মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই প্রকৃত গণতন্ত্র
একাত্তরে পাকিস্তানে আটকা পড়া এয়ারফোর্সের বাঙালি অফিসাররা মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭৪ সালে। এসেই তারা বিমানবাহিনীতে পজিশনসহ সবকিছু পেয়ে যান।
“পাকিস্তানের রিসালপুরে একবার প্যারেড হবে। সেখানে যোগ্যতার ক্যাটাগরিতে টপ ছিলাম। ফলে সোর্ড অব অনারের জন্য মনোনীত করা হয় আমাকে। সোর্ড নিয়ে প্যারেডও করেছি কয়েকদিন। কিন্তু শেষমুহূর্তে অজ্ঞাত কারণে ওরা সিদ্ধান্তটি বদলে ফেলে। আমাকে সোর্ডও দেওয়া হয় না। বুঝে যাই বাঙালি হওয়াটাই ছিল অপরাধ। মনের ভেতর এক ধরনের কষ্ট আর ক্ষোভ জমা হতে থাকে।
শুরু থেকেই বৈষম্যটা ছিল। কিন্তু ভালো রেজাল্ট দিয়ে আমরা তা কাটিয়ে উঠতাম। এভাবে নানা কম্পিটিশনে টপকে যেতাম ওদের। সেটা ওরা মেনে নিতে পারত না। ওটাই ছিল আমাদের ভেতরের যুদ্ধ। মূলত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধটা তখন থেকেই শুরু।
সত্তরের নির্বাচন তখন হয়ে গেছে। আমি পাইলট অফিসার। জাঙ্গল সারভাইভার কোর্স করছি পাকিস্তানের মারিতে, নাথিয়াকালী নামক জায়গায়। কোর্স শেষে একটা সেলিব্রেশন পার্টি হয়। পার্টি শেষ হওয়ার আগেই চলে যাই রুমে।
এক রুমে ছিলাম তিনজন। আমি ছাড়া বাকি দুইজন পাঞ্জাবি— খুরশিদ ও তাহের। ওরা রাতে খুব ড্রিঙ্ক করে ফেরে। রুমে এসেই হৈ চৈ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে গালাগাল করে বলে, ‘বেটা হিন্দু কা বাচ্চা’।
প্রথম সহ্য করতে থাকলাম। বললাম, ‘বাছ কারো ভাই, বাছ করো’।
ওরা থামল না। বলে, ‘তু শালা বাঙ্গাল। মুজিবকা বাচ্চা’।
আর সহ্য করতে পারলাম না। রুমে একটা লাঠি পাই। সেটা দিয়েই ওদের পেটাতে থাকি। এমনটা করব ওরাও ভাবতে পারেনি, অবাক হয় খুব।
পূর্ব পাকিস্তান তখন উত্তপ্ত। বঙ্গবন্ধুকে গালি দেওয়ার প্রতিবাদ করায় বিমানবাহিনীতে শাস্তি দেওয়া হয়েছে— এটি জানাজানি হয়ে গেলে পলিটিক্যাল ইস্যু তৈরি হবে। মূলত এটা চিন্তা করেই আমাকে ওরা শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকে। এরপরই ফ্লাইং অফিসার হয়ে যাই। পোস্টিং হয় নাইটিন স্কোয়াড্রনে।
২৫ মার্চে বাঙালিদের ডেকে ওরা বলল, ‘পুর্ব পাকিস্তানে একটু ঝামেলা হচ্ছে তোমরা আপাতত ফ্লাইং থেকে বাইরে থাক’। কয়েকদিন পরই বলল, ‘তোমরা বাইরে যেও না। মেসেই থাকবে সবাই’। বেসিক্যালি হাউজ অ্যারেস্টের মতো করে রাখে।
মাসখানেক কেটে গেল। দেশে ফিরতে চাইলাম। কিন্তু কোনো পূর্ব পাকিস্তানিকেই ছুটি দিচ্ছিল না তখন।”
একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম)।
লিয়াকত আলী খান বসবাস করছেন কানাডায়। মাস সাতেক আগে দেশে আসলে তখন তার মুখোমুখি হই।
