জারমারে, কেইত্যা, বেঞ্জে
সূর্যটা ডুবেছে মাত্র। চারপাশের অন্ধকার কাটিয়ে উঠেছে মায়াবী চাঁদ। আমরা গোলাই গ্রামে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রত্যন্ত গ্রাম এটি। পঞ্চাশটির মতো পরিবারের বাস এখানটায়। মাটি আর ছনে ছাওয়া ছোট ছোট ঘর। দেখতে বেশ অন্যরকম।
একটি বাড়ির উঠোনে আমাদের চোখ আটকায়। মাটির উঁচু একটি ঢিবি। তাতে স্নিগ্ধ-পবিত্র ডাল-পাতা মেলে দৃঢ়ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে একটি তুলসী গাছ। পাশে মাটির প্রদীপ জ্বলছে। জলের ছিটায় পড়ে আছে দু-একটি জুঁই ফুল। প্রতিসন্ধ্যায় এখানে চলে এমন আচার।
গোলাই গ্রামটি আদিবাসী গ্রাম হিসেবেই বেশি পরিচিত। পাহাড়ি বা পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বাস করে এখানটায়। এ গ্রাম ছাড়াও রাজশাহীর জামদাহ, কানাপাড়া, খৈড়াকান্দিতে রয়েছে পাহাড়িয়াদের আরো কয়েকটি গ্রাম।
পাহাড়িয়া বা পাহাড়ি আদিবাসীদের গ্রামগুলো পরিচালিত হয় গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। এক সময় এ পরিষদে বেশ কয়েকটি পদ ছিল। এখন সে পরিষদও ছোট হয়ে আসছে। বর্তমানে এদের গ্রামগুলো পরিচালিত হচ্ছে গ্রাম প্রধান বা মোড়ল ও সাকিদার পদ নিয়ে। আদিবাসীদের জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে-যে কোন ক্ষেত্রেই মোড়লের উপস্থিতি আবশ্যক। আর নানা খবর সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটি করেন সাকিদার। গোলাই গ্রামের সাকিদার বীরেন কুমার সিং আমাদের পূর্বপরিচিত। কিন্তু তাকে না পেয়ে আমরা খোঁজ করি গোত্রপ্রধান বা মোড়লের।
মোড়লের নাম রঘুনাথ সিং। তার বাড়িতে আজ আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় লেগেছে। নাতির নাম রাখার অনুষ্ঠান। পাহাড়িয়া ভাষায় এ অনুষ্ঠানকে বলে ‘জাগো তিন্দা। রঘুনাথের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল নবজাতকের নামটি। নামটিও বেশ! কার্তিক কুপার সিং।
এক সময় পাহাড়িয়াদের ছিল চারটি গোত্র- সাওরিয়া, চেটে, কুমড়ে ও মাল। টাইটেল দিয়েই পাহাড়িয়াদের গোত্রকে বোঝানো হয়। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। পাহাড়িয়ারা এখন তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে শুধুই ‘সরদার’ ও ‘সিং’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে।
সন্তান জন্মানোর পরে পাহাড়িয়া আদিবাসীরা পালন করে বেশ কিছু আচার। এগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই প্রচলিত। পাহাড়িয়াদের সে আচারগুলোর কথা জানালেন রঘুনাথ।
প্রাচীন দাই প্রথা এখনো প্রচলিত আছে আদিবাসী গ্রামগুলোতে। আদিবাসী রীতি মেনে দাইরা নবজাতকের নাড়ি কাটে বাঁশের নলি দিয়ে। তারা প্রসবের কাজে ব্যবহার করে কাঁচি, নোন্দা (গোবর ও পাটকাঠি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরণের জ্বালানি ), ধুমড়া (ধূপ), ন্যাকড়া প্রভৃতি।জন্ম হওয়াকে পাহাড়িয়া ভাষায় বলে ‘জারমারে’। নবজাতক জন্ম নেয়ার পর তার পিতাকে কুড পাতলী (নাড়ি রাখার মাটির হাঁড়ি), জেজরী ( ঝাড়– ) প্রভৃতি ফেলে দিতে হয় দূরের মাঠ বা জঙ্গলে। নবজাতক পুত্র হলে ব্যবহার্য জিনিসের সঙ্গে ফেলতে হয় এতড়া ও চারা (তীর ও ধনুক)। যে স্থানে ফেলা হবে নিয়ম মেনে সেখানে মুরগি বলি দেয়া হয়। উদ্দেশ্য-শয়তান যেন কোনভাবেই শিশুর কোনো ক্ষতি করতে না পারে। পাহাড়িয়ারা এই আচারকে বলে ‘আম পাচো নামীনো পার্নোন পানা’।
