রাষ্ট্র কি শহীদ পরিবারগুলোকে বোঝা মনে করছে
মারা গেলে মানুষ কতটা ভারি হয়, সেদিন বুঝেছিলাম। দুজন মিলেও একটা লাশ তুলতে পারিনি। ২০টির মতো লাশ দূর থেকে এনে স্তূপ করে রেখেছিলাম আমরা। দেখেছি, অনেকের শরীরে গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে ভোগলা হয়ে বেড়িয়ে গেছে।
রাজশাহীর চারঘাট থানাপাড়ায় গণহত্যা নিয়ে কাজ করছি পাঁচ মাস ধরে। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালায় সারদা পুলিশ একাডেমির ভেতরে। এ সময় প্রফেসর ড. জিন্নাতুল আলম জিন্নাকেও হত্যা করা হতো। কিন্তু দৈব্যক্রমেই বেঁচে যান তিনি। পুলিশ একাডেমির সঙ্গেই তার বাড়ি। একাত্তরে তিনি ছিলেন অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। ওই গণহত্যায় খুব কাছ থেকে প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছেন, লাশ টেনেছেন, শহীদদের রক্তে নিজের শরীর ভিজিয়েছিলেন। সেসব কথা তার বুকের ভেতর জমে আছে কষ্টের মেঘ হয়ে। সেই কষ্টের মেঘে বৃষ্টি ঝরাতেই মুখোমুখি হই তার।
রক্তাক্ত ওই দিনটির কথা তিনি বললেন যেভাবে, ‘‘ওইদিন পাকিস্তানি আর্মিরা চারদিক থেকে এমনভাবে আসছিল যে সারদা পুলিশ একাডেমির পদ্মা নদীর দিকটাতেই পালানোর একমাত্র পথ মনে করে সবাই। অনেকেই ভেবেছে সাঁতার দিয়ে ওপারে ইন্ডিয়াতে চলে যাবে। ফলে আশপাশের গ্রামগুলো থেকেও বহু মানুষ আসে। পাশেই ছিল ক্যাডেট কলেজ। সেখানকার লোকজন আর সারদা পুলিশ একাডেমির পুলিশরাও সিভিল ড্রেসে জড়ো হয় সেখানে। আনুমানিক হাজার দুয়েক মানুষ জড়ো হয় ওই চরে।
বেলা তখন দুইটা বা আড়াইটা হবে। এক ক্যাপ্টেনের কমান্ডে পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ একাডেমির ভেতরে ঢুকে। আর্মি দেখে চরের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হয়। ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডের উপর থেকেই উর্দুতে বলে, ‘‘এদার আও, এদার আও। তোমাকো লেকার হামে মিটিং কারেগা। মিটিংকা বাদ তোমকো ছোড় দে গা।’’
প্রথমে সবাইকে একত্রিত করে ওরা। এরপর মহিলা ও ১৩ বছরের নিচের শিশুদের আলাদা করে বলে, ‘‘তোম ঘারকে চলে যাও।’’
তখনই এক বিষাদ ও করুণ দৃশ্য শুরু হয়। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ছেড়ে, একটা বাচ্চা ছেলে কি তার বাবাকে ছেড়ে যেতে পারে? কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিরা ধাক্কা দিয়ে, লাথি মেরে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেয়। লোক কমে তখন থাকে হাজার বা তেরোশ’র মতো।
ওরা মিটিং করল না। সিপাহিরা অস্ত্র তাক করে চারদিক ঘিরে ফেলল। ক্যাপ্টেন তখন অস্ত্র লোড করছে। আমার সঙ্গে ছিল ছোট ভাই শফিকুল আলম পান্না, চাচা আজিজুল আলম, চাচার বড় ছেলে খায়রুল আলম পরাগ, আমার ছোট ভগ্নিপতি মহসীন আলীসহ গ্রামের চেনা মানুষেরা।
জোয়ান মানুষ যারা তাদের ওরা এক এক করে ডাকতে থাকল। প্রথমে উঠাল পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার শামসু ভাইকে। তার ফ্রেন্সকাট দাড়ি, দেখতে খুবই সুন্দর। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পড়া।
