মগ নয়, রাখাইনদের কথা
কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত দেখে যাব, স্বপ্নের দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। বেড়ানোর পাশাপাশি এ এলাকার আদিবাসীদের কথা শুনব, তেমনটা ছিল পরিকল্পনা। বছর পনের আগে একবার এসেছিলাম কক্সবাজারে। তখন এখানে হোটেল-মোটেলের ঘিঞ্জি ছিল না। নিশিত রাতে সমুদ্রের গর্জন, আর কক্সবাজারের টিলার ওপর সমুদ্রমুখী লাইট হাউজটি দেখেছিলাম অবাক হয়ে!
সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। এখন কক্সবাজরের আনাচেকানাচে উঁচু উঁচু দালান। হোটেল-মোটেলের আড়ালে লাইট হাউজটি আর নজরে পড়ে না। সকাল-সন্ধ্যায় পর্যটকদের পদচারণায় হারিয়ে যায় স্থানীয় বাঙালি আর আদিবাসীদের মুখগুলো।
সকালের দিকে সমুদ্র দেখে ফিরছিলাম। পথেই তিনজন আদিবাসী নারীর দেখা। আপন গতিতেই হাঁটছে তারা। কোনো তাড়া নেই। পরিপাটি সাজ। তাঁতে বোনা রঙিন পোশাক শরীরে জড়ানো। সাদা গালে সাদা মাটির প্রলেপমাখা। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ভিন্ন কোনো ভাষায়। মাঝে মাঝে অট্টহাসি। আবার নীরবতা। এভাবেই পথ চলা। এরা কোন সম্প্রদায়ের? যাচ্ছেই বা কোথায়? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তাদের চলার পথে পা মিলাই। কথা হয় তাদের সঙ্গে।
এরা রাখাইন সম্প্রদায়ের আদিবাসী। সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে কক্সবাজারের বিভিন্ন দোকানে। কক্সবাজারে এসে বার্মিজ মার্কেটে আসেন না, এমন নারী পর্যটক খুব কমই আছে। রূপচর্চার সামগ্রী থেকে শুরু করে উপহার সামগ্রী সবই পাওয়া যায় এখানে। বার্মিজ মার্কেটের প্রায় সকল দোকানিই রাখাইন নারী।
কিন্তু এই রাখাইন সম্প্রদায়ের আদিভূমি কোথায়? কিভাবে তারা এ অঞ্চলে বসতি গড়ল? এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে ইতিহাসের নানা তথ্য পর্যালোচনায়।
অনেক অনেক দিন আগের কথা। ভারত উপমহাদেশের এক রাজ্যের নাম ছিল কপিলাবস্তু। সেখানকার রাজা ছিলেন অর্জুন (অঞ্জনাথ)। একবার রাজা অর্জুন পার্থিব জীবনের মায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার পূত্র ধর্মসনাথকে সিংহাসনে বসান এবং পরমারাধ্যে নির্বাণ লাভে ধ্যানের উপযুক্ত স্থান খুঁজতে থাকেন বনে-জঙ্গলে।
সে সময় দৈবক্রমে রাজার দেখা হয় ইন্দাকুমারী (ছেটমা) নামে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে। রাজা অর্জুন সেই তরুণীর প্রেমে পড়ে যান। ফলে, বিফলে যায় তার সন্ন্যাসী হওয়ার বাসনা। তারা তখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং কিছুদিন পরে ইন্দাকুমারী এক পুত্র সন্তানের জন্মদান করেন। রাজা তার আদরের পুত্রের নাম দেন ‘মারায়ু’। তিনি সে সময় শাক্য বংশের কিছু লোক নিয়ে গছপ নদী (কালাদান) বরাবর এসে ম্রোহং নগরে বসবাস শুরু করেন। এভাবে ধান্যবতী বা ধান্যওয়াদী নামক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটে। সেখানে রাজা অর্জুন স্বাধীনভাবে রাজত্ব গড়ে তোলেন।
রাজপুত্র মারায়ু’র বয়স তখন উনিশ। টগবগে যুবক। শাক্য বংশের এক শক্তিশালী যুবদল নিয়ে তিনি কপিলাবস্তু রাজ্য আক্রমণ করেন। উদ্দেশ্য সিংহাসন অধিকার করা। ফলে ভাই ধর্মসনাথের সঙ্গে বেধে যায় যুদ্ধ। অদম্য লড়াইয়ের পর খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২৫ সনে মারায়ু কপিলাবস্তু রাজ্যের সিংহাসন দখল করে নেন।ম্রোহং নগরের আশপাশে ছিল তথাকথিত বর্বর রাক্ষস দল। এরা আরাকান রাজ্যের জনগণকে জ্বালাতন করত এবং সুযোগ পেলেই ধরে ভক্ষণ করত। রাজা মারায়ু তখন খুব সহজেই সেই রাক্ষসদের দমন করে তার রাজত্ব কায়েম করে। এ কারণে রাখাইনদের কাছে রাজা মারায়ু তাদের জাতির জনক বা রক্ষাকারী।
