মুক্তিযুদ্ধ

নৌ-কমান্ডোদের নারায়ণগঞ্জ অপারেশন

আমিসহ ৪০ জনকে বলা হলো একটা গ্রুপ করা হবে, যারা অপারেশনে গেলে মরতেও হতে পারে। আমরা রাজি হয়ে যাই, মরতে হলে দেশের জন্য মরমু।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো মো. মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক) বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সাতঘড়িয়া গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণগাঁও হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র

প্রশিক্ষণে যাওয়া নিয়েই একাত্তর প্রসঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, মে মাসের শেষের দিকে এক দুপুরে খেলার কথা বলে বের হই। পাশের গ্রামের শহিদুল ইসলাম ছিল পথপ্রদর্শক। ভারতে যাওয়ার পথ চিনত সে। ফরিদপুর দিয়ে যশোর হয়ে ভারতের চব্বিশ পরগনায় যাব। কিন্তু বাগদা সীমান্ত পার হওয়ার আগেই সঙ্গের দুই বন্ধু মত পাল্টাল

তারা বাড়িতে ফেরত গেল আরেকজন ভারতে গিয়ে আর প্রশিক্ষণে যেতে চাইল না তখন আমি একা কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল লোকমুখে ঠিকানা জেনে বাসে উঠে বসি পকেটে টাকা নেই ভাড়া দিতে না পারায় মাঝপথেই নেমে যেতে হয় পরে হেঁটেই চলে যাই বনগাঁ, টালিখোলা ক্যাম্পে সেখানে বিকেলের দিকে লাইনে দাঁড়াতেই নিয়ে নিল প্রায় দুই সপ্তাহ লেফটরাইট আর ক্রলিং করানো হয় ওই ক্যাম্পে

নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ কি ওই ক্যাম্পেই হয়েছিল? না টালিখোলা ক্যাম্পে একদিন আসেন ওসমানী সাহেব সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান একাত্তরে আটজন বাঙালি সাবমেরিনার জাহাজ আনতে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে তারা ওখান থেকেই পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে চলে আসেন ভারতে তারাও ওইদিন ওসমানীর সঙ্গে আসেন প্রথমে সবাইকে ফলইন করানো হয় পরে বাছাই করা হয় ৬০ জনকে মেডিকেল টেস্টে বাতিল হয় ২০ জন আমিসহ ৪০ জনকে বলা হলো একটা গ্রুপ করা হবে, যারা অপারেশনে গেলে মরতেও হতে পারে আমরা রাজি হয়ে যাই, ‘মরতে হলে দেশের জন্য মরমু

আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নদীর পাড়ে। ওটা ছিল পলাশীর প্রান্তর। অন্যান্য ক্যাম্প থেকেও বাছাই করে আনা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের।অপারেশন জ্যাকপটেআমরা ছিলাম সুইসাইডাল স্কোয়াড। প্রশিক্ষণের শুরুতেই একটা ফরমে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান নেভি প্রশিক্ষণ দেয়

মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক), ছবি: সালেক খোকন

প্রথমদিকে প্রত্যেককে পায়ে ফিনস পরে চিৎ সাঁতারের অভ্যাস করানো হয়। বুকে গামছা বেঁধে কেজি ওজনের মাটির ঢিবি বা ইট বেঁধে নদীতে চিৎ সাঁতার করানো হতো। সবচেয়ে কঠিন ছিল ডুব দিয়ে পানির নিচে লোহার প্লেটে মাইন লাগিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাঁতার কেটে ফেরত আসা। কেউ মারতে এলে তাকে প্রতিহত করার যুদ্ধও শেখানো হয়। প্রতিদিন ১৭১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ হতো। আমার নৌকমান্ডো নম্বর ছিল ০০৪৪। বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিং চলে প্রায় আড়াই মাস

নৌকমান্ডোরা ছিলেন ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে। কোনো কমান্ডার ছিল না এই সেক্টরে। প্রধান সেনাপতি কর্নেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী এটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। অপারেশনের জন্য যখন নৌকমান্ডোদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো, তখন তারা ওই সেক্টরের অধীনেই কাজ করতেন। অপারেশন শেষে আবার ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে চলে আসতেন তারা

নৌকমান্ডো ট্রেনিং শেষেই অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা করা হয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটে নৌঅ্যাটাকের পরিকল্পনা এটি। নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটের জন্য সাবমেরিনার আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জন নৌকমান্ডোকে পাঠানো হয়। মতিউর রহমান ছিলেন গ্রুপে