বলল, ‘‘তুম জরুর পুলিশ হে।’’
‘‘নেহি স্যার, হাম পুলিশ নেহি হে। বিজনেস করতাহে।’’
ওরা তার হাঁটু ও হাতের কনুই চেক করেই নিশ্চিত হয়।
এরপর বলে, ‘‘তুম জুট বলতাহে।’’
তখনই ওই ক্যাপ্টেন খুব কাছ থেকে শামসু ভাইয়ের হৃদয়কে লক্ষ্য করে গুলি করে। কয়েক হাত উপরে উঠেই সে মাটিতে পড়ে। মুখ দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। দু’এক মিনিট ছটফট করেই তার শরীর নিথর হয়ে যায়।
এরপরই পুলিশ একাডেমির এক স্টেনোগ্রাফারকে উঠায়। নাম তার কাজী গোলাম মোস্তফা। একই প্রশ্ন করে তাকেও গুলি করে মারল। এমনভাবে ১০ থেকে ১৫ জনকে হত্যা করে। ওদের ওয়ারল্যাসে ম্যাসেজ আসছিল বারবার। ফলে ওরা তাড়াহুড়ো করছে।
ওরা আসার আগেই আমি সাঁতার দিয়ে পদ্মা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মাঝখান থেকেই আবার ফেরত আসি। লুঙ্গি পড়া ছিলাম। খালি গা। ইচ্ছে করেই মুখে কাদা মেখে রেখেছি। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুজে বসে আছি।
হঠাৎ ওরা আমাকে ডাক দেয়, ‘‘এই বাচ্চু এদার আও, এদার আও।’’
নিচের দিকে তাকিয়ে না শোনার ভান করি প্রথমে। পাশ থেকে একজন বলে, ‘‘জিন্না তোমাকে ডাকতেছে। ধরেই নিয়েছি মেরে ফেলবে।’’
উর্দু ভাল বুঝতাম, কথাও বলতে পারতাম। ওটাই কাজে লাগাই।
‘‘তোমার নাম কিয়া হে’’
ডাক নাম বলছি, ‘‘জিন্না।’’
‘‘পুরা নাম কিয়া হে’’
‘‘মোহাম্মদ জিন্নাতুল আলম।’’
‘‘কিয়া কারতাহে।’’
‘‘হাম স্টুডেন্ট। ময়মনসিংহ এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিমে পারতাহে।’’
‘‘এহায় কিস লিয়ে আয়া’’
‘‘সেল্টার লিলেকে ওয়াস্তে’’
বলে, ‘‘নেহি শালে তোম ইন্ডিয়া ভাগতা।’’
উর্দুতে অনেক কথা বলার পর ক্যাপ্টেন বলে, ‘‘ঠিক হ্যা তোমকো নেহি মারেগা, তুম এদার বেঠো।’’ আমার সঙ্গে আরও ছয়-সাতজনকেও বসাল। গ্রামের সোলায়মান ভাই ও তোসাদ্দেক নামে এক মুরগীর ব্যবসায়ীও ছিলেন। বাকিরা অপরিচিত।
ওদের ওয়াল্যাসে বার্তা আসছিল। ওপাশ থেকে তাড়া দিচ্ছে। দ্রুত সবাইকে হত্যা করতে তখন ওরা ব্রাশফায়ার করার প্রস্তুতি নেয়। এটা শুরু করে ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। সিপাহিরা শুধু চারপাশে ঘিরে থাকে। ২০ বা ২৫ মিনিট এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় ক্যাপ্টেন। এরপর একজন সিপাহির হাতে ওটা দিতেই সেও ফায়ার শুরু করে। মানুষের রক্তে ভেসে যেতে থাকে গোটা চরের মাটি।
চাচাত ভাই খায়রুল আলম পরাগের কণ্ঠ ওইসময়ই শুনতে পাই। আম্মা বলে একটা চিৎকার দেয় সে। মা তার খুবই প্রিয় ছিল। এরপর আর কোনও সাড়া নেই! বুঝে যাই পরাগ ভাই নেই। ২০-২৫ মিনিট পর গোটা চরটাই নীরব হয়ে যায়।
আমাদের ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে আসে। সেটি বেশ উঁচুতে। খানিক পরেই সেখান থেকে দেখা গেলো চরে স্তূপ করা লাশের ভেতর থেকে অনেকেই পালাচ্ছে। সবাই রক্তাক্ত। যন্ত্রণায় দিক-বেদিক ছুটছে। কেউ উপরে, কেউবা নদীর দিকে যাচ্ছে।
