খোন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন চেয়েছিল
“ঢাকায় মা একটা দোতলা বাড়ি পেয়েছিলেন নানির কাছ থেকে। শান্তিনগরের ২২ নম্বর চামেলিবাগে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস বাড়ির খুব কাছে। ওখানেই থাকতাম আমরা। ২৫ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি আর্মি মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অ্যাটাক করে। বহু বাঙালি পুলিশ সদস্য পালিয়ে আশ্রয় নেয় আশপাশের বাড়িগুলোতে। আমাদের বাড়িতেও এসেছিল কয়েকজন। অজানা এক আতঙ্ক দেখেছি তাদের চোখেমুখে। সবার শরীর থরথর করে কাঁপছিল।
পরদিন আর্মিরা আশেপাশের বাড়িতে হানা দেয়। যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের বাড়িতে আসেনি তারা।
বাবা আব্দুস সামাদ ছিলেন জামালপুরের এমএনএ। ফলে পাকিস্তানি আর্মির লিস্টে ছিল তার নাম। ২৮ মার্চে ওরা শান্তিনগর বাজার পুড়িয়ে দেয়। ওই রাতেই হানা দেয় আমাদের বাড়িতে। বাড়িতে কেউ ছিল না। মা-বাবা আগেই চলে যান টাঙ্গাইলের কালিহাতির আগচারাণে, মামা সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে। বিপদ অনুমান করে আমিও বাড়িতে থাকিনি, চামেলিবাগের এক বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলাম।
ইকবাল নামে এক পাকিস্তানি মেজর এসেছিল। ওরা এসে ঘরে ঢুকেই এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এরপর যায় দোতলায়। সেখানে ভাড়া থাকতেন এক দম্পতি। লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলে। তারা তখন ভয়ে তটস্থ। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি তাদের কিছু বলল না।
কেন?
ওই দম্পতি ছিলেন প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানের ঘনিষ্ঠজন। দেয়ালে আগা খান ও তার স্ত্রীর সঙ্গে একটি ছবিও টাঙানো ছিল। তাদের বিয়েতে সস্ত্রীক এসেছিলেন আগা খান। ওই ছবি দেখেই পাকিস্তানি আর্মি খানিকটা ভড়কে যায়। তখন তাদের কিছুই বলে না। বরং ভয় না পাওয়ার অনুরোধ করে। এমএনএ-এর বাড়ি হওয়ায় ডিনামাইট দিয়ে গোটা বাড়ি উড়িয়ে দেয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু আগা খানের ছবির কারণেই ওরা তা করেনি।”
একাত্তরের মার্চের একটি ঘটনা তুলে ধরেই আলাপচারিতা শুরু করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান চৌধুরী। তার ডাক নাম মনজু। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই কথা হয় মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গে।
আবদুস সামাদ ও মাসুদা খাতুনের প্রথম সন্তান মনিরুজ্জামান। গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কলকাতায়, বর্ধমান মহারাজা স্কুলে। বাবা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিএ। ওই সুবাধেই থাকতেন পার্ক সার্কাসে। পরে চলে আসেন ঢাকায়।
১৯৫৭ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিএ-তে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। পরে এমএ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। এরপরই মনিরুজ্জামান যোগ দেন সরকারি চাকরিতে।
প্রথমে ছিলেন মিনিস্ট্রি অব ল-তে। এক বছর পরই চলে যান পাকিস্তান ট্যাক্সেশন ডিপার্টমেন্টে। অতঃপর ১৯৬৯ সালে পোস্টিং পান ঢাকায়, ট্যাক্স অফিস নারায়ণগঞ্জ সার্কেল টু-তে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সার্কেলেরই ইনকাম ট্যাক্স অফিসার।
মনিরুজ্জামানের বাবা আবদুস সামাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সখ্য ছিল। পরে বঙ্গবন্ধুর আহবানেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে। সত্তরের নির্বাচনে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর এলাকা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-০১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন আবদুস সামাদ। কিন্তু ওই নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সবাই নেতার নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে।
সাতই মার্চ ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু দেন চূড়ান্ত নির্দেশনা। বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামানের কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা। বন্ধু ড. সেলিমুজ্জামানসহ তিনিও গিয়েছিলেন সেখানে। সাধারণ মানুষের হাতেহাতে ছিল বাঁশের লাঠি। রেসকোর্স মাঠের চারপাশে পজিশনে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক। রিউমার ছিল এ ট্যাংক দিয়েই ওরা বাঙালিদের গুড়িয়ে দেবে। কিন্তু তবুও সেদিন আগত জনতা তা টলারেটই করেনি।
কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ?
