কাইয়ার গুদাম কি স্বাধীন হয় নাই?
১৯৭১ সাল। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, পিপিএম হাই স্কুলে। সাজে রাণী দাস, সেবা রাণী দাস, জাহানারা বেগম, নাসিমা বেগম, শিউলি আক্তার— এরা ছিল খেলার সাথী। একটু দুষ্টু ছিলাম। ছিলাম প্রতিবাদীও। কেউ অন্যায় করছে দেখলেই এগিয়ে যেতাম। বাবা আব্দুল লতিফ ছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জে ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগের সভাপতি।
দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। থানায় থানায় বসেছে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প। ফেঞ্চুগঞ্জে তারা ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে। তাদের সহযোগিতায় ছিল শান্তি কমিটি ও রাজাকারের লোকেরা। ওরা চিনিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের। যুবতী দেখলেই তুলে নিয়ে যেত পাকিস্তানি ক্যাম্পে। পাকিস্তানি সেনারা আসার পরই তারা হানা দেয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে। বাবা তখন পালিয়ে বেড়ান।
বাবা না থাকায় তখন চাচা কালা মিয়াই দেখভাল করতেন আমাদের। এভাবে কাটে তিন চারমাস। অতঃপর একদিন গোপনে বাবা গ্রামে আসেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছিলেন পাল পাড়ার বানু মিয়া।
দুপুরের দিকের ঘটনা। প্রথম তারা বানু মিয়ার বাড়িতে উঠে। খাওয়া-দাওয়া সেরে ওই বাড়িতে ডেকে নিবে আমাদের। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। বানু মিয়া ঘরের ভেতরে খেতে বসেছেন। ভাতের থালা সামনে। বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাইরে, গাছের আড়ালে।
বাবার নিজের মামু ছিল রাজাকারের সভাপতি। তার ভয়েই তিনি বাড়িতে থাকতেন না। তারা গ্রামে ঢুকতেই কে যেন খবর দিয়ে দেয় রাজাকারদের। ওরা দ্রুত খবর পাঠায় পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্পে। ফলে পাঞ্জাবিরা অ্যাটাক করে বানু মিয়ার বাড়িতে। বাবা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারলেও বানু মিয়া পারেনি। খাওয়া নাকি কোরআন শরীফ পড়ার মতো! অথচ ভাত খাওয়া অবস্থায়ই তাকে গুলি করে মারে ওরা।
এ খবর আমাদের জানা ছিল না। ওইদিন সন্ধ্যার পর বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে পাঁচ-সাতজন রাজাকার। ফরিদপুর গ্রামের রাজাকার মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল। বাকিদের নাম মনে নাই। ওরা এখনও কিছু বেঁচে আছে, কিছু নাই।
আমি তখন পড়তে বসছি। ওরা আমার চাচারে ধইরা নিতে চায়। তারে উঠানে নিলেই আমি সাহস করে সামনে যাই। জানতে চাই তার অপরাধ কি? ওরা বলে—‘ইন্ডিয়ার খবর শুনে কেনে। সভাপতি চেয়ারম্যানের কাছে নিয়া ছেড়ে দিমু।’
ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়। যাওয়ার মতো আর কেউ নাই। তাই আমিও তাদের পেছন পেছন যাই। তখন চাচার লগে ওরা আমারেও তুইলা নেয়। নিয়ে যায় কাইয়ার গুদামে।
ওটা ছিল পাঞ্জাবিদের টর্চার সেল। খুবই অন্ধকার জায়গা। ওই পরিবেশ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম। আরও নারীরা ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকার সহ্য করতে পারতাম না। সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক নির্যাতন আর অত্যাচার। সে নির্যাতন কোনোও নারীই মুখে বলে বোঝাতে পারবে না।