পিতা আতাহার আলী খান আর মায়ের নাম আজিজা খাতুন। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে লিয়াকত সবার বড়। বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার দৈবগ্যহাটি গ্রামে। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা প্রসঙ্গে।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বাগেরহাটের হাজী আরিফ প্রাইমারি স্কুলে। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। পরে পরীক্ষা দিয়ে চান্স পান এয়ারফোর্স ক্যাডেট কলেজে, পাকিস্তানের লোহারটোপায়। ওখান থেকে ম্যাট্রিক পাশের পরেই যোগ দেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে। এয়ারফোর্স নম্বর-৫১২১।
এয়ারফোর্সে লিয়াকতদের আড়াই বছরের ট্রেনিং হয় পাকিস্তানের রিসালপুরে। গ্রাজুয়েশন করে তিনি পাইলট অফিসার হন ১৯৬৮ সালের ১৩ জুন। পরে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পেশোয়ারে, ফাইটার কনর্ভাশনে। সেখানে নামকরা স্যাবর জেট চালানোরও ট্রেনিং হয় তার। এরপরই তিনি ফ্লাইং অফিসার হয়ে যান।
পরে কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন তিনি?
লিয়াকত বললেন যেভাবে, “আমাদের বেইজ কমান্ডার ছিলেন এয়ার কমোডর চৌধুরী রব নেওয়াজ। রিসালপুরে তার অধীনেই কাজ করেছি। তার ছেলে পারভেজ চৌধুরী ছিল আমার কোর্সমেট।
আব্বাকে চিঠি লিখে জানালাম মায়ের অসুস্থতার কথা লিখে যেন টেলিগ্রাম করেন। তিনি তাই করলেন। টেলিগ্রাম হাতে পেয়েই চলে যাই রব নেওয়াজের বাড়িতে।
সব শুনে উনি বললেন, ‘উপরের নির্দেশ, পূর্ব পাকিস্তানি কাউকেই ছুটি দেয়া যাবে না। আমি তো কিছু করতে পারব না।’
হাল ছাড়ি না। শেষে একদিন কান্নাকাটি শুরু করি। তখন তিনি আমাকে থামালেন। এয়ার সেক্রেটারিকে ফোন করে আমার মায়ের অসুস্থতার কথা জানান এবং ছুটি শেষে ফিরে আসব এই গ্যারান্টি তিনি নিজেই তাকে দেন।
মূলত তার সহযোগিতাতেই এক সপ্তাহের ছুটি মেলে। মে মাসের তিন তারিখে একটা ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটে চলে আসি ঢাকায়। ওই এয়ারক্রাফটে সিভিল পোশাকে সবাই ছিল পাকিস্তানি সেনা। বুঝে যাই পূর্ব পাকিস্তানে ওরা খুব রক্তক্ষয়ী কিছু ঘটাচ্ছে।”
ঢাকায় এসে লিয়াকত ওঠেন ইস্কাটন গার্ডেনে, খালার বাড়িতে। তার বড় খালু আব্দুর রব ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন কমার্স সেক্রেটারি। তার ছেলে রুবি ফারুক নেভির কমান্ডার। পাকিস্তানের চাকরি করলেও রুবি’র সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ ছিল।
তার মাধ্যমেই লিয়াকত চলে যান ভারতে, কলকাতায়।
লিয়াকতের ভাষায়, “থিয়েটার রোডে গিয়েই বাঙালি এক অফিসারকে পাই। তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন নূর, কর্নেল ওসমানীর কমান্ডিং অফিসার। এয়ারফোর্স অফিসার মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করতে আসছি শুনেই অবাক হয়ে বললেন, ‘কিছুদিন পর এয়ারফোর্স গঠন হবে। সেখানে জয়েন করেন।’
