ভাটিয়াপাড়ার অপারেশন
“দশ পনেরো মিনিট পর গুলি থামল। নিঃশব্দে উজানে একটু এগোলাম, যেদিক থেকে গুলি হচ্ছিল। আবছা আলোতে খালের পাড়ে কোন মানুষ দেখা যাচ্ছিল না।”
বাঙালিকে চিহ্নিত করা হত ‘মাটির মানুষ’ হিসেবে। বলা হত, ‘এরা মার্শাল রেসের যোগ্য না।’ কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় প্রমাণিত হয়েছে কথাটা ঠিক নয়। বাঙালি রুখে দাঁড়াতে সামান্যও দ্বিধা করে না, রাইফেলের গুলিকেও ভয় পায় না।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন, প্রত্যেকবার বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে। সমগ্র জাতি যেন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীন দেশ অর্জনের লক্ষ্যে।
নানা তথ্য দিয়ে এভাবেই আলাপচারিতা শুরু করেন বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসরুর-উল হক সিদ্দিকী (কমল সিদ্দিকী)। তার পিতার নাম জহুর আহমেদ এবং মাতা ওয়াজেদা আহমেদ। গ্রামের বাড়ি মাগুরায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কমল সিদ্দিকী ওয়াপদার (বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড) সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
একাত্তর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা ছেড়ে প্রতিরোধে যুক্ত হতে হবে, এই সিদ্ধান্তের মূল কাণ্ডারি ছিলেন ছায়ানটের কর্ণধার প্রয়াত ওয়াহিদুল হক। আমার বাড়ি সীমান্ত এলাকায় হওয়াতে ঠিক হল আমরা মাগুরা যাব, পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে যেন ভারতে গিয়ে সহায়তা কামনা করতে পারি। সব গোছগাছ করে ২ এপ্রিল আমরা ঢাকা ছাড়লাম।
মাগুরায় পৌঁছে দেখলাম মহকুমা প্রশাসক ওয়ালি, নড়াইলের ডক্টর কামাল সিদ্দিকী, ঝিনাইদহের পুলিম কর্মকর্তা মাহবুব, মেহেরপুরে তৌফিক এলাহি চৌধুরী, এরা সবাই বিদ্রোহ করেছে এবং যশোর সেনানিবাসের সন্নিকটে সশস্ত্র প্রতিরোধ চলছে। ঝিনাইদহের প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। ৪ এপ্রিল মেহেরপুর হয়ে ভারতের বেতাই নামক বিএসএফ ঘাঁটিতে পৌঁছাই।
ওখানে গিয়েই যুদ্ধের মাঠে অবতীর্ণ হননি কমল সিদ্দিকী। তিন মাস মুজিবনগর সচিবালয়ে নিযুক্ত ছিলেন। পরে একাত্তরের অগাস্ট মাসের দিকে তিনি এক মাসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন।
বাকি ইতিহাস শুনি এই বীর উত্তমের মুখেই।
তার ভাষায়, আমাকে বয়রা সীমান্তের ক্যাম্পে সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (বীর বিক্রম) অধীনে গণবাহিনী ৪ এ নিয়োগ দেওয়া হয়। একটা খালের পশ্চিমপাড়ে ছিল মুক্তাঞ্চল এবং আমাদের ক্যাম্প। আর পূর্বদিক পাকিস্তানি এক প্লাটুনের অধিকৃত গ্রাম। আমরা ওদের অবস্থান জানি আর ওরাও আমাদের অবস্থান জানে। সংঘর্ষে যেতে হলে খাল পার হতে হবে। কিন্তু ভরা বর্ষায় খাল তো প্রায় নদী।
যাহোক, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যে গুপ্তচর মারফত খবর আসলো প্লাটুন এক সঙ্গে নয়, তিনটি সেকশনে বিভক্ত হয়ে নিকটবর্তী তিন ক্যাম্পে আছে। সংখ্যায় বেশি হলেও অস্ত্রে আমরা ছিলাম দুর্বল। থ্রি নট থ্রি আর ভারতীয় কয়েকটা এসএলআর, শুধু আমার কাছে ছিল একটা চাইনিজ এসএমজি। পরিকল্পনা ছিল মাঝরাতে প্রায় একশ গেরিলা খাল পার হব এবং ভোর রাতে সরেজমিন ওদের ক্যাম্পের অবস্থান নির্ণয় করে অবস্থা বুঝে ঘিরে সারপ্রাইজ আক্রমণ করবো।