প্রথম পাঁচ-ছয়দিন একটা রুমে রাখে ওরা। বাবা খবর পেয়ে কিছু পরিচিত মুরুব্বিকে পাঠায়। কিন্তু ওরা আমায় ছাড়ে না। আরেকটা রুমে শিফট করে দেয়। সেখানে রাখে এক মাস, চলে পালাক্রমে নির্যাতন। রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকেরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসা যাওয়া করতো। আমরা শব্দ পেতাম। খাবার দিত না ওরা। দুই তিনদিন পর মন চাইলে এক বেলায় দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল। একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজ গাঁও স্টেশনের পাশে। অতঃপর হাসপাতালে চলে দুই মাস চিকিৎসা।
কাইয়ার গুদামের বড় বড় বাঙ্কার ছিল। সেখানে রাখা হতো শত শত নারীকে। স্বাধীনের পর আড়াই থেকে তিন’শর মতো নারীকে বের করা হয়েছিল। পুরুষ কও আর নারী কও ওরা প্রথমে ঢুকাইতো কাইয়ার গুদামে। তারপর অন্য জায়গায় নিসে। আমার চাচারেও ওরা প্রথম নিয়ে টর্চার করছে কাইয়ার গুদামে। পরদিন নদীর পাশে কাঠের তক্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারছে। তার লাশ চলে গেছে কুশিয়ারা নদীর পেটে।
আমার মাথায় কাটার দাগ এখনও আছে। বাইশটা শিলি পড়ছিল। দেখেন মুখে ক্ষত। বেয়োনেট দিয়ে পাঞ্জাবিরা গুতা দিছে। ডান হাতটা ভাঙ্গা। পায়ের ক্ষতি করছে। রানের ভেতরও বেয়োনেটের খোঁচার দাগ আছে অগুনতি।
অনেক কথাই মনে আছে। অনেক কথাই বলতে পারি নাই। নতুন প্রজন্মের কাছে এখন তো টর্চারের কথা বলতে লজ্জা লাগে, ভয়ও লাগে। এখন তো কিছু মরা, কিছু জিন্দা হিসেবে বেঁচে আছি। সরকার যা দিচ্ছে তাতে ভালো আছি। কিন্তু ওই কাইয়ার গুদামের পাশ দিয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা ধুপ করে ওঠে। একাত্তরটা মনে পইড়া যায়।
দেশ তো স্বাধীন হইছে অনেক বছর আগে! কিন্তু কাইয়ার গুদাম এখনও স্বাধীন হয় নাই। আমরা মইরা গেলেই এই ইতিহাস শেষ। কেউ মনেও রাখব না। ফেঞ্চুগঞ্জে একাত্তরের স্মৃতি রক্ষা করবে কে?
কাইয়ার গুদামে একাত্তরে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লাইলি বেগম।
সিলেট থেকে কুশিয়ারা নদীর ব্রিজ পেরোলেই বাম দিকের ঢালু পথ চলে গেছে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের দিকে। নদীর তীরঘেঁষা ইট বিছানো এবরোথেবরো রাস্তা। খানিক এগোতেই মিলে কাইয়ার গুদাম, একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির টর্চার সেল।
একাত্তরের আগে এটি ছিল একটি পাটের গুদাম। সামনেই কুশিয়ারা নদী। ফলে নদী পথে অন্যান্য থানার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল সহজ। তাই পাকিস্তানি সেনারা এটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাশেই কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বড় একটি শিমুল তুলা গাছ। এই গাছের ওপরই কাঠের তক্তা বেঁধে তৈরি করা হয়েছিল ওয়াচ টাওয়ার। সেনারা দূরবীণ নিয়ে সেখানে পাহাড়া দিত। গাছেই বসানো হয় ওয়্যারলেস যন্ত্র।
গুদামটি অনেক বড়। কালচে ছাপ পড়া উঁচু তার দেওয়াল। পেছনের দুটি দরজা কাঠ মেরে বন্ধ করা। সামনে টিনে ঘেরা দুটি ঘর। এখন নতুন দরজা খুলে একটি রুম ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় হিসেবে। বাকি রুম ও গোটা গুদাম তালাবদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফেঞ্চুগঞ্জে অবহেলিত। একাত্তরের শহীদদের আত্মা এখানে নিরবে কাঁদছে। সেই কান্নার আকুতি এখনও স্পর্শ করেনি সরকার বা দায়িত্বশীলদের। কিন্তু কেন? স্থানীয়রা বলছেন কাইয়ার গুদাম দখল নিয়ে সরকারের সঙ্গে চলছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের মামলা। সেই চক্রটি চায় না কাইয়ার গুদামের ইতিহাস তুলে ধরা হোক।
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হলে কাইয়ার গুদামে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা আজমল হোসেন রউফসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। কী দেখেছিলেন তারা ওইদিন?
