‘হামরা বাড়্যাল, আম-লিচির বেবোসা করি’
গন্তব্য এবার মাধববাটী। বিরল উপজেলার এ গ্রামটিই লিচুর জন্য বিখ্যাত।
দিনাজপুরে আগেও গিয়েছি কয়েকবার। কিন্তু এবারের ভ্রমণটা শুধুই লিচুর জন্য। যাত্রার দিনের সকাল-সকাল বন্ধু রিয়াজের হাঁকডাক। জানাল সে পরিকল্পনার কথা, লিচু খেতে খেতেই লিচু বাগান ঘুরে বেড়ানো। তাও আবার যেনতেন বাগানে নয়, দিনাজপুরের বিখ্যাত মাধববাটীর লিচু বাগানে!
সব ঠিকঠাক। রাতেই রওনা হতে হবে। বন্ধু সুমনেরও নাকি প্রস্তুতি শেষ। অতএব, না বলার কোনোই সুযোগ রইল না।
দিনাজপুর শহরে যখন পা রাখি, তখন ভোর ৬টা। বাস কাউন্টারেই খানিকটা ঝিমিয়ে নিই। তারপর নাশতাপর্ব। সেটা সেরে নিই পাবনা সুইটসের গরম গরম পরোটার সঙ্গে পাঁচ মিশালি সবজি-ভাজি দিয়ে। ক্ষুধার পেটে তা অমৃতের মতো লাগে।
গন্তব্য এবার মাধববাটী। বিরল উপজেলার এ গ্রামটিই লিচুর জন্য বিখ্যাত। দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার পথ। একটি অটোবাইক দরদাম করেই আমরা রওনা হয়ে যাই।
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনর্ভবা নদী। ব্রিজ দিয়ে নদী পেরোতেই দক্ষিণমুখো বিরলের রাস্তা। চলতি পথে আনমনা করে দেওয়ার মতো নানা দৃশ্য। দুই পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ধান কাটা পুরোপুরি শেষ। ধানের খড় বিছানো পথ। তিল পরিমাণ মাটির দেখা নেই। রাস্তার পাশেই চলছে ধান মাড়াই।
মিনিট ৩০ পথ চলতেই পাল্টে যায় দৃশ্যগুলো। রাস্তার দুই পাশে তখন মাটি আর ছনে ছাওয়া ছোট ছোট ঘর। তা পেরোতেই সারি সারি লিচুগাছ। গাছে গাছে ঝুলছে লিচু। শত থেকে হাজারে হাজারে। দূর থেকে মনে হয় সবুজের মাঝে যেন সিঁদুর ফোঁটা।
স্থানীয় চৌধুরীদের বড় একটি লিচু বাগানে পা রাখতেই আমাদের চোখ তো ছানাবড়া! টকটকে লাল লিচুর ভারে নুয়ে পড়েছে সেখানকার গাছগুলো। দেখে মনে হয় যেন স্ট্রবেরি ঝুলছে। রিয়াজ ঠিক থাকতে পারে না। নেমেই দে ছুট। সুমনের কণ্ঠে তখন ‘ওয়াও’, ‘অদ্ভুত’ শব্দগুলো।
বাগানের ভেতর ঘুরছি। হঠাৎ গানের সুর-‘হে নানা লবগঞ্জ থেকে হামরা আসছি বিরলেরই লিচু বাগানে…।’ তার পরই অট্টহাসি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা গানের সুর দিনাজপুরে! খানিকটা অবাক হই। বাগানের ভেতরে দেখি গাছের নিচে ছোট্ট একটি পলিথিনের খুপরি ঘর। সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে চল্লিশোর্ধ্ব দুজন। একজন গলায় সুর তুলছে। অন্যজন রান্নার পাতিলে শব্দ করে তাল দিচ্ছে। আরো দুজন পাশের খুপরি ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে।
