মুক্তিযুদ্ধ

হু হু করে কেঁদে উঠত মনটা

‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল দিনাজপুর শহরের দক্ষিণে কুটিবাড়িতে। সেখানকার বাঙালি ইপিআর সদস্যরা আশপাশের গ্রামের মানুষদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ গড়ে তোলে। ফলে আমরা জানতাম কুটিবাড়ির ভেতরে কী ঘটছে। কথা ছিল গুলির শব্দ পেলেই কুটিবাড়িতে হানা দিতে হবে।

২৮ মার্চ ১৯৭১। বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে পাঠান পাঞ্জাবিরা। গুলির শব্দ হতেই গ্রামবাসী লাঠি, দা, বল্লম নিয়ে ঢুকে পড়ে কুটিবাড়িতে। মূলত কুটিবাড়ির যুদ্ধের মাধ্যমেই দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সে সময় কুটিবাড়ির অস্ত্র লুট হয়ে চলে আসে সাধারণ মানুষের হাতে। আমিও সেখান থেকে একটি রাইফেল নিয়ে আসি।
কুটিবাড়ি থেকে কয়েকজন ইপিআর সদস্য পরিবারসহ আশ্রয় নেয় মানপুর প্রাইমারি স্কুলে। গ্রামবাসী পালা করে দায়িত্ব নেয় পরিবারগুলোর খাওয়া – পরানোর। মজিদ নামের এক ইপিআর হাবিলদার তখন আমাকে রাইফেল লোড ও ফায়ার করা শিখিয়ে দেয়। এভাবেই প্রথম দেশের জন্য অস্ত্র তুলে নিই হাতে।
সে সময়ের এক রাতের কথা। গ্রামের পাশের বড় রাস্তায় বসে আমরা গল্প করছি। হঠাৎ দূর থেকে অনেক লোকের পায়ের শব্দ পাই। আমরা ভড়কে যাই। অজানা আতন্ক ভর করে মনে। পায়ের শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। আমি রাইফেলটা শক্ত করে ধরি। রাইফেল তাক করে ওৎ পেতে থাকি। পায়ের শব্দ খুব কাছে আসতেই উচ্চ কন্ঠে বলি ‘হোল্ড’। আগত সবাই হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায়। আমরা পরিচয় জানতে চাই। বয়স্ক মতো একজন বলেন ‘আমি আব্বাস চেয়ারম্যান’। কাছে যেতেই দেখি, সে আমাদেরই গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব। সে কথা আজও মনে পড়ে।
সে সময় মানপুর থেকে ইপিআর হাবিলদার মজিদ, আজিজরা দশ মাইল এলাকায় গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের দিকে গুলি ছুড়ে চলে আসত। তাদের সাহায্য করতে আমরাও পিছু নিতাম। কিন্ত শুধু রাইফেল দিয়ে কি পাকিস্তানি সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে ঠেকনো যায় ?
দিনাজপুর মুক্ত ছিল প্রায় ১৩ দিন। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১। দিনাজপুর শহরের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনী। ওই দিন সেনাবাহিনীর একটি বড় দল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভূষিরবন্দর রামডুবি হয়ে শহরের নিকটবর্তী চেহেলগাজীতে আক্রমণ করে। সেনাবাহিনীর অন্য দলটি রাজবাড়ী হয়ে এবং তৃতীয় দলটি পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, আমবাড়ী হয়ে দিনাজপুর শহর দখলে নেয়।
১৪ এপ্রিল ১৯৭১। দিনাজপুর শহর পাক সেনাদের দখলে। আমরা পরিবার নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে চলে আসি ভারতের রাধিকাপুরের উদগ্রামে।  শরাণার্থী বেশি হওয়ায় সেখানে দেখা দেয় খাবারসংকট। রেশন তুলতে আমাদের যেতে হতো ভারতের কালিয়াগঞ্জে। সেখানে দেখা হয় হাবিলদার মজিদের সঙ্গে। তার উৎসাহে আমরা ট্রেনিংয়ে যাওয়ার প্রস্তÍতি নিই।

