ভ্রমণকথা

সাদা পাহাড়ের দেশে

‘পাহাড়ের গায়ে জমানো পানি চমৎকার দেখায়। সুমনের কথাই ঠিক, উপরে উঠতেই মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আমাদের দৃষ্টির সীমানায় চলে আসে। মন ছুঁয়ে যায় সে দৃশ্যগুলোতে। যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। আমাদের মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা। ওয়াও, অদ্ভত, খুব সুন্দর – শব্দগুলো প্রকম্পিত হয় পাহাড়ের গায়ে। চিনামাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়াভিরাম দৃশ্যে বিমোহিত হই আমরা। পাহাড়ের মাটিগুলো নানা রঙের। সাদা, গোলাপি, হলুদ, বেগুনি, খয়েরি, নীলাভ। যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।’

পাহাড়গুলো অন্যরকম। শক্ত তার দেহ, কিন্ত কদাকার নয়। সবুজ গাছের সঙ্গে নেই কোন বন্ধুতা। অথচ চারপাশে সবুজের রাজত্ব। সবুজের মাঝে পাহাড়গুলোকে রূপসী রমণীর মতো দেখায়। লাবন্যময়ী এ পাহাড়ের গায়ের রঙ ফর্সা। স্পর্শ করলেই হাতে পড়ে পাউডারের মতো সাদা প্রলেপ।
একটি পাহাড় আরেকটি পাহাড়ের সঙ্গে লাগানো। দুই পাহাড়ের মাঝে জমেছে বৃষ্টির পানি। সেদিকে চোখ পড়তেই থ হয়ে যাই। পানির রঙ, সে তো অপরূপ। একেবারে নীলাভ সবুজ। সুইজারল্যান্ডের কোন দ্বীপে চলে আসলাম নাকি ! স্বপ্নের মতো দেখায় সাদা পাহাড়গুলোকে।
গুল না তো ? তানিয়ার কথায় সুমন উত্তর দেয় না। বলতে থাকে।

 চিনামাটির সাদা পাহাড়
চিনামাটির সাদা পাহাড়

পাহাড়ের ওপরের দিকে যতই উঠি, ততই সবুজ স¤্রাজ্য চোখের সামনে ধরা দেয়। একদিকে দূর মেঘালয়ের উঁচু উঁচু সব পাহাড়। অন্যদিকে ছোট্ট ছোট্ট পাড়া গেড়েছে মানুষ। সবুজ ধানক্ষেতে দলবেঁধে নামছে সাদা বক। পাশেই বাঁশের ঘের দেয়া একটি মাটির বাড়ি। বাড়ির ভেতরে অনেক কলাগাছ। হাওয়ার চাপে দুলছে কলাপাতাগুলো। এক যুবক গাছের ছায়ায় বসে কি যেন ভাবছে। পাশেই চড়ে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগলগুলো। সাদা পাহাড়ের ওপর থেকে সবকিছু দেখতে ছবির মতো লাগে।
সুমনের কথা শেষ হতেই গোঁ ধরে তানিয়া। এত কাছে এসে চিনামাটির সাদা পাহাড় দেখব না, তা কি হয়। বন্ধু রবি, দীপ আর শারমিনের সঙ্গে জোট বাঁধি আমিও। অন্যরা বিরক্তমুখে তাকায়।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বন্ধুদের একটি দলের সঙ্গে এসেছি বিরিশিরিতে।  বিকেলের দিকটায় জমিদারবাড়ি আর মনিসিংহের স্মৃতিসৌধ দেখে নৌকা ভাসাই সোমেশ্বরীর বুকে। অন্ধকার নামতেই সঙ্গী হয় পুর্ণিমার চাঁদ।  স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় উষ্ণ পানিতে চলে দলবেধে খানিকটা ঝাঁপাঝাঁপি। ওয়াইএমসির রেস্ট হাউজে ফিরতেই সবাই গা এলিয়ে দেয়। ভোরে উঠে ঘুরতে যাওয়ার সাধ্যি কার?