মনিরুজ্জামানের ভাষায়, “ভাষণের পুরোটাই ছিল একটি অনবদ্য কবিতার মতো। সামরিক বাহিনীতে যারা ছিলেন তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার ভাই’। নরমালি এটা বলার কথা নয়। তার মানে একটা সহিষ্ণু মনোভাব বঙ্গবন্ধুর তখনও ছিল। শেষে বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি… যার যা কিছু আছে…।’
এতে পরিষ্কার হয়ে যাই, তিনি গেরিলা ওয়ারের কথাই বলে দিচ্ছেন। এরপর আর কিছু বলার বাকি থাকে না। আমাদের কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।”
এপ্রিলের প্রথম দিকে ঢাকার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। মনিরুজ্জামান তখন টাঙ্গাইলের কালিহাতি হয়ে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। বাবা ওখনকার এমএনএ। ফলে স্থানীয়দের নিয়ে নানা কাজের উদ্যোগ নিতে থাকেন তিনি।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মনিরুজ্জামান গরুর গাড়িতে রওনা হন ভারতের দিকে। রাতে বর্ডারের কাছাকাছি এক বাড়িতে রাত কাটান। ভোরে নাস্তা হিসেবে বাড়ির লোকেরা খেতে দেন পান্তা ভাত, গুড় আর মহিষের দই। তার কাছে ওটাই লাইফের বেস্ট খাবার ছিল। পরে বর্ডার পার হয়ে চলে যান ভারতের মাহেন্দ্রগঞ্জ। দেখা করেন বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন ন্যাগীর সঙ্গে।
এরপর কী ঘটল? ওই ইতিহাস শুনি মনিরুজ্জামানের জবানিতে।
তিনি বলেন, “মাহেন্দ্রগঞ্জে ছিলাম প্রায় দেড়মাস। ওখানকার বিএসএফ ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন ন্যাগী। তার সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তার সহযোগিতায় নানা পরিকল্পনা করতাম। দেওয়ানগঞ্জে ষাড়মারা নামক জায়গায় একটা ওয়্যারলেস টাওয়ার ছিল। পাকিস্তানি আর্মি ও তার দোসররা ওখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের নানা খবরাখবর পাঠাত। ওই ওয়্যারলেস টাওয়ার ধ্বংস করার পরিকল্পনা হয়। ধ্বংস না করে ওটাকে এনে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিই আমি। তখন ৬-৭ জনের একটা গ্রুপকে অস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয়। তারা ওয়্যারলেস যন্ত্রটা গরুর গাড়িতে করে মাহেন্দ্রগঞ্জ নিয়ে আসে।”
একাত্তরে দেশ থেকে আসা বাঙালিরা মাহেন্দ্রগঞ্জের আশেপাশেও আশ্রয় নেয়। সেখানে ছিল গারোদের বসবাস। পাহাড় বা টিলার মধ্যে বসতি করে থাকত তারা। বাঙালিরা না বলেই ওদের গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের ভেতর অসন্তোষ তৈরি হয়।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান বলেন, “কাঁঠালের কিন্তু কমতি ছিল না। চেয়ে নিলে ওরাই দিয়ে দিত। কিন্তু বাঙালিরা তা করেনি। একদিন বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন ন্যাগী গাড়িতে করে নিয়ে গেল গারো এলাকায়। ওখানে গারোরা অনেক কাঁঠাল পাড়ল, আরও কিছু জিনিসও দিয়ে আমাকে সেগুলো নিয়ে যেতে বলল। আমি বেশ অবাক হলাম। বুঝলাম কিছু একটা ঘটেছে!
