সাঁওতালী বিশ্বাসে নানা কাহিনী
বাড়িটির চারপাশ একেবারেই থমথমে। কোনো মানুষজনের দেখা নেই। মূল ফটকের পাশেই উঁ”ু করে তৈরি করা হয়েছে একটি প্রার্থনার স্থান। আকার দেখে বোঝা যায় এটি গ্রামের একমাত্র বোঙ্গা। আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের প্রার্থনার স্থানকে বোঙ্গা বলে। দরজায় কড়া নাড়তেই বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসে মধ্যবয়স্ক এক যুবক। নাম জানাল সানজিলা। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দৃশ্য যেন পাল্টে যায়। একদিকে কয়েকজন নারী-পুরুষ আয়েশ করে খাচ্ছে চুয়ানি। অন্যপাশে কয়েকজন রান্নায় ব্যস্ত। এরই মধ্যে এক মহিলা বারান্দায় ঘুম পাড়াচ্ছে তার বাচ্চাটিকে। আধো বাংলা আধো সাঁওতালী ভাষায় চলছে সে চেষ্টা।
দিনাজপুরের মহেশপুরের এ সাঁওতালপাড়ার মহতের নাম বাঠু সরেন। এটি তারই বাড়ি। মাটি আর ছনের তৈরি বেশ কয়েকটি ঘর নিয়ে গোলাকৃতির বাড়ি এটি। বাঠু জানাল বাঙালি নারীদের মতোই সাঁওতাল নারীদের প্রতিদিন ঘরের কাজ সারতে হয়। তবে তাদের সম্প্রদায়ে নারীর প্রাধান্য বেশ উঁচুতে। ফলে গোত্রে নারী নির্যাতনের বিষয়টি নেই বললেই চলে। তাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকে প্রচলিত বহু কাহিনীতেও নারীকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এমনই একটি সাঁওতালী কাহিনী বলেন বাঠু সরেন। কাহিনী এ রকম :
গভীর অরণ্যে শিকারে যাচ্ছিল এক সাঁওতাল যুবক। বনের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় মৃত্যুমুখে পড়ে এক বিষধর সাপ। সাপটি যুবকটির কাছে প্রাণভিক্ষা করে। সাপটির জন্য যুবকটির মায়া হয়। সে সাপটিকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। মৃত্যু থেকে উদ্ধার পেয়ে সাপটি উল্টো সাঁওতাল যুবকটিকেই গিলে খেতে চায়। যুবকটি সাপের এ রকম আচরণে হতবাক হয়ে যায়।
তর্ক ও বিতর্কের পর উভয়েই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যায় বটগাছ, গরু আর নদীর কাছে। সব শুনে নদী বলে, সাপ যদি যুবককে খেয়ে ফেলে তবে অনৈতিক কিছু হবে না। সে আক্ষেপ করে বলল, যে নদী মানুষের প্রাণ বাঁচায়, তৃষ্ণা মেটায় সে নদীতে কি মানুষেরা রাজ্যের ময়লা ফেলছে না! নদীর কথায় সাপ বেশ খুশি হয়। এরপর তারা যায় বটগাছের কাছে। বটগাছ বলল, সাপের ঐ কাজ অনৈতিক তো নয়ই বরং মানুষের ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ যে বৃক্ষের কাছ থেকে মানুষ শত উপকার পায় সে বৃক্ষ কি মানুষে কেটে উজাড় করে না! এবারো সাপ বেশ আনন্দিত হয়। সবশেষে যুবক আর সাপ যায় গরুর কাছে। গরু বলল, সাপের পক্ষে সাঁওতালী যুবককে গিলে খাওয়াই ঠিক হবে। কারণ যে গরু দুধ দেয়, চাষাবাদে সাহায্য করে, তাকেও মানুষ জবাই করে খেয়ে ফেলে। সবার কথা শুনে সাঁওতালী যুবকের জীবন বিপন্ন। কিন্তু সাপ বেশ খুশি। এবার সে যুবককে খেয়ে ফেলতে পারবে।