মে মাসের শেষের দিকের কথা। তরঙ্গপুর ছিল ৭ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স। আমি ও আমার দুই ভাই কৃষ্ণ কিশোর, যুগল কিশোর এবং একই গ্রামের জিতেন্দ্রনাথ দাস, লিয়াকত, সাইদুল, মফিজ উদ্দিন, গোপাল চন্দ্র মাস্টারসহ  ২০ জন ছেলে একত্র হয়ে ক্যাম্পে যোগাযোগ করি। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর নাজমুল। প্রথমে প্রতিরাম ও পরে আমরা ট্রেনিংয়ের জন্য আসি শিলিগুড়িতে।
ট্রেনিংয়ের প্রথম দিন ছবি তুলে এফএফ নম্বর দেওয়া হয়। আমার এফএফ নম্বর ছিল ৫৪১৮। প্রশিক্ষক ছিলেন কেদার খাঁ। আমাদের ট্রেনিং চলে ২৮দিন।
ট্রেনিং শেষে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর, ইউসুফ প্রফেসর প্রমুখ। তাদেরকে এভাবে পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি। তারা আমাদের দেশের কথা বলে উদ্দীপ্ত করলেন। বললেন, ‘দেশের জন্য অনেক বড় দায়িত্ব নিতে হবে তোমাদের। ভেতরে যারা আটকা আছে তারা তোমাদেরই বাবা,মা, ভাইবোন । অন্যায়ভাবে লুটপাট করো না, অন্যায়ভাবে কাউকে মেরো না।’
ট্রেনিং শেষে আমাদের ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রথমে তরঙ্গপুরে এবং পরে পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজশাহীতে। রাজশাহীর অবস্থা তখন ভালো ছিল না। মালদহের শেষ প্রান্ত হয়ে আমরা মহদেবপুর ক্যাম্পে আসি। আমরা যখন পৌঁছি তখন আর্টিলারি হামলা চলছিল। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তিনি ২০ জন করে গ্রুপ তৈরি করে দিলেন। আমাদের গ্রুপের লিডার ছিলেন গোপাল।
প্রতিদিনই আমাদের ছেলেরা মারা পড়তে থাকল। অপারেশনের আগে যার সাথে কথা হয়েছে সন্ধ্যায় সে ফিরছে জখম হয়ে, নতুবা লাশ হয়ে। এগুলো দেখে মনের মধ্যে ঝড় উঠত। হু হু করে কেদে উঠত মনটা। কবে স্বাধীন হবে দেশ? মনে মনে প্রস্ততি নেই, ‘হয় স্বাধীনতা, নতুবা মৃত্যু’। কোন কোন মুক্তিযোদ্ধা মাঝে মাঝে ভয়ে ভড়কে যেত।  তাদের মৃত্যুভয় কাটানোর দায়িত্ব নিত অন্য সহযোদ্ধারা। এভাবে আমরা যুদ্ধ করি নবাবগঞ্জ থানার কলাবাড়ি, বেগুনবাড়ি, সোনামসজিদ,  গোমাস্তাপুরসহ অন্য এলাকাগুলোতে।
২২ নভেম্বর ১৯৭১, সকাল ৭ টা। আমরা ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা মহদেবপুর হয়ে এগোচ্ছিলাম গোমস্তাপুরে আক্রমণের জন্য। দলের লিডার গোপাল। আমরা ক্রোলিং করে এগোচ্ছি। একদল ফায়ার করছে, অন্য দল সেই সুযোগে সামনে এগোচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ছিল। আমি আর গোপাল খুব কাছাকাছি। আমাদের ঘর্মাক্ত মুখগুলোতে অজানা আতন্ক। গুলি ছুড়ে সামনে এগোতেই একটি গুলি এসে লাগে আমার বাঁ পায়ে। আমি টের পাই না। রক্তে ভিজে যায় গোটা পা। আমি তখনো গুলি ছুড়ছি। গুলিটি আমার পা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। পাশ থেকে গোপাল বলে, ‘দো¯,Í তুমি তো গুলি খেয়েছ’। প্রথম বিশ্বাস করিনি, পরে দেখি পা অবশ হয়ে আসছে। অপারেশনে আমাদের অবস্থা ভালো ছিল না। গোপাল ওয়্যারলেসে ক্যাম্পে মেসেজ পাঠায়। পেছন থেকে ভারতীয় সৈন্যরা আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়। সে সুযোগে গোপালের কাঁধে ভর দিয়ে আমি পেছন ফিরে চলে আসি ক্যাম্পে। সে দিনের অপারেশনে আমরা মানিককে হারাই। আজও তার মুখটি ভুলতে পারিনি। শুনেছি সে বিরলেরই ছেলে ছিল। কিন্ত তার পরিবারের হদিস আমরা আজও পাইনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি প্রথমে মালদহে চিকিৎসা নিয়ে চলে আসি ভারতের কন্যঝরা হাসপাতালে।’
দিনাজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে বসে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাগুলো বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুবত কুমার দাস। তার গ্রামের বাড়ি বিরল উপজেলার মানপুরে। পিতার নাম সত্য নারায়ণ দাস ও মাতা প্রেমা দাস। ১৯৭১ এ তিনি ছিলেন একাডেমিক স্কুলের ম্যাট্রিক ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। বড়দের কাছ থেকে শুনতেন দেশের নানা বৈষম্যের কথা। ধারণা করতেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ দেশের সাধারণ মানুষ খাবার দিয়ে, খবর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন’। যুদ্ধকালীন সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সুবত কুমার দাস  বলেন, ‘সারা দেশের মতো তখন চাঁপাইয়ের কিছু লোকও  ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। যুদ্ধের সময় তারা আমাদের সঙ্গে সুন্দর কথা বলত। খাবার বা থাকার ব্যবস্থা করে দিত। কিন্ত তারপরে তারা যা করত তা হলো দ্রুত পাঞ্জাবিদের খবর দিয়ে আসা।’
স্বাধীনের পর মানুষের মনের অবস্থার কেমন ছিল ? তিনি বলেন, ‘ নতুন একটি দেশ পেয়েছে সবাই। দেশ ছিল ভঙ্গুর। কিন্ত তবুও মানুষের মধ্যে ছিল নতুনভাবে বাঁচার একটি স্বপ্ন। দেশ গড়ার সেটা ছিল জাগ্রত স্বপ্ন।’
মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সুবত কুমার বলেন, ‘যুদ্ধের পরে ভেবেছি কী হবে কাগুজে সনদ দিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে এখন আমাদের দায়িত্ব শেষ।’ তার মতে স্বাধীনের পর অর্থাৎ ১৯৭২-৭৩ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির সঠিক সময়। তাহলে হয়তো তালিকায় ভুয়া নাম আসত না।’ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতে মুক্তিযোদ্ধাদের চরম ক্ষতি হয়েছে। ফলে এখনো আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারিনি। নিজেদের স্বার্থের কারণে আমরা মুক্তিযোদ্ধারাও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছি।’
স্বাধীন দেশে ভালো লাগা কোনটি? এমন প্রশ্নে এই বীর বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। স্বাধীনতা পেয়েছি। এটিই বড় পাওয়া। নিজের ছেলে যখন আগ্রহ নিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে চায়। তখন মন ভরে যায় আমার।’  দিনাজপুরের আরেক মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার,  যিনি রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। মাঝে মাঝে তিনি আসেন সুবত কুমার দাসের সঙ্গে দেখা করতে। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারকে দেখে তখন সুবতের ছেলে প্রশ্ন করে তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে, ‘ বাবা, তোমাদের মুক্তিযোদ্ধারা খুব গরিব’। স্বাধীনের ৪০ বছর পরে পুত্রের মুখের এমন উক্তিতে মুক্তিযোদ্ধা সুবত শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
নানা ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে জীবন চলছে এই মুক্তিযোদ্ধার। মুক্তিযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা ভুলে যান মাঝে মাঝেই। কিন্ত ভুলে যেতে পারেন না রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের কথা। মুক্তিযোদ্ধা সুবত কুমার দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘এত বছরেও তাদের বিচার হয়নি এ দেশে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী আছে ?

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সচলায়তন ব্লগে ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ তে

© 2011 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button