তখন ন্যাগী বলল, ‘মনজু ভাই, আমাদের স্যাত কনফ্লিক্ট হতা হে। এছে এছে হোতা হে। হাম তো প্রবলেম মে পাড়গিয়া।’
কী প্রবলেম?
‘গারোরা প্রতিবাদ করছে। এটা যদি কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত যায় তখন তোমাদের লোকদের অ্যারেস্ট করতে হবে। এখন কি সেই পরিস্থিতি হওয়া উচিত।’
শুনে খুব লজ্জা পেলাম। তখন বাবার মাধ্যমে বাঙালি ছেলেমেয়েদের বোঝাই। বলি, ‘কাঁঠাল লাগলে আমাদের বলো। আমরা প্রায় একশ বস্তা চাল নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রয়োজনে ওদের চাল দিয়ে কাঁঠাল নেব। তবুও তোমরা দ্বন্দ্ব তৈরি করো না’।”
মাহেন্দ্রগঞ্জে তখন একটা চোখের অসুখ হওয়া শুরু হয়। চোখ দিয়ে অনবরত রক্তের মতো পানি পড়ত। স্থানীয়রা বলত, এটা জয়বাংলা রোগ। অধিকাংশেরই এ রোগটা হয়েছিল। কিন্তু দৈবক্রমে মনিরুজ্জামানকে স্পর্শ করেনি।
ক্যাপ্টেন ন্যাগী একদিন তাকে ডেকে বলে, এখানে আমরা আছি। তোমার থাকার প্রয়োজন নেই। তুমি বরং মুজিবনগর সরকারকে গিয়ে হেল্প করো। ওখানে তোমার প্রয়োজন আছে। ঠিক তখনই মনিরুজ্জামান মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা করেন, চলে যান কলকাতায়।
তার ভাষায়, “পথে যেন সমস্যা না হয় সে কারণে ক্যাপ্টেন ন্যাগী একটা ছোট্ট চিঠি লিখে দেন। ওটা নিয়েই প্রথম যাই দুমনিতে। ওখান থেকে ট্রেনে চলে যাই শিলিগুড়ি। দার্জিলিংয়ে দু-একদিন কাটিয়ে পরে যোগ দিই কলকাতায় ১৮ নম্বর থিয়েটার রোডে, মুজিবনগর সরকারের হেডকোয়ার্টারে। ইয়ুথ অ্যান্ড রিসেপশন ক্যাম্পের ডেপুটি ডিরেক্টর করা হয় আমাকে। অফিস ছিল কলকাতার ৪৫ প্রিন্সেপ স্ট্রিটে, শিয়ালদহ স্টেশনের কাছাকাছি।”
একাত্তরে মুজিবনগর সরকার যুব ও অভ্যর্থনা শিবির নিয়ন্ত্রণ বোর্ড তৈরি করেছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ ছিলেন এ বোর্ডের প্রধান। ইয়ুথ ক্যাম্পগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর অর্পন করা হয়— যিনি বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ইয়ুথ ও রিসেপশন ক্যাম্প-এর সাহায্য ও সহযোগিতার দায়িত্বও পালন করতেন। ২৪টি যুব ইয়ুথ ক্যাম্প ও ১১২টি অভ্যর্থনা শিবির ছিল তখন। বোর্ডের অনুমোদিত বাজেটের ভিত্তিতে শিবিরসমূহের খরচ মেটান হতো। ব্যাপক আকারে যুব ক্যাম্প ইউনিটগুলোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নিয়মিতভাবে যুব ক্যাম্প থেকে ছেলেদেরকে এনে ভর্তি করা হতো গেরিলা বাহিনীতে। যুবকদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন— বিছানাপত্র, গরম পোশাক, কম্বল ইত্যাদির ব্যবস্থা বন্ধু সংস্থাসমূহ এবং মুজিবনগর সরকারের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা থেকে করা হতো।