কিন্তু অপেক্ষা করতে রাজি হলাম না। তার মাধ্যমেই পরদিন সকালে ওসমানী সাহেবের সাথে দেখা করি। সব শুনে তিনিও নিরুৎসাহিত করে বলেন, ‘তুমি ফাইটার পাইলট। কেন ফিল্ডে যেতে চাও?’ পরে আমার আগ্রহ দেখে জয়েন করতে বললেন।”
মে মাস তখনও শেষ হয়নি। জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে লিয়াকতকে জয়েন করতে বলা হয়। ফাইটার পাইলট পরিচয় শুনেই জিয়া বললেন, ইনফ্রেন্টিতে কী করবে? আগ্রহ দেখে তিনিও পরে রাজি হন। লিয়াকতের পোস্টিং দেন ফার্স্ট বেঙ্গলে।
বাকি ইতিহাস শুনি লিয়াকতের মুখেই।
তিনি বললেন এভাবে, “পরদিনই প্লেনে জিয়াউর রহমান ও ৪-৫ জন অফিসারসহ চলে আসি গৌহাটিতে। সেখান থেকে গাড়িতে করে যাই তুরায়। জেড ফোর্সের হেডকোয়ার্টার ছিল তেলঢালা নামক জায়গায়। সেখানে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমেদ (পরে বীরবিক্রম উপাধি পান) ছিলেন সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডার। আরও পাই মেজর মঈনুদ্দিন আহমেদকে। তিনি তখন ফার্স্ট বেঙ্গলের সিইও।
এয়ারফোর্সের লোক আর্মিতে এসেছি শুনে প্রথমে ঠাট্টা করে সবাই। তখন পোস্টিং দেয়া হয় এজ অ্যাডজুটেন্ট অব ফার্স্ট বেঙ্গল। পাশাপাশি হেডকোয়ার্টার কোম্পানিরও কমান্ড করতে হয়েছে। তবে তার আগে কিছু ট্রেনিংও নিতে হয়। ফিল্ডের যুদ্ধে অ্যাম্বুশসহ অস্ত্র মেইটেন বিষয়ে আমাকে ট্রেনিং দেয় ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মাহবুব ও কাইয়ুম।”
তাদের কাছে জুনে একটা অর্ডার আসে— ‘ফার্স্ট বেঙ্গল উইল অ্যাটাক কমলপুর বিওপি’।
লিয়াকতের ভাষায়, “ফার্স্ট বেঙ্গলে রেগুলার ট্রুপস ছাড়াও বাকি সবাই ছিল সাধারণ ছেলে। তত ভালো ট্রেনিংও তখন ছিল না। তবে বুকভরা ছিল সাহস। সেটাকে পুঁজি করেই কমলপুর বিওপি অপারেশনে যাই।
চারটি কোম্পানি নিয়ে অ্যাটাক করি আমরা। পরিকল্পনা হয় সালাহউদ্দিনের ডেল্টা কোম্পানি লিড করবে, হাফিজের ব্রাভো তাদের সার্পোটে থাকবে, মান্নানের আলফা কোম্পানি স্ট্যান্ডবাই থাকবে আর মাহবুব তার চার্লি কোম্পানি নিয়ে কাট-অফ পার্টি হিসেবে কাজ করবে। হেডকোয়ার্টার কোম্পানি নিয়ে আমি ছিলাম একটু পেছনের দিকে।
আমাদের গ্রুপগুলো অ্যাডভান্স হয়ে পাকিস্তানিদের বাঙ্কারের প্রথম ও দ্বিতীয় লেয়ার পর্যন্ত চলে যায়। ভারতীয় মিত্রবাহিনী আর্টিলারি সার্পোট দেবে। কিন্তু তাদের আর্টিলারি ছোড়ার আগেই নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। যেটা করতে আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ হই।
