শালবনে আজব গাছের খোঁজ
প্রাকৃতিক নিয়মে শালবীজ পড়ে বন তৈরি হওয়ার কারণেই দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে বনটিকে প্রাকৃতিক শালবন বলা হয়ে থাকে। বনটি প্রায় দুই হাজার ৮৬৭ একর এলাকাজুড়ে। বনের মধ্যে শাল ছাড়াও রয়েছে আমলকী, সর্পগন্ধা, বহেড়া, হরীতকী, চিরতাসহ নানা ধরনের ঔষধি গাছ
শরতে নাকি শালবনের রূপ খোলে। সবুজ শালবনের মাঝে সবুজ ধানক্ষেত। দেখতে অন্য রকম লাগে। এমন দৃশ্যের গল্প শুনেই পা রাখি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়।
উপজেলার সীমান্তবর্তী কালিয়াগঞ্জে রয়েছে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক শালবনটি, জেলা শহর থেকে যা প্রায় ২০ কিলোমিটার ভেতরে।
আমরা পৌঁছি দুপুরের পরপরই। কালিয়াগঞ্জ বাজার থেকে বাঁ দিকে একটি রাস্তা ধরে এগোই। খানিকটা যেতেই দেখা মেলে বিশাল শালবনের।
রোদের আলোয় দূর থেকে তা জলরঙে আঁকা কোনো ক্যানভাস যেন।
প্রাকৃতিক নিয়মে শালবীজ পড়ে বন তৈরি হওয়ার কারণেই বনটিকে প্রাকৃতিক শালবন বলা হয়ে থাকে। বন বিভাগের বিট অফিসার তেমনটিই জানান। এই বনটি প্রায় দুই হাজার ৮৬৭ একর এলাকাজুড়ে।
বনের মধ্যে শালগাছ ছাড়াও রয়েছে আমলকী, সর্পগন্ধা, বহেড়া, হরীতকী, চিরতাসহ নানা ধরনের ঔষধি গাছ।
মুণ্ডা, ওঁরাও ও সাঁওতালদের বসবাস রয়েছে এই বনে। সন্ধ্যা হতেই শুরু হয় ডাকঢোলের বাদ্য। শালবনের ভেতরে আদিবাসী পাড়াগুলোতেও চলে নানা আচার।
বনের ভেতরের গাছগুলোতে অনেক পাখির কলকাকলি।
কোকিল, টিয়া, ঘুঘু, ময়নাও আছে। তাদের আনন্দ-আড্ডায় মুখরিত চারপাশ।
শালবনের মধ্যে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়াই। শিকড়ের খোঁজ নেই গাছটির। অজগর সাপ আকৃতির একটি গাছ জড়িয়ে রেখেছে বেশ কয়েকটি শালগাছকে। আজব এই গাছটির নাম কী? স্থানীয় এক আদিবাসী জানায়, এটি ‘বাদেনা’। কেন এমন নাম? এর উত্তর জানা নেই কারো। গহিন শালবনে এমন গাছ আছে আরো অনেক।
বনের ভেতর লাল মাটির উঁচু ঢিবির দিকে আমাদের চোখ পড়ে। স্থানীয়ভাবে এটিকে বলে উলুর ঢিবি। উলুপোকা মনের আনন্দে এমন অনেক ঢিবি তৈরি করে রেখেছে গোটা বনে। হঠাৎ চারপাশ থেকে অদ্ভুত ধরনের শব্দ হয়। মনে হচ্ছিল কিছু একটা ধেয়ে আসছে। আমরা ভড়কে যাই প্রথমে। আসলে এটি বাতাসে শালপাতা নড়ার শব্দ। মনে হচ্ছিল যেন পাতার মিছিল।
ছোট্ট একটি রেস্টহাউসও রয়েছে শালবনে। সেটিকে পেছনে ফেলে প্রবেশ করি পাশের শালবনে। এর নাম মিরাবন। বনের মধ্য দিয়ে খাল আকৃতির ছোট্ট নদী চলে গেছে ভারতের ভেতরে। স্থানীয়রা বলল, বনটিতে একসময় দেখা মিলত বাঘসহ হিংস্র সব জানোয়ারের। এখন শুধু মেলে শিয়াল, খরগোশ, বনমোরগ ইত্যাদির।
মিরাবনের জমিনে বিছিয়ে থাকা শালপাতা কুড়াচ্ছিল আদিবাসী নারীরা। ওঁরাও গোত্রের মলানী টিগ্গার কাছে জানতে পারি শালপাতার কথা। আদিবাসীরা এই পাতা দিয়ে তৈরি করে হাড়িয়া খাওয়ার চোঙ আর অতিপ্রিয় পাতার বিড়ি। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসবে খিচুড়ি খাওয়ার ঠোঙাও তৈরি হয় শালপাতা দিয়ে।
মিরাবন থেকে চলে আসি ভটিয়া বনে। কারমা উৎসবে এই বনের একটি গাছের ডাল কেটে নিয়ে পূজা করে আদিবাসীরা। গাছটির নাম খিল কদম। সবার কাছে এটি অতি পবিত্র। মনোযোগ দিয়ে দেখি গাছটিকে।
শালবনের আজব গাছ, শালপাতার শব্দ ও লাল মাটিতে উলুর ডিবি ভ্রমণপ্রেমীদের আন্দোলিত করবে। কিন্তু কালিয়াগঞ্জের ন্যাচারাল শালবনটিতে ভ্রমণপ্রেমীদের আনাগোনা খুবই কম। কেন? বন বিভাগের বিট অফিসার বললেন, এই শালবনটির প্রচার নেই তেমন। সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকা এবং যোগাযোগব্যবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ায় পর্যটকদের কাছে এটি এখনো তেমন পরিচিতি পায়নি। তবে শালবনের ভেতর কটেজ তৈরি ও খাওয়াদাওয়ার ভালো ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিলে ন্যাচারাল এই শালবনটি পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠে, প্রকাশকাল: ১৪ অক্টোবর ২০২৪
© 2024, https:.