‘তবুও তো স্বাধীনতা পেয়েছি’
‘জেলের ছদ্মবেশে আমরা একবার ঢুকে পড়ি বাংলাদেশে। বিলে জাল দিয়ে মাছ ধরার ভান করে জেলের ছদ্মবেশে আমরা আসি রাণীপুকুর বাজারে। হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে পড়ি। ঢালিতে ছিল না মাছ, রাখা আছে কয়েকটা রাইফেল। ভয়ে বুক দুরু দুরু করছে। এখনই হয়ত ধরা পড়ব। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপি। আমাদের দেখে একজন সৈন্য বলে ওঠে, ‘মাছরি মারতা, ছোড় দো উসকো, গারিব আদমি’। আমরা তখন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যাই সে যাত্রায়।
আরেকবার বোটহাট সীমান্ত পাড় হয়ে অস্ত্রসহ আমরা আশ্রয় নেই রাণীপুকুরের এক বাঁশঝাড়ের ভেতর। অমনি একঝাঁক মৌমাছি আমাদের আক্রমণ করে। মৌমাছির কামড়ে হাবিলদার কাঞ্চনের মৃতপ্রায় অবস্থা। সাতদিনের চিকিৎসার পর তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
এভাবেই চলছিল যুদ্ধ। ১১ নভেম্বর ১৯৭১। শনিবার। বিরল উপজেলার মুল্লুক দেওয়ানের পাশে ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। আমরা পরিকল্পনা করি সেখানে আক্রমণের। সেদিন আমরা দুটি দলে ভাগ হই। ক্যাম্প থেকে রওনা দেই ভোর পাঁচটায়। একটি দলের সঙ্গে আমি ভান্ডারার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। অপারেশনের সময় আমরা চলতাম মূল রাস্তার পাশ দিয়ে। ভান্ডারার পূর্বদিকের রাস্তায় আসতেই আমার পায়ের কাছে বিকট শব্দ হয়। প্রথম ভেবেছি পাকিস্তানিরা হয়ত আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। চোখের সামনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তখনো কিছু ঠাওর করতে পারিনি। পরে খেয়াল করলাম, বাঁ পা-টায় কোনো বোধ নেই। রক্তে ভিজে গেছে গোটা পা। পায়ের কিছু অংশ উড়ে গেছে। আমি স্থির হয়ে যাই। হাবিলদার নাজিম উদ্দিনকে বলি, আমার বাঁ পা-টা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা তখন আমাকে কাঁধে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে।
প্রথমে ঝগড়াপাড়ায় পরে রায়গঞ্জের এসবি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় আমার। ১৮দিন অচেতন অবস্থায় ছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরে, তখন দেখি আমার বাঁ পা কেটে ফেলা হয়েছে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায়তেই খবর পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখনো পায়ের দিকে তাকালে সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে। পা হারিয়ে কোনো আফসোস নেই আমার। তবুও তো স্বাধীনতা পেয়েছি।’
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন দিনাজপুরের এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম কৃষ্ণ কিশোর দাস। পিতা গৌর কিশোর দাস ছিলেন মানপুর স্কুলের শিক্ষক। বিরল উপজেলার মানপুর গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। প্রথমে মানপুর প্রাইমারি ও পরে দিনাজপুর একাডেমিক স্কুলে পড়াশুনা। এসএসসি পাসের পরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ফলে কৃষ্ণ কিশোরের আর কলেজে পড়া হয় না। চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই-ই যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পর সরকারিভাবেই কাঠের কাজের প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এক সকালে বিরলের মানপুরে কথা হয় তার সঙ্গে।
পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার্স ছিল কুটিবাড়ীতে। মানপুর থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। মূলত কুটিবাড়ীকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধ শুরু হয় দিনাজপুরে। সেটাও ১৯৭১ এর ২৮ মার্চের কথা। ২৭ মার্চ কুটিবাড়ীর দক্ষিণে পাওয়া যায় ছয়টি লাশ। চারটি লাশ বাঙালির, দুটি ছিল সাঁওতালের। ২৮ মার্চ সকালে কুটিবাড়ীতে গোলাগুলি শুরু হয়। গ্রামের লোকেরা তখন দলে দলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে পড়ে।
কৃষ্ণ কিশোরের ভাষায়, ‘কুটিবাড়ী থেকে নৌকায় করে আমরাও মানপুরে নিয়ে আসি আটটি পরিবারকে। লুট হয় অস্ত্রাগার। কিছু অস্ত্রসহ নৌকায় ওঠে হাবিলদার নাজিম উদ্দিন, কাঞ্চন, রিয়াজ, হালিমসহ অনেকেই। আমরা তাদের আশ্রয় দিই মানপুর স্কুলে। গ্রামের সবাই পালা করে পরিবারগুলোকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়।’
১৩ এপ্রিল ১৯৭১। দিনাজপুর শহরের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর একটি বড় দল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভূষিরবন্দর রামডুবি হয়ে শহরের নিকটবর্তী চেহেলগাজীতে আক্রমণ করে। অন্য দলটি রাজবাড়ী হয়ে শহরে ঢোকে এবং তৃতীয় দলটি পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, আমবাড়ী হয়ে দিনাজপুর শহর দখলে নেয়। শহর দখলে নিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশপাশের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিতে থাকে।
মানপুর গ্রামটি ছিল দিনাজপুর শহরের একেবারে নিকটবর্তী। তাই ঝুঁকি ছিল বেশি। তাই এক ভোরে পরিবারসহ কৃষ্ণ কিশোররা গরুর গাড়িতে রওনা হয় ভারতের দিকে। আশ্রয়ে থাকা হাবিলদাররাও তাদের সঙ্গী হয়। দিনাজপুরের পশ্চিম পলাশবাড়ীর বোটেরহাট ভান্ডারা সীমান্ত হয়ে তারা নিরাপদে চলে আসে ভারতের ঝগড়াপাড়ায়।
ঝগড়াপাড়ায় তখন ২০০টির মতো পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। থাকার কষ্ট, খাবারের কষ্ট তবুও জীবন বাঁচাতে বাঙালিরা দেশছাড়া। কিন্তু কতদিন এভাবে থাকা যায়? তাই কৃষ্ণ কিশোররা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যুদ্ধে যাওয়ার। তিনি বলেন, ‘আমরা দল গড়তে থাকি। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি হয় হাবিলদার নাজিম উদ্দিন ও কাঞ্চন। তারা আমাদের হাতে তুলে দেয় কুটিবাড়ী থেকে আনা রাইফেলগুলো। আয়োজন চলে রাইফেল চালানো ও যুদ্ধ করার আটদিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে তৈরি হয় আমাদের ১৫ জনের একটি দল। দলের লিডার ছিলেন হাবিলদার নাজিম উদ্দিন। দলটি ছিল ৭ নং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে। হাবিলদার নাজিমই নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন সেক্টরের সঙ্গে।’
কৃষ্ণ কিশোররা ছদ্মবেশে আক্রমণ করেই সরে পড়ত। মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চিনিয়ে, খাদ্য দিয়ে সাহায্য করত গ্রামের সাধারণ মানুষ। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে দিনাজপুরের ভান্ডারা, বৈরাগীপাড়া, ডুং ডুংগি, রাণীপুকুর এলাকায় যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি।
যুদ্ধের পর কী করলেন? এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাস জানালেন, ‘হাসপাতাল থেকে ফিরে আসি নিজ গ্রামে। ভাঙ্গাচোরা দেশ। তবু সবার মুখে হাসি। নতুন করে বাড়িঘর তুলছিল কেউ কেউ। স্বাধীনতার অর্জন ভুলিয়ে দিয়েছিল মানুষের সকল কষ্টগুলোকে।’