নিয়মটা হলো আর্টিলারি শত্রুর কাছাকাছি বা উপরে গিয়ে পড়বে। তখন ওদের হেডস ডাউন হয়ে যাবে। সামনেও এগোতে পারবে না। বরং বাঙ্কারে চুপসে থাকবে। ওইসময় আমরা রেডি হয়ে এগোতে থাকব। আর্টিলারি থেমে গেলেই ওরা মাথা তুলতে চাইবে। ঠিক তখনই আমরা আক্রমণ করব।
আমরা ছিলাম শত্রুদের থেকে বেশ দূরে। ফলে বোম্বিং শেষ হয়েও অনেকটা সময় চলে যায়। আর পাকিস্তানিরা তখন আরামসে উঠে মেশিনগান নিয়ে রেডি হয়ে থাকে। আমরা তখন বোকার মতো ওদের ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতর চলে আসি।”
খানিক থেমে তিনি আরও বলেন, “সালাহউদ্দিন দারুণ সাহসী ছিল। চোঙা হাতে নিয়ে সে ট্রুপসদের বলছিল, সামনে আয়, সামনে আয়। ভয় করিস না কেউ।’ যখন গোলাগুলি চলছে তখন সে আরও ম্যানপাওয়ার চাইল। সিইও মঈন সাহেব আমাকে নির্দেশ দিতেই হেডকোয়ার্টার ট্রুপস নিয়ে ছুটে যাই।
পাকিস্তানিদের মর্টার পড়ছে। বারুদের গন্ধ চারপাশে। কুণ্ডুলি পাকানো ধোয়া। কেউ কেউ চিৎকার করছে। এর ভেতর দিয়েই সালাহউদ্দিনের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি।
অন্ধকার কেটে ভোর হয়ে আসে। কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে ওয়্যারলেস বহনকারী একজন সিগন্যালম্যান থাকে। দেখলাম সালাহউদ্দিনের সিগন্যালম্যানের ওপর একঝাঁক গুলি এসে পড়েছে। সাথে সাথে সে মাটিতে পড়ে যায়। এরপরই মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে সালাহউদ্দিন। খানিক পরেই তার দেহটা নিথর হয়ে থাকে।
সবকিছু চোখের সামনেই ঘটছে। কী করব? বুঝে উঠতে পারছি না। ক্রলিং করে এগোনোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ একজন ডাকছে, ‘লিয়াকত, লিয়াকত’।
একপাশে তাকিয়ে দেখি মান্নান দূরে মাটিতে পড়ে গোঙ্গাচ্ছে। তার পা দুটি রক্তে ভেজা। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখি মান্নানের দুই উরু গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তাকে কাঁধে তুলে নিলাম। তখনই কমান্ডার চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘কাম ব্যাক, কাম ব্যাক’। মানে অপারেশন উইথড্র।
মান্নানকে নিয়ে ব্যাকে চলে এলাম। সালাহউদ্দিনের মৃতদেহ পড়ে থাকে বর্ডারের কাছে, ধানক্ষেতের আইলে। পাকিস্তানিদের গুলি তখনও থামেনি। কিছুদূর আসতেই দেখি জিয়াউর রহমানকে। দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে তিনি বলছেন, ‘সাবাস, সাবাস জোয়ান।”
ওই অপারেশনে অনেক ক্ষতি হয় তাদের। ৭৫ উইনডেড, ৩৫ ডেড।
অগাস্টের শেষের দিকে লিয়াকতদের জেড ফোর্স চলে যায় সিলেটের কাছাকাছি, ভারতের কমলগঞ্জে। ফার্স্ট বেঙ্গলের সিইও চেঞ্জ হয়ে ওইসময় কমান্ডার হয়ে আসেন জিয়াউদ্দিন। তিনি এসেই ফার্স্ট বেঙ্গলে পুরো ট্রেনিং ও পরিকল্পনায় দারুণ পরিবর্তন আনেন। অস্ত্র ট্রেনিং ও অ্যাম্বুশের ওপরও প্রশিক্ষণ করানো হয়।
এরপর কী ঘটল?
মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত বললেন যেভাবে, “নভেম্বরের দিকে মিত্রবাহিনীসহ ভেতরে আসা শুরু করি। সঙ্গে তখন ভারতের ফোরটিন রাজপুত রাইফেলস ও সেকেন্ড জাট ব্যাটেলিয়ান ছিল। পরে জকিগঞ্জের দিক দিয়ে এসে কানাইঘাট সুরমা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থান নিই। পাঞ্জাবিদের একটা ব্যাটেলিয়ানের পজিশন ছিল ওয়েস্টে।”
ওখানের অপারেশনেই রক্তাক্ত হন বীর উত্তম লিয়াকত আলী খান।
কী ঘটেছিল ওখানে?
তিনি বলেন, “২৬ নভেম্বর ১৯৭১। রাতের বেলায় ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি পেছন দিক দিয়ে এসে অ্যাটাক করার চেষ্টা করে। সুরমা নদীর পাড়ে পজিশনে ছিল মাহবুবের চার্লি কোম্পানি। হঠাৎ পাকিস্তানিরা ওদের পেছন দিক থেকে অ্যাটাক করে। ডেল্টা কোম্পানির ১২ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন ওয়াকার হাসান।
তার প্লাটুন ছিল কাছাকাছি। তিনি দ্রুত এসে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা অ্যাটাক করেন। ফলে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি এক মেজরও মারা যায় সেখানে। ওরা তখন মরিয়া হয়ে ওঠে। ওয়াকার ওদের পুরোপুরি ঠেকাতে পারে না। ওরা তবুও এগোয়।
পাশ কাটিয়ে নদীর দিকে আসার চেষ্টা করে। মাহবুবের চার্লি কোম্পানি তাদের ঠেকিয়ে দেয়। এর মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা বোম্বিং শুরু করলে মাহবুব আহত হয়। কয়েকটা শেল লাগে তার পেটে।
সিইও জিয়াউদ্দিনের কাছে এ খবর এলেই তিনি আমাকে টেক ওভার করতে বলেন। আমি হেডকোয়ার্টার কোম্পানি নিয়ে গোলাগুলির ভেতর দিয়েই নদীর পাড়ে চলে যাই। স্ট্রেচারে করে মাহবুবকে তখন সরিয়ে নেয়া হয়।
আমি গিয়ে মেশিনগানগুলো রিসেট করে পজিশন চেঞ্জ করে দিই। সবাইকে গাইড করতে থাকি। একটা মেশিনগানে নিজেও ফায়ার করছি। পাকিস্তান সেনারাও এগোনোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ, আই গট এ বুলেট। কিন্তু কোনো ফিল করতে পারিনি। বাঁ পায়ের উরুতে লেগে গুলি পেছনে হিপ দিয়ে বের হয়ে যায়। রক্ত পড়ছিল অনবরত। খানিক পরই জ্ঞান হারাই।
আমার অপি (অবজারভেশন পোস্ট) ছিল এক ইন্ডিয়ান আর্মি। সে খেয়াল করল আমার মেশিনগানের শব্দ নেই। ক্রল করে কাছে এসে দেখে মাটিতে পড়ে আছি। তখনই আমাকে তুলে সোলজার দিয়ে কানাঘাট নদীর কাছে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়।
প্রাথমিক চিকিৎসা হয় জকিগঞ্জের কাছে। তখন জ্ঞান ফেরে। পরে সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রথম করিমগঞ্জ এবং পরে শিলচর ফিল্ড হাসাপাতালে।”
সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করলেও বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে লিয়াকত ফেরেন এয়ারফোর্সে। তিনি বললেন এভাবে, “এয়ারফোর্সে জয়েন করতে চাইলে জিয়াউদ্দিন সাহেব বললেন, ‘বিমানে কি আছে। তুমি আমাদের সাথেই থাকো।’
বললাম, ‘আমি এয়ারফোর্সের লোক। ফাইটার স্কোয়াড একটা বানাতে হবে।’
তখন ১৪টার মতো শেভর জেট ছিল। যার অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মার্চের মধ্যেই এনসিওরা ৩-৪টি রেডি করে ফেলে। তখনই প্ল্যান করি ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফ্লাইং পাস দেব। ৩টা জাহাজে ফ্লাইং পাস দিই আমরা। সদরুদ্দীন সাহেব ফ্লাইটটা লিড করেন, আমি আর কাদের ছিলাম দুটোতে।