তখন ওই ক্যাপ্টেন চিৎকার দিয়ে বলে, ‘‘শালা এ লোক তো জিন্দা হে আপতাক। এলএমজি ছোড়ো, এলএমমজি ছোড়ে।’’ ওরা এলএমজি দিয়ে কুকুরের মতো মানুষগুলোকে মারে ওরা।
আমাদেরকেও আবার চরের দিকে নিয়ে আসে। সেখানে যেতেই দেখি চাচাকে (আজিজুল আলম)। গুলি লেগে তার ভুড়িটা অনেকটাই বের হয়ে এসেছে। যন্ত্রণায় তিনি কাতরাচ্ছেন। জ্ঞান তখনও ছিল। রক্তে চারপাশটা ভরে গেছে।
প্রতিবাদ করে চাচা তখন ওই ক্যাপ্টেনকে চেচিয়ে বলেন, ‘‘এয়া কিয়া জুলুম হে ভাই। এয়া কিয়া জুলুম হে। খোদাতালা বরদাস নেহি করেগা।’’ কথাগুলো পরপর তিনবার বললেন।
শুনে ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন গর্জে উঠে। ‘‘শুয়োরকা বাচ্চা’’ বলেই চাচার খুব কাছে গিয়ে কপালের মাঝ বরাবর একটা গুলি করে। মাথার খুলিটা উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু না, সেটা হলো না। খুলিটা উঠে গিয়ে গোটা মুখটায় ঢেকে গেল। তিনি তখন শুধু একবার ‘‘উ্হ’’ শব্দটি করলেন। এরপরই উপুর হয়ে পড়ে গেলেন। চাচার করুণ মৃত্যুতে বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে। শরীর কাঁপছিল। জোরে কাঁদতেও পারিনি তখন।
এরপর ওরা আমাদের বলে, ‘‘তোম সব লাশ এক জায়গায় করো।’’
শেষ নিঃশ্বাসটা যখন যায় তখন মানুষ বাঁচার অনেক চেষ্টা করে। লাশের স্তূপ থেকে অনেকেই কিছুটা দূরে সরে গিয়ে পড়েছিল। সে লাশগুলো আমরা একত্র করতে থাকি।
মারা গেলে মানুষ কতটা ভারি হয়, সেদিন বুঝেছিলাম। দুজন মিলেও একটা লাশ তুলতে পারিনি। ২০টির মতো লাশ দূর থেকে এনে স্তূপ করে রেখেছিলাম আমরা। দেখেছি, অনেকের শরীরে গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে ভোগলা হয়ে বেড়িয়ে গেছে।
ওয়াসেল নামে আমাদের এক স্যার ছিলেন। অংক করাতেন। তার রক্তাক্ত শরীরটা যখন স্তূপে ছিটকে ফেললাম তখন লুঙ্গিটা সরে যায়। জ্ঞান ছিল না তখন (পরে বেঁচে গিয়েছিলেন)। স্যার উলঙ্গ অবস্থায় থাকবেন। আমি তার লুঙ্গিটা টেনে দিচ্ছি। এক পাকিস্তানি সিপাহি দৌড়ে এসে আমাকে একটা লাথি দিয়ে বলল, ‘‘শুয়োরকা বাচ্চা তুম আবি ইজ্জাত দেখতাহায়। থোরা বাদমে তোমারা হাল বি এছা হোগা।’’ সে আরেকটা লাথি দিতেই লাশের স্তূপে গিয়ে পড়ি। সেখান থেকে যখন উঠে আসি তখন আমার সারা শরীর শহীদদের রক্তে ভেজা।
ওরা পেট্রোল ভর্তি টিন এনে আমাদের হাতে দিয়ে বলে, ‘‘পেট্রোল লাগাও।’’
গায়ে তখন শক্তি নেই। ভালোভাবে পেট্রোল ছিটাতেও পারছি না। পরে ওরাই লাশের স্তূপে পেট্রোল ছিটাল। পাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।
ক্যাপ্টেন দূরে দাঁড়িয়ে নতুন ম্যাগজিন ফিট করছে। কোনও মানুষকেই জীবিত ছাড়বে না। গুলি করে লাশের উপর ফেলে আমাদেরসহ আগুন ধরিয়ে দিবে।
তখন শুধু বিধবা মায়ের কথা মনে পড়ছে। ছোট ভাই পান্নাকে তো মেরেই ফেলেছে। আমিও যদি মারা যাই মায়ের কি হবে। তখন সাহস করে জান ভিক্ষা চাইতে ক্যাপ্টেনের দিকে এগোই। এক সিপাহি এসে বাধা দেয়। পাশে আরেক সিপাহি ছিল তার সিনিয়র। সে পাঞ্জাবি নয়, সিন্ধি। এগিয়ে এসে ওই সিপাহিকে ধমক দিল। মুখের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সে কাঁদছে। পাকিস্তানি হয়েও ওই হত্যাযজ্ঞটি সে সহ্য করতে পারেনি।