আজমল বললেন, ‘‘ইন্টার ফেঞ্চুগঞ্জের এটা ছিল কন্ট্রোল রুম। আমরা তো কাইয়ার গুদামে ঢুকেই ভয় পেয়ে গেছি। রক্তমাখা হাতের ছাপ। মানুষকে ওয়ালে ঝুলিয়ে টর্চার করছে ওরা। দেয়ালে রশি বাঁধা। প্রথম দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি ঘর। মেঝেতে পা পড়তেই পা আটকে যায়। আঠার মতো কি যেন! মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখি মানুষের রক্ত জমাট হয়ে গেছে। কুলাউড়া ও সিলেট থেকেও অনেক লোক ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছিল। মানুষের হাড়গোড়ও পেয়েছি কাইয়ার গুদামে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এত বছরেও এখানে রক্ষা করা হয়নি। এভাবে চললে এমন একদিন আসবে যখন একাত্তরের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে কাইয়ার গুদামের কথা।’’
আমাদের কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা খোদেজা বেগম আর মনু বেগমের সঙ্গে। তারা দুই বোন। বাড়ি মোমিনপুরে। একাত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রাজাকারদের সহযোগিতায় একদিন পাঞ্জাবিরা তুলে নেয় দুই বোনকেই। তিনদিন রাখে কাইয়ার গুদামে। ওই দিনগুলো আজও তাদের কাছে অভিশপ্ত মনে হয়।
তাদের ভাষায়, ‘‘কাইয়ার গুদামে বহুত পাকিস্তানি আছিল। আমাদের অত্যাচার করে ওরা মরার মতো ফালাইয়া রাখছে। অনেক মানুষ ছিল ওইখানে। খাবার দিত না। বহুত মানুষকে নিয়া নির্যাতন করছে ওরা। আমাগো টর্চার করে আধমরা করে ফেলে রাখত। কাঁদলেই রাইফেল দিয়া বাড়ি দিত। পরে মুক্তিযোদ্ধারা আমগো উদ্ধার করছে।’’
ফেঞ্চুগঞ্জের গণহত্যার ইতিহাস কেন সরকারি ভাবে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে না? এ প্রসঙ্গে কথা বলেন সিলেট জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মির্জা জামাল পাশা।
তিনি বললেন,‘‘দেখেন, আমরা সত্যকে সত্য বলব। মিথ্যাকে মিথ্যা। আপনি নিজেকে বলবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক কিন্তু আপনার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাবে, বধ্যভূমি অরক্ষিত থাকবে, শহীদদের স্মৃতি নদীর জলে ভেসে যাবে— এটা তো ঠিক কথা নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। তাকে বুকে ধারণ করেছি। আমরা তো ক্ষমতার জন্য সত্যি বলা বাদ দিব না। ফেঞ্চুগঞ্জের কাইয়ার গুদাম এখনও কি পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দখলে? তা না হলে অনেক আগেই কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করা যেত। এই লজ্জা আমাদের। এই লজ্জা আওয়ামী লীগেরও।’’
এ প্রসঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন বলেন (এখন প্রয়াত), ‘‘কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অনেক আগেই আমরা আবেদন পাঠিয়েছি। কিন্তু তবুও সরকার থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আমরা চাই দ্রুত কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।’’
বীরের দেশে বীরত্বের ইতিহাস যেমন তুলে ধরতে হবে তেমনি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ইতিহাসও তুলে ধরা প্রয়োজন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। তাই ফেঞ্চুগঞ্জের সচেতন মানুষ চায় একাত্তরে কাইয়ার গুদামের গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরা হোক নতুন প্রজন্মের কাছে।
শহীদদের তালিকাসহ কাইয়ার গুদামকে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রয়োজনটুকু রাষ্ট্র কেন উপলব্ধি করতে পারছে না, সেটাই অবাক করেছে সবাইকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সকাল সন্ধ্যা ডটকমে, প্রকাশকাল: ১ জুন ২০২৪
© 2024, https:.