এদিকে স্বামীর জীবন রক্ষায় বিচারের এ দীর্ঘ সময়ে সাঁওতালী নারী শিখে নেয় কিছু মন্ত্র। সে মন্ত্রের জোরেই সে সাপটিকে মেরে ফেলে। এভাবেই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় সাঁওতালী যুবক।’আজো সাঁওতালী গাঁয়ে মায়েরা তার সন্তানদের শোনায় এ কাহিনীটি।
রাগদে হাজদার বয়স সত্তরের মতো। কিন্তু এখনো গলায় পড়েছেন হাঁসুলি। রাগদে জানাল সাঁওতাল রমণীদের প্রিয় অলঙ্কারগুলোর কথা। সাঁওতাল রমণীরা সৌন্দর্যপ্রিয়। এরা নানা অলঙ্কারে নিজেকে সাজাতে বেশ পছন্দ করে। মুচকি হেসে রাগদে র্হ র্হ করে বলতে থাকে অলঙ্কারের নামগুলোÑ হাঁসুলি, মালা ও তাবিজ, কানের দুল, সিঁথিপাটি, হাতে বালা, বাজু, বিছা, নূপুর, অঙ্গুরা ইত্যাদি। আলতা ও সিঁদুর ছাড়াও কাজল এবং সুরমা এদের বেশ পছন্দের। অনেক সাঁওতালী নারী সুবাসের জন্য সাবানের সঙ্গে মহুয়ার তেল মেশায়।
চুয়ানি খেতে খেতে বাড়ির মধ্যে কয়েকজন পরিকল্পনা করছিল করম উৎসবের। সাঁওতালরা করম উৎসবে আদিবাসী কড়াদের মতোই গাছের পূজা করে থাকে। তবে এ উৎসব নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত মিথটি একেবারেই ভিন্ন। সানজিলার জবানিতে শুনি করম রাজার কাহিনীটি।
‘করম আর ধরম দুুই ভাই। লোকে ডাকে কর্মু আর ধর্মু বলে। কর্মু চাষাবাদ করে খায়। আর ধর্মু মেতে থাকে ব্যবসা নিয়ে। দুই ভাই পাশাপাশি বাড়িতে থাকলেও খায় ভিন্ন। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি। উৎসবের মাস। কর্মু খুবই ঘটা করে তার বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করল। কিন্তু সে অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয় না ভাই ধর্মুকে ।
ধর্মুও কম যায় না। সে ব্যবসায়ী লোক। অন্য আরেকদিন সেও ঘটা করে বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করে। কিন্তু ভাই কর্মুকেও সে কিছুই জানায় না।
কর্মু ছিল আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান। দেবতা। তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্য মূর্তিতে রূপ নিলেন। অতঃপর আত্মগোপন করে রইলেন ধর্মুর বাড়ির খিড়কি দরজার ঠিক পাশেই।
ধর্মুর বাড়িতে তখন ভোজের জন্য ভাত রান্না চলছে। রাতের অন্ধকারে ভাতের ফেন ছুড়ে দিল ধর্মু। আর সে গরম ফেন গিয়ে পড়ল কর্মু দেবতার গায়ে। ঝলসে গেল কর্মুর সারা শরীর। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সে চলে আসে কাসাই নদীর ধারে। গঙ্গার শীতল জলে তার যন্ত্রণা উপশম করে।
কর্মুর অভিশাপে ধর্মু নিঃস্ব হলো। সবকিছু হারিয়ে সে কর্মুর ঘরেই কাজের লোক হয়ে কাজ করতে থাকে। অনেক দুঃখ-কষ্টের পর ধর্মু কর্মুর কৃপা লাভ করে। দুই ভাইয়ের মিলন হলো। করম গাছের ডাল ছুঁয়ে দুই ভাই শপথ করল :
‘আমার করম
আমার ধরম’।
এ ঘটনার পর থেকে সাঁওতালরা করম উৎসব পালন করে আসছে।
করম উৎসবের কথা বলতে বলতে সবাই চুয়ানি পানে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে হাড়িয়া ও চুয়ানি। হাড়িয়া কিছুটা ঘোলা দেখালেও চুয়ানি একেবার স্বচ্ছ পানির মতো। চুয়ানির মতো তামাক পাতাও সাঁওতালদের কাছে প্রিয় ও পবিত্র। তামাক পাতার প্রচলন নিয়ে সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে প্রাচীন এক কাহিনী। গোত্রের মহত থেকে শুনি কাহিনীটি।