এ প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যারা আসত তাদের রিসেপশন ক্যাম্পে প্রথমে রেখে যাচাই করা হতো— সে পাকিস্তানি চর নাকি সত্যি যুদ্ধ করতে এসেছে। মাসখানেক রাখার পর বাছাই করে পাঠিয়ে দেওয়া হতো ইয়ুথ ক্যাম্পগুলোতে। মূলত সেখান থেকেই নেওয়া হতো ট্রেনিংয়ে।
তখন পদ নিয়ে এত মাথাব্যথা ছিল না। দেশের জন্য কাজ করছি— এটাই ছিল বড় কথা। ইউসুফ আলী সাহেব আমাকে খুব ট্রাস্ট করতেন। চাচা বলে ডাকতেন। ফলে মুজিবনগর সরকারের ভেতরের অনেক কথাও তিনি শেয়ার করতেন “
তখনই কি মুজিবনগর সরকারের ভেতরে বিভক্তি তৈরি হয়েছিল?
তিনি বললেন এভাব, “অলরেডি দুটা গ্রুপ তখন হয়ে গেছে। একটা গ্রুপ চাচ্ছিল কনফেডারেশন, পাকিস্তানের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে এই গ্রুপে ছিল মাহবুব উল আলম চাষী, শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ। দে আর লুকিং ফর সাপোর্ট।
আমি যাওয়ার পর ওরা বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনে সাপোর্ট করব না। ফলে মুজিবনগর সরকারে আমাকে যুক্ত করা নিয়ে তাদের এক ধরনের হেজিটেশনও ছিল। এ কারণেই হেডকোয়ার্টারে আমাকে রাখেনি ওরা।”
মোশতাক গ্রুপটি কী চাচ্ছিল?
“তাদের চিন্তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটো ফেডারেশনের মতো বানিয়ে দেওয়ার। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে কলকাতায় মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মোশতাক জাতিসংঘে যাবেন, পাকিস্তান থেকে সেখানে আসবেন শাহ আজিজুর রহমান, ওখানেই তারা কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন। ইন্ডিয়ান ইন্টিলিজেন্স এই খবরটি তাজউদ্দীন আহমদের কাছে পৌঁছে দিয়ে সাবধান করেন। তখন তিনিই স্ট্যান্ড নেন। খবরটা একেবারেই বাইরে ছড়াতে দেননি। আনঅফিসিয়ালি পরে খন্দকার মোশতাক ও তার গ্রুপটিকে নজরবন্দী করে রাখা হয়। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর এই মোশতাকই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র হয়েছিল।”
আপনাদের আর্থিক জোগানটা কীভাবে আসত?