রাখাইনরা এ রাষ্ট্রকে সুদীর্ঘকাল থেকে ‘রাখাইন প্রে’ নামে ডাকত। পরবর্তীকালে ইংরেজরা দখল করলে এ রাষ্ট্রকে ‘রাকান’ নামে রূপান্তর করে। ফলে ‘রাকান’ শব্দের পূর্বে ‘আ’ যুক্ত হয়ে তারা হয়ে যায় ‘আরাকান’। রাখাইন দেশের জনগণ ‘আরাকানিজ’ নামে অভিহিত হয়। আরাকানই বর্তমান মায়ানমার।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রমতে, এই অঞ্চলে নিগ্রিতা ও দ্রাবিদিয়ান জনগোষ্ঠীদের আবাসভূমি ছিল। সেটি খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ ও ৪০০০ সময়ের কথা। পরবর্তীতে আর্য ও মঙ্গোলীয়রা এখানে বসবাস শুরু করে। মঙ্গোলীয়রা আসাম, মণিপুর, বিহার, গঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল এবং উত্তর ভারত ও উত্তর-পূর্ব ভারত হতে আরাকানে আসে। অন্যদিকে আর্যরা কপিলাবস্তু, দেবদাহ, কনিন্ক, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চল এবং উত্তর ভারত হতে আরাকানে বসতি স্থাপন করে। এক সময় দ্রাবিদিয়ানরা নিগ্রিতাদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। দ্রাবিদিয়ানরা আবার সভ্য আর্য ও মঙ্গোলীয়দের দ্বারা বিতাড়িত হয়। ফলে এ অঞ্চলে টিকে থাকা সভ্য আর্য জনগোষ্ঠী ও মঙ্গোলীয়দের সংমিশ্রণে এক সময় সৃষ্টি হয় রাখাইন জাতির।
সময়টি অষ্টাদশ শতাব্দীর চতুর্থ হতে শেষ দশক পর্যন্ত। সে সময় আরাকান অঞ্চলটি ছিল ব্যাপক বিদ্রোহ, হত্যা ও ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বমুখর এক বিপর্যস্ত রাজ্য। উক্ত শতাব্দীর শেষের দিকে, নিজ অমাত্যবর্গের চক্রান্তে আরাকানের তৎকালীন স্বাধীন রাজা বার্মার রাজা বোদোফায়ার কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন। ফলে বর্মীরা আরাকান দখলে নেয়। বর্মীর সেনাধ্যক্ষরা সে সময় অসংখ্য আরাকানী নারী-পুরুষ গ্রেফতার করে। তারা স্ত্রীলোকদের বার্মায় পাঠিয়ে দেয় এবং পুরুষদের হত্যা করতে থাকে।
তৃতীয় ধান্যবতী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘চেন্দা সূরিয়া’ আমলে ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং আরাকানে এসে ধর্ম প্রচার করেন। তাঁর উপস্থিতিতেই মহামুনি বুদ্ধমূর্তি তৈরি করা হয়। বর্মীরা আরাকানের সেই বুদ্ধমূর্তি তাদের রাজধানী মান্দালয়ে নিয়ে যায়। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আরাকানবাসীরা। তারা বর্মী দখলদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনে বর্মীবাহিনী নির্মম অত্যাচার চালায়। ফলে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ে রাখাইনরা।
১৭৮৪ সালের শীতের হিম হাওয়ায় মগ্ন এক রাত। আরাকানের মেঘবতী হতে ১৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি নৌকা নিয়ে বঙ্গোপসাগরে নৌকা ভাসায়। সাগর পাড়ি দিয়ে তিনদিন তিনরাত পর তারা আশ্রয় নেয় পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী দ্বীপে।
সে সময় ঐ দ্বীপে ছিল না কোনো জনমানব। ছিল শুধু হিংস্র জন্তু-জানোয়ার। রাখাইনরা সঙ্গে নিয়ে আসা শস্যবীজ দিয়ে ফসল রোপণ শুরু করে। তারা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তখন বাসগৃহের চারপাশে সুন্দরী কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ঘিরে রাখত। বড় ছেনি আর বল্লম ছাড়া তাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। তা দিয়েই তারা কৌশলে জন্তু শিকার করে তার মাংস খেত।
