দেশের জন্য শুধু গান বাঁধাই নয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে কড়া পাড়া থেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন সাতান কড়া ও থোপাল কড়া।
সুনিয়া কড়ার গল্প শেষ। তবুও তার রক্ষা নেই। কড়া পাড়ার শিশুরা তাকে ছাড়ছে না। আরো গল্প শোনার আবদার সবার। না-সূচক জবাবেও কাজ হয় না। হৈ চৈ দেখে সুনিয়ার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। যেন এটাই তিনি চাচ্ছিলেন।
রাত তখন ৮টার মতো। পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আকাশে। স্নিগ্ধ মায়াবী চাঁদের আলোতে চলে মুখ দেখাদেখি। চাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝোপঝাড়ে জোনাকি পোকার ওড়াউড়িও চলে। রাতের আঁধারে দিনাজপুরের হালজায় এসে এমন দৃশ্য দেখব- ভাবতেই পারিনি।
কড়া আদিবাসীদের পাড়ায় চলছে আনন্দ আড্ডা, সুনিয়ার বাড়ির উঠোনে। চাঁদের আলোতে বসা আবাল-বৃদ্ধ সব আদিবাসী। এখানকার আদিবাসী গ্রামগুলোতে এমন আড্ডা আর গানের আসর চলে প্রায় রাতেই। বিশেষ করে পূজার সময়টা যত ঘনায় নাচগান আর আনন্দ আসর ততই বাড়তে থাকে। আদিবাসীদের গল্প-গানের আসরের ভালো লাগা সত্যি অন্যরকম। মনে হচ্ছিল যেন চলে এসেছি কোনো সুখি মানুষের দেশে।
প্রতিদিন প্রতি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো না-বোধক সংবাদ আমাদের অস্থির করে তুলে। না পাওয়ার বেদনা ক্রমেই গ্রাস করে নিচ্ছে আনন্দ-হাসিগুলোকে। কিন্তু আদিবাসী গ্রামগুলোতে ঠিক উল্টো দৃশ্য। দিনমজুরের কাজ করে যা পায় তা দিয়েই তাদের দু’বেলা চলে কোনোরকমে। কিন্তু তাতেই তারা তুষ্ট। অবহেলা আর বৈষম্যের কষাঘাতেও হারিয়ে যায় না আনন্দগুলো। রাতে যখন তারা আনন্দ আড্ডায় মেতে ওঠে তখন উবে যায় সব দুঃখ-কষ্ট।
এভাবে একেকটা রাত তাদের একেকটি দিনের মানসিক শক্তি জোগায়। না পাওয়ার ভিড়েও সুখকে ঠিকই খুঁজে নেয় তারা। হয়ত এ কারণেই যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা সুখ খুঁজতে ছুটে গিয়েছেন আদিবাসী গ্রামগুলোতে। গল্পের আসরে হঠাৎ মাদলের শব্দ। বেজেই যেন থেমে যায়। গল্প বিরতিতে সুনিয়া গান ধরেন। পাশে বসা কয়েকজন নারী সুনিয়ার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়।
গান থামতেই হাসির রোল পড়ে যায়। বসা থেকে দাঁড়িয়ে হঠাৎ নাচতে থাকে কয়েকজন। মাদলের তালে চলে তাদের কণ্ঠগুলোও। হাত ধরাধরি করে নাচতে থাকে যুবতি বয়সী বাবলী কড়া, বিজলী কড়া আর নব্বই বছর বয়সী সেড়তি কড়া। কড়া ভাষার গানটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় গোত্রপ্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া। জগেন জানান, গানটির বিষয়ে নানা তথ্য।
কড়া আদিবাসীদের বিয়েতে চলে নানা আচার। এমনই একটি আচারের কথা শুনি জগেন কড়ার মুখে। এ আদিবাসী মেয়ে বা ছেলের বিয়ে পাকাপাকি হলে নিজ নিজ বাড়িতে পালন করতে হয় এই আচারটি। কড়া ভাষায় একে বলে ‘লাগান বেনদিয়া’। বিয়েতে হলুদ দেওয়াকে কড়ারা বলে ‘তেল হারদি’। তেল হারদি হয় বিয়ের দুইদিন আগে। তেল হারদির একদিন আগে করতে হয় লাগান বেনদিয়া পর্বটি। ওইদিন ছেলে বা মেয়ের বাবা, মা, দাদা, দাদি ও আত্মীয়রা বিশেষ ধরনের গান গেয়ে আশীর্বাদ করে ছেলে বা মেয়েকে। সুনিয়া গাইছিলেন সেই গানটিই। কড়া ভাষায় গানটি: ‘বাবা, লাগানা বেনদিয়া/ নানে সুতে লাগানা বেনদিয়া, বাবা/ লাগানা চুমরিয়া বাপা/ বাপা লাগানা চুমরিয়া/ কাকা লাগানা চুমরিয়া…’।