তখন এয়ারফোর্সের চিফ ছিলেন খন্দকার সাহেব (এ কে খন্দকার)। সদরুদ্দীন সাহেব প্রমোশন পেয়ে বেইজ কমান্ডার হয়ে গেলে পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে জয়েন করেন শওকত সাহেব। ফাইটার স্কোয়াডের দায়িত্ব নেন তিনি। তার পরই ছিল আমার অবস্থান। তখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। পরে স্কোয়াড্রন লিডার পর্যন্ত হয়েছিলাম।”
একাত্তরে পাকিস্তানে আটকা পড়া এয়ারফোর্সের বাঙালি অফিসাররা মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭৪ সালে। এসেই তারা বিমানবাহিনীতে পজিশনসহ সবকিছু পেয়ে যান। এটা কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল বলে মনে করেন?
লিয়াকত আলী খান অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি, “এয়ারফোর্স তো তখন ছোট। সেটা বাড়াতে হলে তাদেরও নিতে হবে। এই যুক্তিতে এটা ঠিক আছে। এরইমধ্যে যারা মুক্তিবাহিনীতে ছিলেন তাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়। কিন্তু তারা ফেরত আসার পর এটা নিয়ে একটা টেনশনও সৃষ্টি হলো।
তাদেরকে যার যে পজিশন ও র্যাঙ্ক ছিল তাই-ই দেওয়া হয়। প্লটসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও তারা পায়। শুধু দুই বছরের সিনিয়রিটি ছিল না। তাদের মধ্যে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস, গ্রুপ ক্যাপ্টেন শওকত, উইং কমান্ডার রকিব, আলতাফ চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। এরপর মুজিববাহিনীকেই রক্ষীবাহিনী করে ফেলা হলো। তখন অনেকের ভেতরই হতাশা তৈরি হলো। এসব ঘটনা আমাদের ভেতরও ডিভাইডেশন তৈরি করে দেয়।”
দেশ কেমন চলছে?
এই বীর উত্তম বলেন, “করাপশন অনেক বেড়েছে। ঘুষ দিতে হবে এবং ঘুষ দিয়েই কাজ এগিয়ে নিতে হবে— এটা এখন কালচার হিসেবেই দাঁড়িয়ে গেছে। এটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করবে। দায়িত্বশীল জায়গায় সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীলদের রাখা জরুরি। আর সেক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া একেবারেই অর্থহীন।”
এই বীর উত্তমের স্বপ্নগুলো আর্বতিত হয় স্বাধীন এই দেশটাকে নিয়ে। তিনি মনে করেন তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও ত্যাগের ইতিহাসটা জানাতে হবে। তবেই তাদের ভেতর তৈরি হবে দেশপ্রেম।
প্রজন্মের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম) বললেন শেষ কথাগুলো, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই প্রপার ডেমোক্রেসি। যেখানে যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় স্থান দিতে হবে। ধর্মান্ধতা ও উগ্রতা নয়, সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না হলে তোমরাও তোমাদের প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। আমার বিশ্বাস স্বাধীন এই দেশটাকে তোমরাই সত্যের পথে এগিয়ে নেবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ অক্টোবর ২০২৪
© 2024, https:.