বাগানে বসে ‘গায়ক’ আর ‘বাদক’-এর সঙ্গে আলাপ জমাই। এনামুল ও মমিন-দুজনেরই বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মাধববাটীতে এসেছে বৈশাখের ঠিক আগে। এরা বাগান ঘুরে ঘুরে মুকুল দেখে আর অনুমান করে লিচুর ফলনের। কাঙ্ক্ষিত গাছ মিলে গেলে বাগান মালিকের কাছ থেকে বাগান কিনে শুরু করে লিচুর পরিচর্যার কাজ। লিচু পাকলে বিক্রি করে দেয় ঢাকার পাইকারের কাছে। গাছের শেষ লিচু পর্যন্ত এরা থাকে বাগানে। লিচুর সঙ্গে মিশে থাকে এদের সুখ-দুঃখ আর হাসি-কান্না।
মমিন বলে, ‘হামরা বাড়্যাল, আম-লিচির বেবোসা করি।’ সে জানাল, লিচু একটু বড় হলেই শুরু হয় বাদুড় তাড়ানো আর চোর পাহারার কাজ। কথা থামিয়ে খুপরি ঘরের পাশ থেকে বাঁশের তৈরি একটা যন্ত্র দেখায়। হাত দিয়ে তা চেপে ধরতেই আওয়াজ হয় ‘ফট ফট’। এটি ‘ফটফটিয়া’। লিচুর প্রধান শত্রু বাদুড় তাড়ানোর কাজে লাগে এই ফটফটিয়া। আরো আছে ‘টিন বাঁধ’। এনামুল একটি দড়ি ধরে দেয় টান। অমনি গাছে বাঁধা টিনের ঝাড়ে লাঠি পেটার শব্দ হয়। টিনের শব্দে দু-একটা বাদুড়ও উড়ে যায় গাছ থেকে। সুমনের ক্যামেরায় তখন ক্লিক ক্লিক শব্দ।
মাধববাটীর বাগানগুলোতে দেখা মেলে মাদরাজি, বোম্বাই, বেদেনা আর চায়না থ্রি জাতের লিচু। তবে স্থানীয়দের পছন্দের লিচু ‘মাদ্রাজি’। এটি বেশ সুস্বাদু আর রসাল। আর চায়না থ্রি লিচুর দাম সব সময়ই থাকে আকাশচুম্বী। এ জাতের একেকটি লিচুর দাম পড়ে ১৬ থেকে ২০ টাকা। বাজারে এর খুব একটা দেখা মেলে না। বাগান থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় চলে যায় রাজধানীর প্রভাবশালীদের বাড়িতে। চায়না থ্রির কথায় আমাদের চোখ কপালে ওঠে। অনুমতি নিয়েই দু-একটি চালান করে দিই মুখে।
খালি হাতে বাড়ি ফিরব? তা কি হয়! বোম্বাই লিচুর দরদাম করি। একটি গাছ দেখিয়ে দিতেই শুরু হয় ‘লিচু ভাঙা’। গাছে উঠে লিচুসহ ছোট ছোট ডাল ভেঙে নিচে ফেলছে একজন। অন্যরা বাঁশের ঝুড়িতে পাতা দিয়ে বেছে বেছে তা সাজিয়ে রাখছে। যেন এক শিল্পকর্ম। বাড়্যালদের সঙ্গে আমরাও তখন মজে যাই লিচু ভাঙার আনন্দে।
লিচু বাগানে লিচু ভাঙা হয় সকাল-বিকাল। এ সময় বাগান এলাকার মানুষেরা ব্যস্ত থাকে নানা পেশায়। কেউ বাঁশের ঝুড়ি বানায়। কেউ দোকড়া (চট) আনে। কেউবা বাগানে বাগানে ঘুরে লিচুর ডালা সাজায়। এভাবে লিচুকে ঘিরে ব্যস্ত থাকে নানা পেশার মানুষ।
সন্ধ্যার আগেই ফিরতি পথ ধরি। চারপাশের বাগানে তখনও লিচু ভাঙা চলছে। আশপাশের মানুষেরা ব্যস্ত লিচুর ডালা সাজাতে। ফিরছি আর ভাবছি নানা কিছু। মাধববাটী সত্যিকারের লিচুগ্রাম।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজ বিভাগে, প্রকাশকাল: ১৫ জুন ২০২৪
© 2024, https:.