‘এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছিল এক কন্যা। অভাবের কারণে তিনি তার কন্যাকে বিয়ে দিতে পারছিলেন না। ফলে অবিবাহিত অবস্থাতেই ব্রাহ্মণের কন্যাটি মৃত্যুবরণ করে। তার মৃতদেহ চিতায় ভস্মীভূত হওয়ার পর ভগবান চান্দো ভাবলেন, আহা! আমি মেয়ে রূপে তাকে পৃথিবীতে পাঠালাম অথচ কেউই তাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করল না। ভগবান ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তাকে এবার এমন বস্তু করে পৃথিবীতে পাঠাবেন যেন সবাই তাকে সর্বক্ষণ আদর করে।
ভগবান চান্দোর ইচ্ছায় সে ব্রাক্ষণ কন্যার চিতাভস্মের ওপর গজালো তামাক পাতা।’
তামাক পাতার মতো সাঁওতালদের হাড়িয়ার কাহিনীটিও বেশ অন্যরকম।
‘পৃথিবীতে মানব-মানবী তৈরি হলো। সাঁওতালদের ভাষায় পিলচু হড়ম ও পিলচু বুড়ি। একদিন এরা হিহিড়ি পিহিড়ি দ্বীপে বসতি করল। ঠাকুর জিয়োর শুভদৃষ্টি সব সময় থাকল তাদের ওপর। একদিন মানুষবেশে ঠাকুর জিয়ো তাদের শিখিয়ে দিয়ে যায় হাড়িয়া তৈরির সকল পন্থা। সেই সাথে আরো নির্দেশ দিয়ে যান হাড়িয়া তৈরির পর তাঁকে কিছুটা উৎসর্গ না করে যেন তারা তা স্পর্শ না করে। হাড়িয়া তৈরি হলো। তারা তা খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে রইল। সংজ্ঞা ফিরে এলে তারা উপলব্ধি করল তারা মানব-মানবী হয়ে গেছে।’
এ কারণেই সাঁওতালসহ সকল আদিবাসীদের কাছে হাড়িয়া পবিত্র পানীয়।
অভাবের কারণে মহেশপুরে অনেক সাঁওতাল পরিবারই গ্রহণ করেছে খ্রিস্টান ধর্ম। ফলে ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সাঁওতালী মুখগুলো। সাঁওতালদের মধ্যে পূর্বপুরুষদের নানা রীতি নিয়ে তৈরি হচ্ছে মতপার্থক্য। ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের মধ্যে পূর্বপুরুষদের অনেক আচারই আজ কুসংস্কার মাত্র। অন্যদিকে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের জাত-ধর্মকে টিকিয়ে রাখছে অনেক সাঁওতাল। ফলে যে কোনো উৎসবের সময়ে মহেশপুর গ্রামে আয়োজন চলে দুটি অনুষ্ঠানের। একটি প্রাণহীন জমজমাট, সমাজের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে। অন্যটি একেবারেই সাঁওতালদের আদি ঢংয়ে।
এ গ্রামের মহত বাঠু প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিজেদের সাঁওতালী জাতির আচার সংস্কৃতিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে। দুঃখ করে বাঠু বলেন, ‘অভাবের সঙ্গে সঙ্গে সাঁওতালরা বিক্রি করে ফেলছে নিজেদের জাতিসত্তাটুকু।’ ফেরার পথে নানা প্রশ্ন ভিড় করে মনে। বাঠু কি পারবে গোত্রের জাত-ধর্মকে রক্ষা করতে? নাকি প্রকৃতিই বাঁচিয়ে রাখবে এ সকল প্রাকৃতজনকে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০
© 2011 – 2018, https:.