আমরা সিদ্ধান্তে অটল থাকি। রাতেই পরিকল্পনা সেরে নেই স্থানীয় থিয়েটার কর্মী গোপালের সঙ্গে। চালকসহ চারটি মটরসাইকেলও ঠিক হয়ে যায়। বিরিশিরিকে ঘুরে দেখতে মটরসাইকেলের কোন বিকল্প নাই।
সকাল ৭টা। সবাই তখনও ঘুমোচ্ছে। আমরা রওনা হই সাদা পাহাড়ের দেশে। দুর্গাপুর উপজেলাকে পেছনে ফেলতেই রাস্তা শেষ। এবার সোমেশ্বরীকে পেরোতে হবে। আহা! দিনের আলোতে পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীকে দেখা। বাদামি বালির চর ঠেকেছে সোমেশ্বরীর বুকে। চরের ভেতর সাদাফুলের কাশবাগান। শিবগঞ্জ গুদারা পাড় হই আমরা। গুদারার মনা মাঝি জানান বর্ষায় নাকি সোমেশ্বরী হয়ে ওঠে অগ্নিশর্মা।
কামারখালির পথ পেরোতেই হাজং মাতা রাশিমনির স্মৃতিসৌধ। এর পাশদিয়ে কাঁচারাস্তাটি চলে গেছে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের দিকে। এখানেই রয়েছে চিনামাটির পাহাড়গুলো। সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি মেঠো পথে। সে পথেই ধুলো উড়িয়ে আমরা চলে আসি একেবারে শেষ প্রান্তে।
গ্রামের নাম কেন বগাউড়া ? তা জানা নেই স্থানীয়দের। একটি হাজং পাড়ার সামনে এসে থেমে যায় আমাদের মটরসাইকেল। মুচকি হেসে সুমন বলে, ‘এবার হাঁটা প্রতিযোগিতা’। শুনেই তানিয়ার চোখ বড় হয়ে যায়।
সবাই হাঁটছি। আমাদের ভেতর চিনামাটির পাহাড় দেখার তেষ্টা। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই চোখের সামনে উঁচু একটি পাহাড়। এপাশ থেকে ওপাশকে ঠাহর করা কঠিন। আমাদের দিকে সুমনের চোখ পরতেই বুঝে ফেলি চলে এসেছি সাদা পাহাড়ের দেশে।
আমরা পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি উপরের দিকটায়। পাহাড়ের গায়ে জমানো পানি চমৎকার দেখায়। সুমনের কথাই ঠিক, উপরে উঠতেই মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আমাদের দৃষ্টির সীমানায় চলে আসে। মন ছুঁয়ে যায় সে দৃশ্যগুলোতে। যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। কয়েকটি আবার উঁকি দিচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। আমাদের মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা। ওয়াও, অদ্ভত, খুব সুন্দর – শব্দগুলো প্রকম্পিত হয় পাহাড়ের গায়ে।
চিনামাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়াভিরাম দৃশ্যে বিমোহিত হই আমরা। পাহাড়ের মাটিগুলো নানা রঙের। সাদা, গোলাপি, হলুদ, বেগুনি, খয়েরি, নীলাভ। যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।
লোকজনের শব্দে পাহাড়ের একপাশে আমাদের দৃষ্টি পড়ে। একদল শ্রমিক অবিরত কাটছে পাহাড়ের মাটিগুলো। দেখেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। চিনামাটির এই খনিগুলোকে কি না কাটলেই নয়?
গোপাল জানালো কিছু তথ্য। ১৯৫৭ সাল থেকে নাকি এই মাটি উত্তোলনের কাজ চলছে। গোপালের কথায় আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এভাবে কাটতে থাকলে একসময় এ দেশে কি কোন পাহাড় মিলবে?
মনের আগুনে ঢালি পানি। সাদা পাহাড়ের উপরে বসে সবাই মিলে মেঘালয়ের পাহাড় দেখি। ‘ইস, যদি ওই পাহাড়টায় যেতে পারতাম’। নানা ইচ্ছা আমাদের মনে বাসা বাঁধে। সুমনের ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক শব্দ। আমরাও খেয়াল ফিরে পাই। এবার ফিরতে হবে। সাদা পাহাড়টিকে বিদায় জানাই আমরা। মনে মনে সুমনকে খানিকটা ধন্যবাদ জানাই। আজ না আসলে হয়তো এই পাহাড়টিকে কখনই দেখতে পেতাম না। এখনও মাঝে মাঝে কোন নিস্তব্ধ সকালে মনে পড়ে যায় সাদা পাহাড়ের কথা। আপন মনে তখন চিন্তা আসে, ‘এখনও কি আছে সে পাহাড়টি’।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে ৯ মার্চ ২০১২, নতুনদেশ ২ মে ২০১২

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button