সাঁওতাল গ্রামে সন্ধ্যা নামে
প্রকৃত সুখী মানুষ কোথায় মিলবে? সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, সুখী মানুষের খোঁজে যেতে হবে সাঁওতাল গ্রামে। মাদলের তাল আর আদিবাসী নাচের মধ্যে নিজেকে খোঁজার আনন্দ নিশ্চয়ই অন্যরকম হবে। আর এই আনন্দ উপভোগ করতে চাইলে যে কোন উৎসব ধরে যেতে হবে সাঁওতাল গ্রামে।
কলেজ বন্ধু দালু সরেন । সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আদিবাসী। বাড়ি দিনাজপুরের মহেশপুর গ্রামে। তার কাছে শুনেছি বাহাপরবের অনেক গল্প। গল্প শুনেই মনে মনে ঠিক করে ফেলি, এবারের বাহাপরবে যাব মহেশপুরে। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাসে সরাসরি দিনাজপুর। সকাল ৭টার মধ্যেই পৌঁছে যাই বোচাগঞ্জে।
বোচাগঞ্জ থেকে মহেশপুরের দুরত্ব ১২ কিলোমিটার। শালবনের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথটি চলে গেছে মহেশপুরের দিকে। আমরা সে পথেই এগোই। সাঁওতাল বন্ধু দালুর সঙ্গে আলাপ চলে হেলে দুলে।
ভারতের সাঁওতাল পরগনার অধিকারী হিসেবে এই সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বাস করতো বলেই নাকি এদের নাম হয়েছে সাঁওতাল। সাঁওতালদের বিশ্বাস একসময় তাদের আদি পিতামাতা ছিল। তাদের ভাষায় পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ি। তাদের ছিল সাত জোড়া সন্তান-সন্ততি। সন্তান – সন্ততির মধ্য থেকেই তৈরী হয় ১২ টি উপাধির। যেমন : মারডি, সরেন, কিস্কু, মুর্মু, হাঁসদা, টুডু, বেসরা, হেমব্রম, বাস্কে, চোঁড়ে, পাঁওরিয়া ও বেদিয়া। সে মতেই তৈরী হয় ১২ টি গোত্র। মুচকি হেসে দালু জানায় সরেন গোত্রের সাঁওতাল হওয়ায় তার নাম হয়েছে দালু সরেন। দালুর কথায় আমরাও মুচকি হাসি।
দালু বলতে থাকে, আমরাও চলতে থাকি। ফাল্গুন – চৈত্র মাসে সাঁওতালরা ধুমধামের সঙ্গে পালন করে ‘বাহাপরব ’ অনুষ্ঠানটি। সাঁওতালি ভাষায় ‘বাহা ’ মানে ‘ফুল ’ আর ‘পরব’ মানে ‘অনুষ্ঠান’ বা ‘উৎসব’। অনেকের কাছে এটি বসন্ত উৎসব।
আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। গ্রামের মেঠো পথে ভ্যান গাড়িটি ছুটে চলছে আপন গতিতে। খানিক এগোতেই মাটি আর ছনের তৈরী বিশেষ ঢঙের বাড়িগুলো আমাদের নজরে পড়ে। দালু বলল, সাঁওতালদের বাড়ীগুলো নাকি এমনটাই হয়। মাটি আর ছনে ছাওয়া।
কথা থামিয়ে দালু আবার শুরু করে বাহাপরবের কথা। বসন্তে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল ফোটে চারদিকে। বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। বাহাপরব এর মধ্য দিয়ে সাঁওতাল মেয়েরা তাদের খোঁপায় রঙ-বেরঙের ফুল পড়ে। এর পূর্বে নাকি তাদের ফুল ব্যবহারের নিয়ম নেই।
শালফুলকে সাঁওতালরা বলে ‘সারজম বাহার’। উৎসবটি তিন দিনের। প্রথমদিনের প্রধান অনুষ্ঠানের শুরুতে পূজার মাধ্যমে মুরগি বলি দেয়া হয়। উদ্দেশ্য জাহেরএরা, গোসায়এরা, মরেকু, তুরইকু নামক দেবতা বা বোঙ্গার সন্তষ্টি লাভ। পূজার পরে মেয়েরা খোঁপায় শালফুলসহ বিভিন্ন রঙের ফুল পরে দলবেঁধে নেচে গেয়ে বরণ করে নেয় নতুন বসন্তকে। একইসঙ্গে মাদল ঢোল বাজিয়ে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করে শালফুল।
এরই মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই মহেশপুরে। দালুর বাড়িতে খানিকটা বিশ্রাম। অতঃপর দুপুরে সাঁওতাল গ্রামে বেড়িয়ে পড়া।
গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে নির্জন বন আকৃতির জায়গায় চলছে বহাপরব অনুষ্ঠানটি। সেখানে বোঙ্গার (ভগবান) উদ্দেশ্যে উপোস অবস্থায় পূজা দিচ্ছেন গোত্রের জগ মাঝি ‘বাঠু সরেন’।
আমরা অবাক হয়ে দেখি পূজার আনুষ্ঠানিকতাগুলো। একটি উচু জায়গায় তিনটি ধনুক দাড় করিয়ে তার মধ্যে রাখা আছে চাউল, সিদুর, ধান, দুর্বা ঘাস আর বেশকিছু শালফুল। পাশেই বলি দেয়া হয় বেশ কিছু মুরগি। হঠ্যাৎ বাঠু সরেন মন্ত্র পড়তে থাকে – ‘জোহার এবে খানদো, মরেকু তুরেকু …’। মন্ত্র শুনে আমাদের মনে হচ্ছিল যেন কোন কল্পদেশে চলে এসেছি।
শালফুল গ্রহণের পরেই সাঁওতালরা মেতে ওঠে অন্যরকম এক আনন্দে। মেয়েদের খোঁপায় খোঁপায় শালফুল। পুরুষেরা মাদল আর ঢোল বাজায়। আর সে তালে খোঁপায় মেয়েরা হাত ধরাধরি করে নাচে। সাঁওতালদের কাছে এটি ঝুমের নাচ। নাচের সঙ্গে চলে সমবেত গান – ‘তোকয় কোকে চিয়ে লেদা বীর দিসাম দঃ, তোকয় কোকে টান্ডি লেদা বীর দিসাম দঃ..’।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। নেচে গেয়ে বাড়ি বাড়ি যেতে থাকে সাঁওতালরা। সেখানে নতুন বছরের শালফুল বিতরণ করা হয়। ফুল গ্রহণের আগে বাড়ির লোকেরা বিতরণকারীর পা ধুয়ে ভক্তি দিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। সাঁওতালদের বিশ্বাস ফুলরূপে বোঙ্গাই তার ঘরে প্রবেশ করছে ।
সন্ধ্যা গড়িয়ে নামে অন্ধকার। গোটা গ্রাম মেতে ওঠে হাড়িয়া খাওয়ায়। হাড়িয়া সাঁওতালদের প্রিয় পানীয় ও সংস্কৃতির একটি অংশ। মতপার্থক্যের বিভেদ ভূলে হাতে হাত ভেদে নাচে সাঁওতাল মেয়েরা। তাদের আনন্দ উল্লাসের জোয়ারে ভেসে যায় না বলা সব কষ্ট।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংবাদে ৪ নভেম্বর ২০১১
© 2011 – 2018, https:.