আমাকে যেতে দিয়ে সে পেছন পেছন বলল, ‘‘যাও ভাই যাও, ক্যাপ্টেন সাবকা পাস যাও। আপনা জান ভিগ মাঙ্গো। আমার জি কাহাতে তোমকো ছোড় দেগা।’’
আমার সারা শরীর তখনও রক্তমাখা। ক্যাপ্টেনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গর্জে ওঠেন। সে ভেবেছে লাশের ভেতর থেকে উঠে এসেছি। সে তো খুনি। ফলে প্রচণ্ড ভয়ও ছিল মনে। আমার বুকের বা পাশে অস্ত্রটা ধরে সে বলল, ‘‘বাতাও কেয়া বলতে হো।’’
বলি, ‘‘স্যার, মুজে মাত মারিয়ে স্যার। মুঝে বাছনিকে কহি খায়েস নেহি হে দুনিয়ামে। মাগার মেরা বেওয়া মাকে হে। এক ভাই হে। উছকো তোম মার ডালা। আগার মুজে মারেগা হামার বেওয়া মাকে দেখবাল করলে কি দুনিয়া মে কোহি নেহাগা। প্লিজ সেভ মি স্যার। ডোন্ট কিল মি।’’
ক্যাপ্টেন আমার চোখের দিকে তাকিয়েই অস্ত্রটা নামিয়ে ফেলে। খানিক চিন্তা করে বলে, ‘‘ঠিক হ্যা তোমকো হাম নেহি মারে। তুম ঘার চালি যাও। মাকো আচ্ছাছে দেখবাল কারনা। যাব ইউনিভার্সিটি খোল যায়। তুম চল যায়েগা। ঠিক হ্যা।’’
ইন্ডিয়াকে গালি দিয়ে সে আরও বলে, ‘‘মাদারচোদ, ইন্ডিয়া হ্যা না, ইন্ডিয়া মে মাত যা না। আর হাম লোককি এ খুনখারাবি কেহানা, কিছুকো মাদ বোল না।’’
বলি, ‘‘ঠিক হ্যা।
খোদাকি কসম।
খোদাকি কসম
আল্লাহকি কসম।’’
বলি, ‘‘আল্লাহকি কসম। ইমানছে।’’
বলি, ‘‘ইমানছে।’’
এরপর বলে, ‘‘আবি ঘার চালি যাও।’
মনে হয়েছে যেন নতুন জীবন পেয়েছি। আছরের আগে আগে ছাড়া পাই। অতঃপর সোজা চলে যাই মায়ের কাছে, নানা বাড়ি সাদীপুরে।
ছোটভাই পান্নার শরীর গুলিতে ঝাজরা হয়। গায়ে আগুন লেগে এক হাত বেকেও গিয়েছিল। স্বাস্থ্য বেশ ভাল ছিল। আর্মিরা চলে গেলে চর থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় সে বাড়ি আসে। কেউ ছিল না তখন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওর ঘরে যায়। পরে নেমে ইন্দিরার কাছে গিয়ে বালতি নামায়। গায়ে পানি ঢালবে। কিন্তু পারে না। রশিতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ ছিল। যন্ত্রণায় শান্তি পাচ্ছিল না। পিপাসা পেয়েছিল। ডাইনিংয়ে কাসার গ্লাসসহ মেঝেতে পড়ে ছটফট করে, রাতে ওখানেই মারা যায়। সারা বাড়িতে ওর রক্তমাখা পায়ের ছাপ ছিল। না জানি কতটা কষ্ট হয়েছে তার। কত কিছুইনা বলতে চেয়েছিল পান্না।
পরের দিন লাশ খুঁজতে আমার মামা ওই চরে যান। প্রথমেই পান চাচার লাশটা। গুলি লেগে তার মাথাটা বিকৃতই হয়ে গেছিল। ফর্সা মানুষ ছিলেন। অথচ মৃত্যুর পর মুখটা একেবারেই কুচকুচে কালো হয়ে যায়। পরাগ ভাইয়ের লাশও ছিল সেখানে। তার তলপেটে যে কত গুলি লেগেছে চিন্তা করতে পারবেন না। কিন্তু মহসীন ভাইয়ের (ভগ্নিপতি) লাশটা পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন একটা ছেলে নদীর দিক থেকে এসে বলে সেখানে একজন বসে আছেন। তার সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা। মামা দৌড়ে গিয়ে দেখেন মহসীন ভাই। পানির খুব কাছাকাছি বসা। কিন্তু চোখ দুটো কাদায় ঢাকা। এতটুকুও শক্তি নাই যে, পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে নিবেন। মামা যখন ধরছে তখনই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তাকে নিয়ে আসা হয় বাড়ির উঠানে। তখনও জ্ঞান ছিল। উঠানে একটা বড় বরই গাছ। ওই গাছের নিচে তাকে শুইয়ে রাখা হয়।