কড়া ভাষায় বাবাকে বলে ‘দাদা’। চুমরিয়া অর্থ আশীর্বাদ। বাপা অর্থ বাবা। জগেন জানালেন, লাগান বেনদিয়ার দিনে এই গানটি গেয়ে গেয়ে একে একে নিকট আত্মীয়রা মেয়ের চুলে আর ছেলের হাতে তাঘি (কাইতন) বেঁধে আশীর্বাদ করে। কড়াদের পূর্বপুরুষদের রীতিমতে এই তাঘি বিয়ের দিনের আগে খোলা যায় না। তাই এভাবে মেয়ের চুলে ও ছেলের হাতে তাঘি দেখলেই অন্য কড়ারা বুঝতে পারে তার বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে।
আমাদের কথার ফাঁকেই সেড়তি কড়া কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে শুরু করে আরেকটি গান। জগেন জানালেন, এই গানটির কথা ও সুর গোত্রের সুনিয়া কড়ার নিজের। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুখে মুখেই তিনি গানটি রচনা করেছেন। যুদ্ধের আগে শেখ মুজিব বন্ধু ভেবে বহুবার গিয়েছিলেন ভারতে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। বন্ধুত্বের কারণেই যুদ্ধের সময় ভারত সরকার সাহায্য করে বাংলাদেশকে। গানটিতে আদিবাসী কড়ারা একে ‘ভিক্ষা’ হিসেবে উল্লেখ করে। এছাড়া শাসন বলতে তারা বোঝায় শাস্তিকে। সেই সময় আদিবাসীদের নানা অনুষ্ঠানে কড়ারা এ গান গেয়ে সবাইকে দেশ ত্যাগে নিরুৎসাহিত করত। সেড়তির কণ্ঠে শোনা গানটি: ‘টেংরা মাছের তিনটি কাঁটা/ বোয়েল মাছের দাড়ি/ শেখ মুজিব ভিক্ষা করে ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি/ বাঙাল ফিরো ফিরো গো/ পাকিস্তানের শাসন হয়েছে/ বাঙাল ফিরো ফিরো গো।’
দেশের জন্য শুধু গান বাঁধাই নয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে কড়া পাড়া থেকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন সাতান কড়া ও থোপাল কড়া। কিন্তু স্বাধীনের পর থেকে বদলাতে থাকে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের চিত্র। তখন তারা দিনমজুরী করতেন। পাননি মুক্তিযুদ্ধের কোনো কাগুজে সনদ। মেলেনি কোনো সম্মানও। ফলে সাতান এবং থোপালের মন থেকে ক্রমেই হারিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো।
সেড়তির গানের শেষেই সবাই নীরব থাকে। এরপর কে গান ধরবে? এই নিয়ে চলে চাপাচাপি। সুনিয়ার দিকে সবার চোখ স্থির হয়। সুনিয়াও প্রস্তুতি নেন। জগেন জানালেন, কড়াদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে। অন্যান্য জাতির মতো এদের জীবন আর সংস্কৃতির সঙ্গেও মিশে আছে মহাজন, পুলিশ আর দারোগাদের অত্যাচারের স্মৃতি। তাই তাদের অনেক গান ও লোককথায় প্রকাশ পায় সেই সময়কার বঞ্চনাগুলো। এমনি একটি গান ধরেন সুনিয়া।
কড়া ভাষায় গানটি: ‘শুন এলু বোট সে/ ঘুরি এলু কোট সে/ চাল ধেনি জাল দি সাপার/ দারগা পুলিশ সবশে উপার/ চাল ধেনি জাল দি সাপার/ বাংলাদেশ মে নাখলো বিচার/ চাল ধেনি জাল দি সাপার।’ গানটির ভাবার্থ: জমিদারের কাছে বিচার চাইতে গিয়ে তা মিলল না, বিচার মিলল না কোর্টে গিয়েও, এদেশে সবার উপরে দারোগা, পুলিশ। তাই ছোট বাচ্চাদের বলা হচ্ছে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, এদেশে থাকা যাবে না। এদেশে বিচার নেই।
