ভেতরে দেখলাম ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারকে (সুলতান শাহরিয়ার রশিদ। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী)। একাত্তরে সে আমাদের সেক্টরেই যুদ্ধ করেছিল। সে কারণে পূর্ব পরিচিত। দূর থেকে তাকে হাত দিয়ে ইশারা করতেই বললো, ‘আসতে দাও।’

কী দেখলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে? প্রশ্ন শুনে ইকবাল রশীদ খানিক নীরব হয়ে যান। অতঃপর বলেন, ‘বাড়িতে ঢুকে সিঁড়িতেই দেখলাম বঙ্গবন্ধু পড়ে আছেন। গোটা সিঁড়ি রক্তে ভেজা। বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে। অবাক হই তখন। ওরা সত্যিই বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেললো! উপর তলায় বেগম মুজিবের রুমটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ছিল। লাশও পড়ে ছিল কয়েকটা। এত সাধারণ একজন প্রাইম মিনিস্টারের (বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রপতি) রুম! ফার্নিচার এত সিম্পল, ভাবাই যায় না।

তখনই তারা (খুনিরা) সব ফটোগ্রাফ করে ফেলছে।এক দেড় ঘণ্টার ভেতর ছবি তুলে প্রিন্ট করে রেখে দিয়েছে। শাহরিয়ারকে বললাম, এগুলো কী করবা? বলে, ‘রেকর্ড রাখব।’

আমরা বেশিক্ষণ থাকলাম না। তাড়াতাড়ি মেসে ফিরে খন্দকার সাহেবকে (এ কে খন্দকার) বললাম, স্যার সব শেষ।’

ডিফেন্সে যারা ছিলেন তাদের পক্ষে কি কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল? ইকবাল রশীদের ভাষ্য এমন— একেবারেই না। কিছু করার মত পরিস্থিতিও ছিল না। ওরা মিগ আর হেলিকপ্টারের দিকে ট্যাংক ফিট করে গোলাবারুদ আটকে রেখেছিল।’

এরপর কী করলেন ইকবাল রশীদ? তাঁর ভাষায়, ‘আমরা ফিরে এলে এয়ার চিফ বঙ্গভবনে যান এবং মোশতাককে সম্মতি জানান। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিডিআর ও এয়ারফোর্স সবার শেষে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। জাতির পিতার হত্যা এবং খন্দকার মোশতাক সরকারকে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল আমাদের পক্ষে। যাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করলাম, তাঁকেই স্বাধীন দেশে হত্যা করা হল। মনে মনে প্রতিশোধের কথাও ভাবতে থাকি। কিন্তু এরপরই অবাক হয়ে দেখি বেঈমান নেতাদের কীর্তি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাই মোশতাককে স্বীকৃতি দেয়।

সবকিছু দেখেও নরমাল থাকি। কিন্তু মনটা খুবই খারাপ থাকত। এদিকে অনেক পাকিস্তানফেরত অফিসার খুবই খুশি হয়। মস্কোতে এয়ারফোর্সের একটা গ্রুপ ছিল ট্রেইনিংয়ে। শুনেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তারা সেলিব্রেটও করেছিল।’

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ‘সমমনাদের নিয়ে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করবো তেমন পরিস্থিতিও প্রথম দিকে ছিল না। নীলফামারীতে আওয়ামী লীগ নেতা বন্ধু সোলেমান, ইয়াকুব প্রমুখের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। টাকা-পয়সা দেওয়াসহ নানাভাবে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ওই সময়টায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে এসেছিল। এছাড়া এয়ারফোর্সে নিজেদের ভেতর গোপনে নানা আলোচনা করতাম। আর ভেতরে ভেতরে প্রতিশোধের প্ল্যাটফর্ম খুঁজতে থাকতাম। সেই প্রতিশোধের প্রস্তাব আসে পরে, সেপ্টেম্বর মাসে। সেটি আরেক ইতিহাস।’

জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে যতটা গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ছিল ততটা হয়নি বলে মনে করেন ইকবাল রশীদ। এমন হত্যাকাণ্ডের পরও কেন আর্মি চুপ ছিল? সেটি নিয়ে নিজের মত তিনি তুলে ধরেন অকপটে, ঠিক এভাবে— ‘দেখুন, একটা আর্মি ফর্ম করতে একটু ম্যাচিউরিটি লাগে। আমাদের সেটা ছিল না। তখন সিনিয়র মোস্ট অফিসার অধিকাংশই ছিলেন মেজর। নিজেদের ভেতর কোন্দল আর অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল প্রবল। রিপ্যাট্রিয়েটেড হয়ে পাকিস্তানফেরত অফিসাররা আসার পর এটা আরও বেড়ে যায়। এছাড়া প্রত্যাবর্তনকারী অফিসারদের মধ্যে পাকিস্তান সরকার কিছু কিছু অফিসারকে রিক্রুটও করে থাকতে পারে। এটা ন্যাচারাল। এসব কারণেই দেখেন ১৫ অগাস্টে আর্মি চুপ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাটা যারা করেছে, তারা এত পরিকল্পিতভাবে করেছে যে, এটা ইসরায়েল বা সিআইএয়ে হেল্প ছাড়া করতে পারার কথা নয়। পৃথিবীতে এমন রুথলেস কিলিং খুব কমই হয়েছে। তাই আমি বলব বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এই হত্যা ছিল দেশের জন্য কলঙ্ক ও অপমানজনক অধ্যায়।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৫ আগস্ট ২০২৩

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button