নবজাতকের নাম রাখা হয় জন্মের সাত দিনের দিন। নাম রাখার পদ্ধতিটিও অন্যরকম। এ দিন নবজাতকের বাউয়া (বাবা), দূদূ ( মা), বাইয়া পাচো ( দাদা) তার নাম ধরে ডেকে তার দুইকানে তিনবার করে ফুঁ দেয়।
কথা থামিয়ে মোড়ল তার আত্মীয়দের বিদায় জানায়। আমরাও অপেক্ষায় থাকি। এমন সময় এগিয়ে আসে কলেজপড়ুয়া এক যুবক। কথা হয় তার সঙ্গে।
যুবকটির নাম বিমল কুমার সিং। বিমল বলল পিতার মৃত্যুর পর রক্ষা গোলা ( আদিবাসীদের মুষ্টি চালের সমিতি) কীভাবে তাদের পরিবারের অভাব ঘোচালো সে কথাগুলো। দারিদ্র্য দূর করতে আদিবাসীদের রক্ষা গোলা এক অনন্য উদাহরণ। বিমলের কাছ থেকে আমরা শুনি পাহাড়িয়াদের মৃত্যুকেন্দ্রিক বিশ্বাসগুলোর কথা।
পাহাড়িয়ারা মৃত্যুকে বলে ‘কেইত্যা’। মৃতদেহকে এরা মাটিচাপা দেয়। চেটে ও সাওরিয়া গোত্রের লোকেরা মৃতদেহ পূর্ব-পশ্চিমে এবং অন্যরা উত্তর-দক্ষিণে মুখ করে কবর দেয়। প্রথমে এরা মৃতকে গোসল করিয়ে সারা শরীরে হলুদ ও তেল মাখায়। অতঃপর মৃতদেহকে বাঁশের খাটলী দিয়ে গৌরিখুড়ায় ( কবরস্থান) নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে নেয়া হয় খিচুড়ি, বিন্নি ধান, ভুট্টা, আমপাতা, তুলসি পাতা, নোন্দা প্রভৃতি। মৃতকে মাটিচাপা দেয়ার পর কবরের পাশে খাটলী কেটে কলা পাতায় বিড়ি, ধান, ভুট্টা, ডিম, চাল, দুর্বাঘাস, দিয়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। প্রার্থনা শেষে জল ছিটানো হয় সবার গায়ে। পাহাড়িদের বিশ্বাস- এতে কারো ওপর কোন আত্মা ভর করতে পারে না।
আমরা তন্ময় হয়ে শুনি বিমলের কথা। ১৩ দিনের দিন আয়োজন করা হয় কোয়ালা বা শ্রাদ্ধের। এর আগে ওই পরিবারের হলুদ, কাচাঁ পেঁয়াজ খাওয়া নিষেধ। কাপড় চোপড় পরিষ্কার করা, তেল দেয়া ও চুল-দাড়িও কাটা যায় না।
এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যার রান্না শেষে হাঁড়ির প্রথম খাবার মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কলাপাতায় মুড়ে চালে তুলে রাখা হয়। শ্রাদ্ধের দিন মুড়ে রাখা খাবার বুজরিওর বা দড়বারা (যে চারজন মৃতের খাটলী ঘাড়ে নিয়েছিল) খুব ভোরের দিকে কবরস্থানে নিয়ে যায়। সঙ্গে নেয়া হয় হলুদ খিচুড়ি ও রান্না করা ছোট মুরগি। তারা সেগুলোকে সেখানে রেখে দিয়ে আসে। এটিই আদিবাসী নিয়ম। ওইদিন মৃতের বাড়িতে কামান করা হয়। নাপিত এসে গোত্রের সবাইকে চুল-গোঁফ কেটে শুদ্ধ করে।
কথার পিঠে চলছে কথা। এমন সময় আসে পাশের বাড়ির রনজিত। সঙ্গে তার স্ত্রী মালতি। মালতির মাথায় ভরাট সিঁদুর। রনজিত আলাপ জমায় আমাদের সঙ্গে। কথা ওঠে তার বিয়ে নিয়ে। খানিকটা লজ্জিত ও বিনীত ভঙ্গীতে রনজিত জানালো পাহাড়িয়া আদিবাসী বিয়ের আদ্যোপান্ত।