এক সময় এক ইউরোপিয়ান নেভেল অফিসার রাখাইনদের অবস্থান খুঁজে পায়। তার মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গেও রাখাইনদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অফিসাররা তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ, কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়।
এ অঞ্চলে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। ইংরেজরা স্বপ্ন দেখত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আরাকান রাজ্য দখলের। তাই তারা আদিবাসী জাতিগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখত। রাখাইনরা তখন ইংরেজদের সহযোগিতায় আরাকান থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের নিয়ে আসতে থাকে। এভাবে রাখাইনদের বসতির বিস্তৃতি ঘটে। সময়ের গতিতে ধীরে ধীরে রাখাইনরা ছড়িয়ে পড়ে গলাচিপা, কলাপাড়া, আমতলী, বরগুনা, বানিয়াহাতী, টিয়াখালী, কুয়াকাটা, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।
রাখাইনদের অনেকেই ‘মগ’ বলে থাকে। কিন্তু রাখাইনরা নিজেদের ‘মগ’ বলতে রাজি নয়। ফারসি শব্দ ‘মুগ’ থেকে ‘মগ’ নামের উৎপত্তি। মুগ অর্থ অগ্নি উপাসক। ধারণা করা হয় আরাকানের আদিবাসীগণ জড় উপাসক ছিল। এ বিষয়ে গবেষক সতেন্দ্রনাথ ঘোষাল মনে করেন সংস্কৃত শব্দ ‘মগদু’ থেকে ‘মগ’ শব্দের উৎপত্তি। মগদু অর্থ জলদস্যু। তার মতে আরাকানে কতিপয় লোক পর্তুগিজদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে লুটতরাজ চালাত। তাই তাদের ডাকা হতো ‘মগদু’ নামে। কালক্রমে এই মগদু বিকৃত হয়ে ‘মগ’ রূপ ধারণ করে।
এ বিষয়ে ভিন্ন মতামত দেন প্রফেসর ডি.জি.ই হল। তার মতে ‘মগ’ শব্দটি ‘মাঙ্গাল’ বা মঙ্গোলীয় শব্দ থেকে আসা। তিনি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আরাকানের অধিবাসীদের চেহারাগত মিল খুঁজে পান। ডা. গ্রিয়ারসন তাকে সমর্থন করেছেন। তার মতে মগেরা ইন্দোচীন জনগোষ্ঠীর একটি শাখা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ বিষয়ে রতন লাল চক্রবর্তী তার ‘বাংলাদেশ-বার্মা সম্পর্ক’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মগ’ শব্দটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তার মতে আরাকানের মগগণ পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। মগেরা আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও আরাকানের সমস্ত অধিবাসী জলদস্যু ছিল না এবং তারা সবাই মগও নন। তার রচনায় আক্রমণকারীদের মগ এবং পরে চট্টগামে আগত আরাকানিদের ‘আরাকানি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরাকানিদের মধ্যে রাখাইনরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সে সময় আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আরাকানে বাস করত। তথাকথিত যারা মগ বা জলদস্যু ছিল তারা রাখাইন নয় বরং অন্য কোনো ক্ষুদ্র জাতি বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া মিয়ানমার রাজ্যে ৭টি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশের নাম রাখাইন স্টেট। এটি পূর্বে আরাকান নামে পরিচিত ছিল। সে আরাকানে তথা পুরো মিয়ানমারে মগ নামে কোনো জনগোষ্ঠী এখনও নেই এবং পূর্বেও ছিল না। কিন্তু তবুও রাখাইন আদিবাসীদের ভাগ্য থেকে বিতাড়িত হয়নি ‘মগ’ নামক অমর্যাদাকর শব্দটি।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৫ জানুয়ারি ২০১২
© 2012 – 2018, https:.