তিনি বলেন, “একটা ফান্ড মুজিবনগর সরকারকে ভারতের সরকার দিত। আবার দেশের ভেতর কয়েক জেলায় ট্রেজারি ভেঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা টাকা বর্ডার পার করে ইন্ডিয়াতে নিয়ে এসেছিল। এছাড়া অনেক ব্যবসায়ীও আর্থিক সাহায্য করেছে। কিন্তু সরাসরি আমরা কারও কাছে টাকা চাইনি। হয়তো কেউ আমাদের কিছু পেনিসিলিন ইনজেকশনসহ ওষুধ দিয়েছে, আমরাও সেটা ক্যাম্প বা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
ওই সময় মুজিবনগর সরকারের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে মুনিরুজ্জামান অকপটে বলেন, “এই সরকারের ফ্রেমওয়ার্কটা না থাকলে স্বাধীনতাটা তত সহজ হতো না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করা, বঙ্গবন্ধুকে বিনা শাস্তিতে সশরীরে ফেরত আনাই ছিল আমাদের প্রধান কাজ। আমি বলব বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নবীজ বপন করেছিল মুজিবনগর সরকার।
পর্যাপ্ত লোকবল, অর্থ ও অভিজ্ঞ লোক ছিল না তখন। তা সত্ত্বেও এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারত সরকারকে স্বাধীন বাংলাদেশের কাঠামোটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধসহ পুরো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় একটা যোগসূত্র স্থাপন করেছিল তারা। তা না হলে আমাদের জনসাধারণের ভেতরও আস্থা ও মনোবলের অভাব ঘটত। পাশাপাশি স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ার ক্ষেত্রেও মুজিবনগর সরকারের বিশেষ ভূমিকা ছিল।”
স্বাধীনতা লাভের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান দেশে ফেরেন ১ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে। এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি সরকারি চাকরিতে ফিরে আসেন। ফাইন্যান্স মিনিস্ট্রির ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন।
আলাপচারিতায় উঠে আসে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গও। তিনি বলেন, “পৃথিবীতে খাদ্যের কারণে দুর্ভিক্ষ খুব কম হয়েছে। ওই সময় বাইরে থেকে আমরা খাদ্য পাচ্ছিলাম না। আমেরিকা খাদ্য দিতেও নানা শর্ত দিচ্ছিল। এছাড়া খাদ্য পাঠাতেও তারা অনেক দেরি করে। ওটাও ছিল আরেক রাজনীতি। আবার একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ তখন। ফলে যোগাযোগ ছিল ভঙ্গুর। এ কারণে সব জায়গায় খাদ্য পৌঁছানোও যায়নি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু বুঝে গিয়েছিলেন স্বাধীন দেশটাকে এগিয়ে নিতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হতে হবে। ফলে অনেকগুলো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত তার আমলেই হয়। চাষের জমি যেন সংকুচিত না হয় এ কারণে ওইসময় জমির মালিকানা সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। এ সরকারও সেটা বলবৎ রেখেছে। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়ে তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেন। ফলে এখনও তা বিদুৎ উৎপাদনের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। গ্যাসের কারণে ইউরিয়াসহ সার উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সারের সংকটে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ারও ঝুঁকি কমেছে।”
সরকারি চাকরি করলেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সরকারের নানা বিষয় নিয়ে কিছুদিন পত্রিকায় কলাম লিখছেন। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ওই খবর চলে যায় বঙ্গবন্ধুর কানে।
এরপর কী ঘটল?
মুচকি হেসে মনিরুজ্জামান বলেন, “১৯৭৪ সালের ঘটনা। চরমপত্র নামে একটা পেপার বেরোত তখন। ঢাকাইয়া ভাষায় ‘ছক্কু মিয়ার ডাইরী’ নামে সিরিজ লিখেছি। আট-দশটার মতো লেখা প্রকাশিতও হয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে ক্রিটিসাইজমূলক লেখা ছিল। যেমন কম্বল ও রিলিফের চাল চুরি হচ্ছে, এমন বিষয়ও লেখায় তুলে ধরেছি। লেখার চোটেই একদিন বঙ্গবন্ধু ডাকলেন।
আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন। এরপর বলেন, ‘এই তুই আমার বিরুদ্ধে লেখস?’
বললাম, ‘স্যার, আপনার বিরুদ্ধে তো লেখি না। কম্বল আর রিলিফ তো চুরি হচ্ছে। বদনাম তো আপনার হচ্ছে।’
তিনি একটু চুপ থাকলেন। অতঃপর বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে পলিটিক্স কর।’
বললাম, ‘স্যার, এক ঘরে তো দুই পীর হয় না। আমার বাবাও আপনার এমএনএ ছিলেন।’
তিনি তখন মুচকি হেসে বললেন, ‘যা চাকরি কর গিয়া।’
লেখার জন্য আমাকে কিছুই বললেন না। এই ঘটনা তো এখন কল্পনাই করা যায় না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাহাড়সম হৃদয়ের মানুষ। তখন নিজ থেকেই লেখা বন্ধ করি। তবে ইকোনমি নিয়ে লিখেছি অনেক।”
বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থ বিভাগে কাজ করেছেন। দেশ এখন কেমন চলছে বলে মনে করেন?