ওরা দশজন আমরা একশ। হায়রে সারপ্রাইজ! আমাদের পানিতে নামার শব্দ শুনে ওপার থেকে ওরা গুলি ছোড়া শুরু করে। গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আমরা। মাথার ওপর দিয়ে, কানের পাশ দিয়ে গুলি যাচ্ছে সশব্দে। এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। আমরা নীরবে রইলাম, ওদের গুলি খরচ হোক। দশ পনেরো মিনিট পর গুলি থামল। নিঃশব্দে উজানে একটু এগোলাম, যেদিক থেকে গুলি হচ্ছিল। আবছা আলোতে খালের পাড়ে কোন মানুষ দেখা যাচ্ছিল না। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের রাইফেলগুলো একসাথে গর্জে উঠল এবং অপরপক্ষ বিস্ময়করভাবে নীরব।
ওরা হয়ত ভেবেছিল বাঙালিরা খাল পার হয়ে ওদের ক্যাম্প আক্রমণ চালাবে, হয়তো তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আরও দশ পনেরো মিনিট পরে আমরা পানি থেকে উঠে ক্যাম্পে ফেরত এলাম। দুদিন পর খবর এলো ওই ক্যাম্প থেকে সরে গিয়ে তারা পূর্বদিকে পশ্চাদপসরণ করেছে। আমি সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণবাহিনী ৪-এর অধিনায়ক হিসেবে অপারেশন করেছি যশোর সদর, নড়াইল এবং ফরিদপুর সদরে। এটি ছিল সেক্টর নম্বর আট। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এম এ মঞ্জুর।
একাত্তরে ভাটিয়াপাড়াতে একটা ওয়্যারলেস স্টেশন ছিল। যেটা মুক্তিযোদ্ধারা দুই মাস ঘেরাও করে রাখে। ফলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ডিজেল শেষ হয়ে আসছিল। ডিজেল সরবরাহ প্রতিহত করায় সবাই উজ্জীবিত এবং আট নম্বর সেক্টরের কমান্ডার থেকে নির্দেশ আসে যে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ওয়্যারলেস স্টেশন চারদিক থেকে আক্রমণ করে আটকে পড়া প্রায় ৫৫/৬০ জন পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার। সেটি সম্ভব হলেও ওই অপারেশনেই রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা কমল সিদ্দিকী।
কী ঘটেছিল ওইদিন? তিনি বলেন, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। ক্যাপ্টেন হুদা ভাটিয়াপাড়া অভিযানে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন যাতে মর্টার, এলএমজিসহ বাকি সব অস্ত্র আমাদের বহরে সংযুক্ত হতে পারে। কারণ তখন আমাদের বাহিনীর তেমন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল না, এবং ভাটিয়াপাড়া ছিল আমার এখতিয়ার বহির্ভূত গোপালগঞ্জ মহকুমার অংশ।
সিদ্ধান্ত হল যে, আমরা তিন দিক থেকে ঘিরে রাখব (পশ্চিমে গড়াই-মধুমতি নদী) এবং ভোর রাতে মাইকিং করব উর্দুতে যে আমরা দুজন অফিসার আছি, আত্মসমর্পণ করলে সামরিক প্রথার সবকিছু সম্পন্ন করা হবে। তখন পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইত না, চরম লাঞ্চনার ভয়ে; যার মধ্যে পর্দানশিন গৃহবধুদের ঝাঁটার বাড়িও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে কোন অফিসার থাকলে ওরা ভরসা পেত যে আইনানুগভাবে তাদের প্রতি আচরণ করা হবে। পরিতাপের বিষয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মাইক জোগাড় করতে পারল না। ১৯ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফুটতেই পাকিস্তানি সেনারা ঘন কুয়াশা সত্ত্বেও বুঝলো যে তারা বেষ্টিত হয়ে আছে। ফলে পাগলের মত গুলির বৃষ্টি শুরু করল।
ক্যাপ্টেন হুদা এক গাছের পেছনে এবং বাঁ দিকে আরেক গাছের পেছনে আমি শুয়ে। এর মধ্যে ফ্লাক্সে চা এলো, আমি কয়েক চুমুক খেয়ে সেটা গড়িয়ে হুদা ভাইয়ের দিকে পাঠালাম। আমার মাথার কিছু অংশ তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়েছিল। ফলে হঠাৎ একটা গুলি এসে আমার কপাল ও চোখকে বিদ্ধ হয়।
সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারাই। সহযোদ্ধারা চিকিৎসার জন্য আমাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। ২০ ডিসেম্বর জ্ঞান ফেরে আমার। ফলে মাঝে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় উল্লাস আমার কাছে ছিল অজানা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
© 2024, https:.