বীরপ্রতীক মতিউর বলেন, প্রশিক্ষণের পর আমাদের পাঠানো হয় আগরতলায়, নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে প্রত্যেককে দেওয়া হয় একটি লিমপেট মাইন, ফিনস, সুইমিং কস্টিউম, নাইফ, কাঁধে ঝোলানোর চটের ব্যাগ, কিছু কাপড়চোপড়, বন্দরের ম্যাপ জোয়ারভাটার চার্ট প্রভৃতি। প্রতিটি গ্রুপকে একটি রেডিও দেওয়া হয়। সীমান্ত পার হলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পথ দেখিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জে মুসার চরে আমরা আত্মগোপন করে থাকি। নদীবন্দর থেকে সেটি ছিল প্রায় এক মাইল দূরে

লিমপেট মাইন গামছা দিয়ে বুকে বেঁধে জাহাজে লাগাতে হবে; বড় জাহাজে তিনটি আর ছোট হলে দুটি মাইনেই চলবে ডুব দিয়ে আগে দেখতে হবে জাহাজের গায়ে শ্যাওলা আছে কিনা, থাকলে জায়গাটা পরিষ্কার করে মাইন ফিট করতে হবে নোঙর করা অস্ত্র গোলাবারুদপূর্ণ পাকিস্তানি জাহাজই টার্গেট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দ্রুত ফিরে যেতে হবে ট্রানজিট ক্যাম্পে, এমন নির্দেশনাই দেওয়া ছিল অপারেশন জ্যাকপটের নৌকমান্ডোদের

বলা হয়েছিল, ভারত থেকে সিগন্যাল আসবে রেডিওতে গানের মাধ্যমে। নির্ধারিত প্রথম গানটি বাজে ১৯৭১ সালের ১৩ অগাস্ট সকালে। তারপর আমরা রেকি করতে বের হই। আদমজী জুটমিলের মসজিদের উঁচু মিনারে উঠে বন্দরে আর্মিপজিশন, জাহাজের পজিশন দেখে কমান্ডারকে গিয়ে বলি। রেডিওতে প্রথম গানটি শোনানোর ২৪ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় গানটি বাজবে, ওইদিন রাতেই আক্রমণ করতে হবে। এমনটাই ছিল পরিকল্পনায়। কিন্তু দ্বিতীয় গানটি শোনানো হয় একদিন পর, অর্থাৎ ১৫ অগাস্ট সকালে। ফলে ওই দিন রাতেই নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে অপারেশনের প্রস্তুতি নিই আমরা

আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে অপারেশনে আমি ছাড়াও অংশ নেন আবদুর রহিম, হেদায়েত উল্লাহ, আজহার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুল হক, মাহবুব আহমেদ মিলন, জি এম আইয়ুব, আবদুল মালেক, আবদুল জলিল ফজলুল হক ভূঞা আমার কাজ ছিল এক্সপ্লোসিভ দিয়ে নদীবন্দরের টার্মিনাল উড়িয়ে দেওয়া, যাতে অন্য কোনো জাহাজ ভিড়তে না পারে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দ্রুত সরে আসি সঙ্গের তিনজন একটি পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজের গায়ে মাইন ফিট করে চলে আসে

নির্ধারিত সময় পর জাহাজ টার্মিনালে বিস্ফোরণ ঘটে। পাকিস্তানি আর্মি তখন এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। দূর থেকে আমরা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনি। অন্যরকম আনন্দ লেগেছিল তখন। তারপর ফিরে যাই আগরতলায়, নিউ ট্রানজিট ক্যাম্পে। অপারেশন জ্যাকপটের পর আমাদের দ্বিতীয় অপারেশন ছিল কাঁচপুর ফেরিঘাটে জাহাজ ফেরি ডুবিয়ে দেওয়া। সেটিতেও সফল হই। তৃতীয় নৌঅ্যাটাক করি কলাগাইছায় পাকিস্তানি জাহাজে

মতিউর রহমান (বীরপ্রতীক) এখন প্রয়াত কিন্তু একাত্তরের বীরদের মৃত্যু নেই তার বলা সব কথাই ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে প্রজন্মের উদ্দেশে নৌকমান্ডো মতিউর রহমান বলেন শেষ কথাগুলো, “মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে বসে থাকলে কি দেশ স্বাধীন হতো! মরার চিন্তায় যদি যুদ্ধে না যেতাম তাহলে কি স্বাধীনতা আসত! তোমরাও স্বপ্নটাকে বড় করো অলস হইয়ো না, সবসময় চেষ্টা করে যাও দেশের নিজের জন্য কাজ করো কাজই তোমাদের এগিয়ে নেবে

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button