জগেন জানান, কয়েক মাস পরই কড়াদের কারমা পূজা। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা চাঁদে আয়োজন চলে পূজাটি। কড়ারা এই পূজায় বন থেকে কেটে আনে খিল কদম গাছের ডাল। সেটিকে মাটিতে পুঁতে তারা পূজা করে রাতের বেলায়। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই আদিবাসীরা মেতে ওঠে নাচগান আর আনন্দ-উল্লাসে। পূজা শেষে কড়াদের নাচগান শুরু হয় পূর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে। বিশেষ এক গানের মধ্য দিয়ে। জগেনের অনুরোধে দরদী কণ্ঠে সে গানটি গায় বাবলী কড়া।
কড়া ভাষায় গানটি: ‘বন্দোনা বান্দ সাজানি/ বান্দি দিয়া চারিও কোন বন্দোনা বান্দ সাজানি/ বান্দি দিয়া আখারে হামার/ বান্দি দিয়া রেস্কা পেলেনি/ বান্দি দিয়া আখারে হামার।’ জগেন বলেন, কড়া ভাষায় ‘বান্দোনা’ শব্দের অর্থ শুরু করা। ‘আখারে’ অর্থ পূজার আসর। যারা মাদল বাজায় কড়ারা তাদের বলে ‘রেস্কা’। যারা নাচে তারা হচ্ছে ‘পেলেনি’। সে হিসেবে গানটির ভাবার্থ: শুরু কর চারপাশ সাজানো। বেঁধে দেও পূজার আসর। মাদল বাদক ও নাচের মেয়েরা বেঁধে দিয়েছে চারপাশ।
বাবলীর গান শেষ হতেই সুনিয়ার কণ্ঠে চলে কারমা পূজার অন্য একটি গান। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও কণ্ঠ মেলায়। কড়া ভাষায় গানটি: ‘সব গাতনি পিন্দ লাল লুগা/ নতুন নতুন সুপ দিয়া/ নতুন পারবেতি/ আজো কারমাকের রাতি’। গানটি আমাদের বুঝিয়ে দেন জগেন। কড়া ভাষায় ভাবীরা ননদকে ডাকে ‘গতনি’ বলে। ‘লাল লুগা’ মানে লাল শাড়ি। সুপ অর্থ ‘কুলা’। দিয়া অর্থ ‘প্রদীপ’। আর ‘পারবেতি’ অর্থ উপোসকারী। সে হিসেবে গানটির ভাবার্থ: ননদরা লাল শাড়ি পরে নেও। নতুন কুলায় প্রদীপ নিয়ে তৈরি হয়ে নাও নতুন উপোসকারীরা। আজ পূজা করতে হবে। আজ কারমা পূজার রাত।
মাহাতো জানালেন, কারমাপূজার জন্য খিল কদম গাছের ডাল কাটতে হয় বিশেষ নিয়ম মেনে। তেলের পিঠা গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে এক কোপে কাটতে হয় খিল কদমের ডালটি। কড়াদের কারমাপূজার গানেই পাওয়া যায় সে রীতিটি। এ পূজার সময় ঘনিয়ে এলেই আদিবাসী কড়ারা এই গানটি গাইতে থাকে। কথায় কথায় সুনিয়া কড়া গান সেই গানটি। কড়া ভাষায় গানটি: ‘আন দিনে কারাম গোসায়/ শির বিন্দা বন/ আজো কারাম গোসায়/ মাছ কুলি এলে/ রুটি পিঠা খেলে/ খিরা উখরি খেলে’। ভাবার্থ: চল কারাম ডাল কাটতে যাই বিন্দাবনে। আজকেই পূজা হবে। বছরের মাঝামাঝি এখন। তেলের পিঠা ঝুলিয়ে। এক কোপে কেটে আনি।
কড়াপাড়ায় এভাবে একে একে চলে নাচ-গানের আসর। বিরামহীন চলে মাদলের শব্দ। জগেনের কাছ থেকে বিদায় নিই আমরা। ভ্যানে চেপে ফিরতে থাকি আপন পথে। আকাশে হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ, তা ঢেকে দেয় চাঁদটিকে। তখন চারপাশে নামে অন্ধকার। মাদলের শব্দও যায় বেড়ে। খানিক পরেই আবারও মায়াবী চাঁদের আলোকচ্ছটা। মাদলের শব্দে কড়াদের চাপা কষ্টগুলোর মতোই যেন সরে যায় আকাশের মেঘগুলো। চারপাশে তখন শুধুই আলো।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৫ জানুয়ারি ২০২৪
© 2024, https:.