বিয়েকে পাহাড়িয়া ভাষায় বলে ‘বেঞ্জে’। পাহাড়িয়াদের বিয়ের পাকা কথার দিনই কন্যাকে কাঠের মালা ও খাড়ু ( লোহার তৈরি বালা) পরানো হয়। এই খাড়ু পরা দেখলেই গোত্রের অন্যরা বুঝতে পারে যে মেয়ের বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে।
বিয়ের অনুষ্ঠানের দুদিন আগে উভয়পক্ষকে গা চালানী বা গ্রামপুজোর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। বিয়ের দিন কন্যার বাড়িতে যাওয়ার আগে বরকে সাক্ষী পুজো হিসেবে আমগাছকে বিয়ে করতে হয়। গাছের চারপাশে চালুন বাতি (মাটির প্রদীপ) নিয়ে বরকে সাতপাক ঘুরতে হয়।
বিয়ে বাড়ির উঠোনে সাজানো হয় চলমা তলা। চারটি কলা গাছ সমান চারটি গর্তে পুঁতে দেয়া হয়। তার আগে গর্তে দেয়া হয় পয়সা। এ সময় গান ধরে সবাই। কি গান ? পাশ থেকে মোড়ল কাঁপা কাঁপা কন্ঠে গান ধরে ;
‘এতোদিন ছিলি রে কলার গাছ- জংগলে জংগলে
আজ কেন আলীরে কলার গাছ রনজিতের বাড়িতে
ডুম তাক্কা ডুম
ডুম তাক্কা তাক্কা…’
গান থামতেই আবার শুরু হয় রনজিতের কথা।
কন্যার বাড়িতে বর পৌঁছানোর পর তুলসী জল ছিটিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরে আনা হয়। শয়তানকে গৃহের বাইরে রাখাই উদ্দেশ্য। পাহাড়িয়া ভাষায় এই আচারকে বলে ‘মাড়াকাম্বে’। এরপর কনের মা বরকে পা ধুয়ে বরণ করে নেয়। পনের সঙ্গে বরকে আনতে হয় দুই কলসিতে টাডি (এক প্রকার মদ), ঘাস, কলা, বিড়ি, পান-সুপারি, চিনি, বাতাসা, তেল, জল, সিন্দুর, চাল, ভাত, ধূপ, বাতি, ডিম, দুধ, আমকুড়ি, আমপাতা,তুলসী পাতা, ধান, আলো চাল প্রভৃতি।
কন্যা সাজিয়ে বর-কনেকে চলমা তলায় কাঠের পিঁড়িতে বসানো হয়। সে সময় উভয়ের মামা ও কাকা বসা অবস্থায় তাদের পিঁড়ি ধরে চলমা তলার চারপাশে সাত পাক ঘোরে। এ সময় বর প্রতি পাকে তুলসী পাতা দিয়ে কন্যাকে জল ছিটিয়ে দেয়। তারপর বর তার বাঁহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে সিন্দুর পড়ায়। এভাবেই তারা একে অপরের জীবনসঙ্গী হয়ে যায়। শেষে কন্যাকে তুলে দেয়া হয় বরপক্ষের মোড়লের হাতে।
কন্যাকে বরের বাড়িতে আনার পর বরের মা তুলসী জল ছিটিয়ে, চালুন বাতি রেখে উভয়ের পা ধুইয়ে গৃহে প্রবেশ করায়। এরপর বর যে আমগাছকে সাক্ষী পুজো দিয়েছিল সে গাছে কন্যাকে চুম্বন ও প্রণাম করিয়ে ঘরে তোলা হয়। এছাড়া কনেকে বরসহ তার বাবার বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়া হয়। একে বলে ‘আট মংলা ফিরনী’।
রাত বাড়তে থাকে। আমাদের আড্ডাও জমে ওঠে। একে একে উন্মোচিত হয় পাহাড়িয়া আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক আচারগুলো।
পাহাড়িয়াদের আদি নাম ছিল ‘তিরিংদাত’। এক সময় জমিদাররা তাদের বসিয়ে দেয় বিভিন্ন জায়গায়। পাহাড় থেকে এসেছে বলে ডাকা হয় ‘পাহাড়ি’ নামে। সে থেকে এরা পাহাড়ি বা পাহাড়িয়া।
কিন্ত জাতির নাম বদলে গেলেও এরা বদলায় নি তাদের পূর্বপুরুষদের রেওয়াজগুলো। নানা দুঃখ-কষ্টে আজো পাহাড়িয়া আদিবাসীরা আগলে রেখেছে তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিটাকে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক ২০০০ এ ২২ জুন ২০১২
© 2012 – 2018, https:.