চাচিকে দেখে সে বলে, ‘‘চাচি আমার কানের কাছে সুরা ইয়াসিন পড়েন।’’ চাচি তার স্বামীর লাশ, এক ছেলের লাশ দেখেছে। আরেক ছেলে (ফেরদৌস আলম) গুলি খেয়ে এক বাড়িতে পড়ে আছে। তবুও শক্ত থাকেন। শোক ভুলে দ্রুত ওজু করে এসে মহসীন ভাইয়ের কানের কাছে সুরা ইয়াসিন পড়েন। তার বুক ও পেটে গুলি লেগে ভোগলা হয়ে গিয়েছিল। খানিক পরেই সুরা শুনতে শুনতেই তার দমটা চলে যায়।’’
একাত্তরের রক্তাক্ত দিনটির কথা এখন জীবন্ত হয়ে আছে প্রফেসর ড. জিন্নাতুল আলমের স্মৃতিতে। ভয়টা এখনও কাটেনি তার। স্বপ্নে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ এখনও দেখেন। মাঝেমধ্যে শহীদদের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। রক্তাক্ত প্রিয়জনের আর্তনাদে ঘুমাতে পারেন না তিনি। ওই ঘটনার পর থেকে সকল দেশের আর্মিকেই ঘৃণার চোখে দেখেন তিনি।
শহীদদের তালিকা ও শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রসঙ্গে জিন্নাতুল আলমের ভাষ্য, ‘‘আমার বিধবা বোনের ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করেছি। কেউ কোনদিন এসে একবার জিজ্ঞেসও করেনি কীভাবে চলছে পরিবার? আর্থিক সুবিধার দরকার নেই, রাষ্ট্র তো শহীদ পরিবারগুলোর সম্মানটা অন্তত দিতে পারত। থানাপাড়ায় আনুমানিক ১২শ থেকে ১৩শ মানুষ শহীদ হয়েছে। গোটা গ্রামে এমন কোনও পরিবার পাবেন না যে কেউ শহীদ হয়নি। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনও এদের পূর্ণাঙ্গ কোনও তালিকা হয়নি, করার চেষ্টাও নেই।’’
কেন এটা হচ্ছে না বলে মনে করেন?
তার অকপট উত্তর, ‘‘আমরাও চলে গেলে এই ইতিহাস খুঁজেও পাবেন না। কোনও সরকারই শহীদদের তালিকা করতে চায় না। হয়তো শহীদ পরিবারগুলোকে রাষ্ট্র বোঝা মনে করে। এদের স্বীকৃতি দিতে গেলে বিরাট অংকের টাকা লেগে যাবে। সুবিধা না দিক, রাষ্ট্র তো শহীদদের একটা লিস্ট তৈরি করার কাজ শুরু করতে পারত। তালিকা করা এখনও সম্ভব। এটি না করার দায় রাষ্ট্র কখনই এড়াতে পারে না।’’
যাদের রক্তে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশে সেই সকল শহীদদেরকেই আমরা ভুলে গেছি! এমন কষ্টের অনুভূতি প্রায় প্রতিটি শহীদ পরিবারের হৃদয়ে আজও রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। দেশ এখন উন্নতির দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু শহীদ স্বজনদের চাপা কষ্টকে চাপা দিয়ে আমরা কি নির্মাণ করতে পারব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা!
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল-সন্ধ্যা ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ মার্চ ২০২৪
© 2024, https:.