এই মুক্তিযোদ্ধার অকপট উত্তর, “আন্তর্জাতিক সূচকে দেশ অনেক এগিয়েছে। ব্যাপক উন্নতি হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। জীবনযাত্রার মানের উন্নতির কারণেই মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। কিন্তু সব বড় উন্নয়ন ঢাকাকে ঘিরেই হচ্ছে। এটা থেকে বেরোতে হবে। লক্ষ কোটি ঘন্টার সময় অপচয় হয় ঢাকার রাস্তায়। ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় পাবলিক বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কৃষিতে পরিবর্তন এসেছে কিন্তু মার্কেটিং সিস্টেমটা ডেভেলপ হয়নি। মধ্যস্বত্বভোগী কমাতে হবে। ক্রেতা আর কৃষক উভয়ই যেন লাভবান হয় সেই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।”
বিএনপির শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতের অভিযোগে চাকরি হারাতে হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। কষ্ট নিয়ে মনিরুজ্জামান বললেন সে ঘটনাটি। তার ভাষায়, “আমি তখন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় বিসিকের চেয়ারম্যান। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা চার্জও ছিল না। বরং পরবর্তী তিন মাসের ভেতর সচিব হওয়ার কথা ছিল। লিস্টে নামও উপরের দিকেই ছিল।
১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারির ঘটনা। গোপালগঞ্জে একটি প্রজেক্ট দেখতে যাই। কবি জসীম উদ্দীন স্মরণে মেলা হয় ফরিদপুরের কাছেই, বিক্রমপুরে। সেটি উদ্বোধন করে চলে যাই গোপালগঞ্জ। সেখানে বিসিক শিল্পনগরে কিছু প্লট বিতরণ ও একটা বেইলি ব্রিজ উদ্বোধন করি। এরপরই বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে যাই টুঙ্গিপাড়ায়।
বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করেছি— এ খবর দ্রুত চলে যায় ঢাকায়। খালেদা জিয়া সরকার এটি সহ্য করল না। চাকরি থেকে আমাকে বের করে দিল। ১ জানুয়ারি রাতে টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় ফিরি। ৪ জানুয়ারি চিঠি চলে আসে হাতে, লেখা— ‘সরকারি চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় আপনাকে অবসর দেওয়া হয়েছে।’
এরপর চাকরি ফেরত পেতে কোনো আবেদন করেছিলেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনিরুজ্জামান উত্তরে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাষ্ট্রপতি বরাবরও আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর সরকারেও কাজ করেছি। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে একটা জবাবও পেলাম না। এই কষ্টের কথা কাকে বলব! বিবেচনা না করলেও তারা তো সেটা বলেও দিতে পারত।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন সুস্থ দেহ আর সুস্থ মন না হলে উন্নত জাতি গঠন সম্ভব নয়। তার মতে স্বাধীন এই দেশটাকে আগামী প্রজন্মই এগিয়ে নেবে। শেষে তাদের উদ্দেশেই বললেন শেষ কথাগুলো, “তোমরা টেকনোলজির ব্যবহারে সর্তক থেকো। বছরে একটা হলেও গাছ লাগাও। তাহলে পরিবেশের সঙ্গে তোমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হবে। নিজের বিবেককে সদা জাগ্রত রেখো। বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলো। মানুষ মরণশীল, কিন্তু এই পৃথিবীতে তুমি তোমার অবদানটুকু অন্তত রেখে যাওয়ার চেষ্টা করো।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৯ জুলাই ২০২৪
© 2024, https:.