কৃষ্ণ কিশোর তখন লাঠিতে ভর দিয়ে চলেন। সে সময় তার ডাক আসে ঢাকা থেকে। প্রফেসর ইউসুফ আলী তখন শিক্ষামন্ত্রী। তার মাধ্যমেই তিনি ও খোরশেদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুর থেকে আসেন মগবাজারের সুশ্রী হাউজে। অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদেরও আনা হয়। সেখানে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাঠের কৃত্রিম পা তৈরিসহ নানা ধরনের কাজ শেখান। সেই থেকেই কৃষ্ণ কিশোর নিজেই এখন কৃত্রিম পায়ে চলেন। আর কাঠের কাজ করে পরিবার চালান।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি বিষয়ে অকপটে কথা বলেন এই ত্যাগী যোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের পর পরই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উপযুক্ত সময়। কিন্তু দেশ তখন ভঙ্গুর। সে সময় মানুষকে বাঁচানোই ছিল প্রধান কাজ। কেউ কি ভেবেছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে রাজনীতি হবে। একেক সরকার এসে একেক তালিকা বানাবে। সুবিধা তো দূরের কথা, আমরা বেঁচে থাকব কিনা তারই নিশ্চয়তা ছিল না। যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, সুবিধা লাভের আশায় তো নয়।’
স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা, জানতে চাইলে এই বীর গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘প্রতিবছর যখন ১৬ ডিসেম্বর আসে, যখন স্কুলের ছেলেমেয়েরা দেশের গান গায়, পতাকা উড়ায়, তখন খুব ভালো লাগে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন আমাকে ঘিরে ধরে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে চায়, তখন মনটা ভরে যায়। এর থেকে সুখের অনুভূতি আর কী হতে পারে।’
দেশের স্বাধীনতার জন্য পা হারিয়েছেন। এখন দেশের কোন জিনিস দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কষ্ট অনুভব করেন? খানিকটা চুপ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস, অতঃপর কৃষ্ণ কিশোরের উত্তর, ‘যখন দেখি স্বাধীন দেশে নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে হানাহানি করছি, যারা স্বাধীনতা চায়নি সেই রাজাকার, আলবদরদের বিচার হয়নি, যখন দেশ নিয়ে কেউ কেউ হতাশ হয়ে বলে, দেশটা পাকিস্তান থাকলেই ভালো হতো- তখন খুব কষ্ট পাই।’
যুদ্ধাহত ভাতা আট হাজার টাকা ও কাঠের কাজ করে যা পান, তা দিয়ে ভালোভাবেই চলছে এ মুক্তিযোদ্ধার জীবন। কৃষ্ণ কিশোর দাসের বয়স ৭০। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কোনো ঘটনাই এখনো হারিয়ে যায়নি তার স্মৃতি থেকে।
মাঝে মাঝে সন্ধ্যা নামতেই মানপুর গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। আলো আঁধারিতে আবদারের সুরে বলে, ‘দাদু, একটু যুদ্ধের কথা বল’। কৃষ্ণ কিশোর তখন তাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শোনান। ছেলেমেয়েদের কাছে তা গল্পের মতো লাগে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুনিয়ে তিনি সবাইকে বলেন, ‘তোমরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। খাঁচায় বন্দি কোনো পাখি নও। তোমরা স্বাধীন ও মুক্ত দেশের সন্তান। তোমরাই তো দেশটাকে এগিয়ে নিবে।’
কৃষ্ণ কিশোরের সঙ্গে বিদায় নিয়ে ফিরছিলাম। কৃষ্ণ কিশোর তখন প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘রাজাকারদের কি সত্যি বিচার হবে? আমরা কি পারব, তাদের শাস্তি দেখে যেতে?’ উত্তরে আমরা শুধুই নিশ্চুপ থাকি। মনে মনে ভাবি কবে আসবে সে দিন, যেদিন কষ্টের মেঘগুলো সরে যাবে এদেশের সূর্যসন্তানদের বুকের ভেতর থেকে?
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২২ ডিসেম্বর ২০১১
© 2011 – 2021, https:.